প্রশ্নঃ ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দে বঙ্গ বিভাগের বিবরণ দাও। ১৯১১ খ্রিস্টাব্দে এটা রহিতকরণের সংশ্লিষ্ট ঘটনাবলি আলােচনা কর।

অথবা, ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দে বঙ্গভঙ্গের কারণ ও বঙ্গভঙ্গ রদ সম্পর্কে আলােচনা কর।

অথবা, ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দে বঙ্গভঙ্গের কারণসমূহ কী কী? কেন বঙ্গভঙ্গ বাতিল করা হয়েছিল? বঙ্গভঙ্গ রদ ঘােষণায় মুসলমানদের কী শিক্ষা লাভ হয়েছিল?

উপস্থাপনাঃ ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ ছিল ব্রিটিশ ভারতের শাসনতান্ত্রিক ইতিহাসে একটি বিশেষ যুগান্তকারী ও আলােড়ন সৃষ্টিকারী শাসন সংস্কার। পূর্বে বাংলা, বিহার, উড়িষ্যা এবং আসাম নিয়ে গঠিত ১,৭৯,০০০ বর্গ মাইল বিশিষ্ট একটি বঙ্গ প্রদেশ ছিল। রাজনৈতিক ও প্রশাসনিকসহ বিভিন্ন কারণে তৎকালীন গভর্নর লর্ড কার্জন ১৯০৫ সালে এ বৃহৎ বঙ্গ প্রদেশকে বিভক্ত করেন।

বঙ্গভঙ্গের কারণঃ

১. প্রশাসনিক কারণঃ বঙ্গ প্রদেশটি আয়তন ও জনসংখ্যার দিক থেকে সমগ্র ভারতের বিশাল প্রদেশ ছিল বলে একজন গভর্নরের পক্ষে এর প্রশাসন পরিচালনা করা কঠিন ছিল। তাই সুষ্ঠুভাবে রাজস্ব আদায়, কৃষি, শিল্প ও ব্যবসায়-বাণিজ্যের উন্নতি, শিক্ষা সংস্কৃতির প্রসার প্রভৃতি সুচারুরূপে সম্পাদনের জন্য একে বিভক্ত করে নতুন প্রদেশ গঠন আবশ্যক ছিল।

২. রাজনৈতিক কারণঃ লর্ড কার্জনের বঙ্গবিভাগ তথা পূর্ববাংলা ও আসাম প্রদেশ গঠনের পেছনে সূক্ষ্ম কিছু রাজনৈতিক কারণও বিদ্যমান ছিল বলে ঐতিহাসিকরা মনে করেন। যেমন-

ক. তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের সবচেয়ে অগ্রসর রাজনৈতিক কেন্দ্র ছিল বাংলা। তাই ব্রিটিশরা এ রাজনৈতিক শক্তিকে বিনষ্ট করার চক্রান্তে মেতে ওঠে, আর এ কারণেই বঙ্গভঙ্গ করা হয়।

খ. হিন্দু মুসলমানদের মধ্যে সাম্প্রদায়িকতা সৃষ্টি করতে পারলে ব্রিটিশ সরকারের জন্য ভারত শাসন করা নিরাপদ হবে, এ উদ্দেশ্য সামনে রেখেই বঙ্গভঙ্গ করা হয়।

গ. তৎকালীন পূর্ব বাংলার অধিকাংশ জনগণ ছিল মুসলমান। অন্যান্য ক্ষেত্রের মতাে রাজনৈতিক ক্ষেত্রেও তাদের অংশ গ্রহণ ছিল সংকীর্ণ। তাই ব্রিটিশ সরকারের পূর্ব বাংলায় নতুন প্রদেশ সৃষ্টির পরিকল্পনায় মুসলমানরা আগ্রহী হয়ে ওঠে।

ঘ. পূর্ব বাংলার আধা সামন্ততান্ত্রিক কাঠামাের মধ্যে রাজনৈতিক ক্ষেত্র লাভের প্রয়াসী একটি এলিট শ্রেণি গড়ে ওঠে, তারা বঙ্গভঙ্গের প্রতি সমর্থন জানায়।

