প্রশ্নঃ ১৮৭২ সালের সাক্ষ্য আইনে চরিত্র কি? “আদালতের দায়িত্ব হচ্ছে মামলার বিচার করা, মানুষের নয়”- ব্যাখ্যা কর।
উত্তরঃ সাক্ষ্য আইনের ৫৫ ধারার ব্যাখ্যা অনুসারে ‘চরিত্র’ শব্দটির দ্বারা খ্যাতি ও প্রকৃতি বুঝায়। এক ব্যক্তি সম্পর্কে অন্যে যা ধারণা করে তা হচ্ছে সে ব্যক্তির খ্যাতি বা সুনাম। কিন্তু প্রকৃতি হচ্ছে এক ব্যক্তির স্বভাব সম্পর্কে অন্য লোকের অভিমত। অর্থাৎ সে লোক শান্ত প্রকৃতির না বদমেজাজী। ওয়েবস্টারের মতে, চরিত্র হচ্ছে মানুষের স্বভাব বা প্রকৃতির বৈশিষ্ট্য যা একজনকে অপর লোক হতে স্বতন্ত্র করে। তাই চরিত্র মানুষের একটি বিশেষ সম্পদ৷
চরিত্র বিষয়ে সাক্ষ্য কখন প্রাসঙ্গিক ও গ্রহণীয়ঃ চরিত্র যদি বিচার্য বিষয় না হয়ে থাকে তবে পক্ষগণের চরিত্র বিষয়ে সাক্ষ্য প্রদান সাধারণত অপ্রাসঙ্গিক। কিন্তু কতিপয় শর্ত সাপেক্ষে পক্ষগণের চরিত্র বিষয়ক সাক্ষ্য প্রাসঙ্গিক হতে পারে । এই শর্তগুলি আবার দেওয়ানী মামলা ও ফৌজদারী মামলায় এক নয়। মামলার পক্ষগণের চরিত্রের প্রাসঙ্গিকতা ও গ্রহণযোগ্যতার বিষয় বর্ণিত রয়েছে- সাক্ষ্য আইনের ৫২ হতে ৫৫ ধারায় এবং সাক্ষীর চরিত্রের প্রাসঙ্গিকতা সম্পর্কে বিধান রয়েছে ১৪৫, ১৪৬, ১৫৩ ও ১৫৫ ধারায়।
দেওয়ানী মামলা প্রসঙ্গে ৫২ ধারায় বলা হয়েছে যে, কোন ব্যক্তির উপর আরোপিত আচরণের সম্ভাব্যতা বা অসম্ভাব্যতা প্রমাণ করার জন্য তার চরিত্র সম্পর্কে সাক্ষ্য প্রদান অপ্রাসঙ্গিক, কেননা আদালতের কাজ হলো মামলার বিচার করা সংশ্লিষ্ট লোকের বিচার করা নয়। এই ধারায় আরো বলা হয়েছে যে, অন্যভাবে প্রাসঙ্গিক ঘটনা হতে চরিত্র সম্পর্কে যতটা জানা যায় ততটা প্রাসঙ্গিক। ৫৫ ধারায় বলা হয়েছে যে, কোন ব্যক্তির চরিত্র যদি এরূপ হয় যে, তার অনুকূলে ক্ষতিপূরণের পরিমাণ নির্ধারণকালে ইহা প্রভাব বিস্তার করবে, তবে তার চরিত্র প্রাসঙ্গিক ঘটনা।
নিম্নোক্ত ক্ষেত্রে বাদীর খারাপ চরিত্র প্রাপ্য ক্ষতিপূরণের পরিমাণকে প্রভাবিত করেঃ
(১) মানহানির জন্য ক্ষতিপূরণের মামলায় বাদীর খারাপ চরিত্র সম্পর্কিত সাক্ষ্য গ্রহণীয়। কিন্তু খারাপ চরিত্র সম্পর্কে ওজর বা সন্দেহের উপর ভিত্তি করে প্রদত্ত সাক্ষ্য গ্রহণীয় নয়৷
(২) বিবাহের প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের মামলায় বিবাদী প্রমাণ করতে পারে যে, বাদী খারাপ চরিত্রের লোক কিংবা নিষ্ঠুর প্রকৃতির লোক।
(৩) অভিযুক্ত ব্যভিচারীর বিরুদ্ধে দাবিকৃত ক্ষতি- পূরণের মামলায় বিবাদী প্রমাণ করতে পারে; বাদী ব্যভিচারী ছিল বা সে লম্পট চরিত্রের লোক ছিল।
আদালতের দায়িত্ব হচ্ছে মামলার বিচার করা, মানুষের নয়ঃ
ফৌজদারী মামলা প্রসঙ্গে ৫৩ ও ৫৪ ধারায় বিধান রয়েছে। ৫৩ ধারা মতে অভিযুক্ত ব্যক্তির চরিত্র ভাল এটা একটা প্রাসঙ্গিক ঘটনা। অবশ্য তথ্যের দ্বারা অপরাধ প্রমাণিত হলে তার ভাল চরিত্র সম্পর্কে সাক্ষ্যের কোন গুরুত্ব থাকবে না। কিন্তু যে অপরাধগুলি সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয় নি, কিংবা যেখানে সন্দেহের অবকাশ রয়েছে সেক্ষেত্রে অভিযুক্ত ব্যক্তির ভাল চরিত