৩. অর্থনৈতিক কারণঃ অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে অনগ্রসর পূর্ব বাংলা ও আসাম, পশ্চিম বাংলার কাঁচামালের যােগানদাতা হিসেবে ব্যবহার হলেও এখানে তেমন কোনাে শিল্প কারখানা গড়ে উঠেনি। তাছাড়া অর্থনৈতিক বিকাশ, ব্যাবসায় বাণিজ্য, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, যােগাযােগ ব্যবস্থারও তেমন কোনাে উন্নয়ন সাধিত হয়নি। তাই বঙ্গভঙ্গের প্রতি পূর্ব বাংলার জনগণ তাদের সমর্থন জানায়।

৪. সামাজিক কারণঃ ইংরেজদের ভারত উপমহাদেশের শাসন ক্ষমতা দখল করার পূর্বে মুসলমানরাই বাংলা শাসন করত, কিন্তু ইংরেজ শাসনামলে সামাজিক ক্ষেত্রে মুসলমানগণ অবহেলিত হতে থাকে। এ কারণে তারা বঙ্গভঙ্গের প্রতি সমর্থন জানায়।

৫. ধর্মীয় কারণঃ পূর্ব বাংলা ও আসাম ছিল মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চল। অন্যদিকে পশ্চিম বাংলায় হিন্দুরা সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিল। এ সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিকোণ থেকে বঙ্গভঙ্গ করা হয়েছিল যাতে হিন্দু মুসলমান বিভক্ত হয়ে পড়ে।

৬. আলীগড় আন্দোলনের প্রভাবঃ মুসলমানদের স্বকীয়তা বজায় রাখা ও পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত করে তােলার মানসে স্যার সৈয়দ আহমদের নেতৃত্বে যে আলীগড় আন্দোলন গড়ে ওঠে, তাও বঙ্গভঙ্গের পরােক্ষ কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

৭. জমিদারদের পূর্ববঙ্গ ত্যাগঃ পূর্ব বাংলার জমিদাররা পূর্ব বাংলা ত্যাগ করে কলকাতায় বিলাসী জীবন যাপন শুরু করে। এতে পূর্ব বাংলা অবহেলিত অবস্থায় থাকার কারণে বঙ্গভঙ্গের প্রয়ােজন হয়েছিল।

৮. ইংরেজ সরকারের টালবাহানায় বাঙালির আন্দোলনঃ ইংরেজ সরকার বহুদিন ধরে বাঙালিদের অধিকার নিয়ে তাদের সাথে বিভিন্নভাবে টালবাহানা করে আসছিল। এমতাবস্থায় বাংলার বিদ্রোহী জনতা তাদের বিরুদ্ধে আন্দোলন। শুরু করলে তারা বঙ্গভঙ্গ সাধন করে।

বঙ্গভঙ্গ রদের কারণঃ

১. উগ্র হিন্দু জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের প্রভাবঃ ভারতের উগ্র জাতীয়তাবাদী হিন্দুরা বঙ্গভঙ্গকে হিন্দু মুসলমানদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টির একটি ষড়যন্ত্র বলে প্রচারণা চালায়। উগ্র হিন্দু নেতারা জনগণকে এ বলে উদ্বুদ্ধ করে, বঙ্গভঙ্গের অর্থ হচ্ছে বঙ্গমাতাকে বিভক্ত করা। ফলে বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে দুর্বার হিন্দু জাতীয়তাবাদী আন্দোলন গড়ে ওঠে।

২. হিন্দু সম্প্রদায়ের ঈর্ষাকাতরতাঃ বঙ্গভঙ্গের ফলে ভবিষ্যতে মুসলমানদের আলাদা আবাসভূমি সৃষ্টি ও পূর্ববঙ্গে মুসলমানদের ক্রমােন্নতি দেখে হিন্দু সম্প্রদায় ঈর্ষায় ফেটে পড়ে। তারা মুসলমানদের মধ্যে শিক্ষা বিস্তার ও নবজাগরণ দেখে শােষণ ও লুটতরাজ করতে না পারার আশঙ্কায় বঙ্গভঙ্গ রদের আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ে।

৩. বিলাতী দ্রব্য বর্জনঃ ভারতীয় কংগ্রেস নেতৃবৃন্দ বিলাতী দ্রব্য বর্জনের মাধ্যমে অর্থনৈতিক দিক থেকে ব্রিটিশ সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করে। হিন্দুদের এ কোশল ফলপ্রসূ প্রমাণিত হয়। ফলে ব্রিটিশ সরকার বঙ্গভঙ্গ পরিকল্পনা বাতিল করতে বাধ্য হয়।

৪. ভীতি প্রদর্শনঃ ভারতমাতাকে ‘কালী’ হিসেবে চিহ্নিত করে হিন্দু জাতীয়তাবাদীরা আন্দোলনের তীব্রতা বৃদ্ধি করে। ফলত ভারতের বিভিন্ন স্থানে হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়। ভারতের জাতীয়তাবাদী নেতা ক্ষুদিরাম বসু এমনি কয়েকটি ঘটনার সাথে যুক্ত থাকার অভিযােগে অভিযুক্ত হন, অবশেষে তার ফাঁসি হয়।

৫. ব্রিটিশ বিরােধী আন্দোলনঃ বঙ্গভঙ্গকে কেন্দ্র করে স্বদেশীরা একত্রিত হতে থাকে। তাদের আন্দোলন ব্রিটিশ বিরােধী আন্দোলনে পরিণত হয়। ফলে এ আন্দোলনে ভীত হয়ে ব্রিটিশ সরকার বঙ্গভঙ্গ পরিকল্পনা বাতিল করতে বাধ্য হন।

৬. Divide and Rule নীতির বিরােধিতাঃ হিন্দু সম্প্রদায়ের কিছু ধুরন্ধর রাজনীতিক বঙ্গভঙ্গকে ব্রিটিশের রাজনৈতিক ফন্দি বলে আখ্যায়িত করে। তারা বঙ্গভঙ্গকে Divide and Rule বিভাজন কর এবং শাসন কর’ নীতির বাস্তবায়ন বলে ঘােষণা দিয়ে তীব্র আন্দোলনে ফেটে পড়ে।

৭. মুসলমানদের দুর্বলতাঃ বঙ্গভঙ্গের ফলে মুসলমানরা লাভবান হলেও কংগ্রেস ও হিন্দুদের প্রবল আন্দোলনের মুখে তারা জোরালাে ভূমিকা রাখতে পারেনি। ফলে বঙ্গভঙ্গ রদ হয়ে যায়।

৮. স্বদেশি আন্দোলনঃ বঙ্গভঙ্গ বিরােধী আন্দোলনই পরবর্তীকালে স্বদেশি আন্দোলনে পরিণত হয়। সভা, বিক্ষোভ ইত্যাদি কর্মসূচির মাধ্যমে পত্র-পত্রিকায় উত্তেজনাকর বক্তৃতা ছাপানাে হয়। ফলে ব্রিটিশ সরকার বঙ্গভঙ্গ রদ করতে বাধ্য হয়।

বঙ্গভঙ্গ রদের ফলে মুসলমানরা যে শিক্ষালাভ করেঃ

১. রাজনীতিতে বিশ্বাসের স্থান নেই।

২. স্বাধিকার অর্জনের পথ সহজসাধ্য নয়; বরং দুর্গম।

৩. দাবি আদায়ের জন্য ঐক্যবদ্ধ সাংগঠনিক প্রচেষ্টা একান্ত অপরিহার্য।

৪. ব্রিটিশ সরকার চরম বিশ্বাসঘাতক।

৫. হিন্দু সম্প্রদায় এ উপমহাদেশে মুসলমানদের চিরশত্রু।

উপসংহারঃ ব্রিটিশ ভারতের সাংবিধানিক অগ্রগতিতে ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ নিঃসন্দেহে একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। তবে বিভিন্ন ঘটনার প্রেক্ষিতে ১৯১১ সালে এ বঙ্গভঙ্গ রদ করা হয়েছিল ঠিকই, কিন্তু এ ঘটনার সূত্র ধরেই পরবর্তীতে ১৯৪৭ সালে ভারত স্বাধীন হয় এবং পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্ম হয়।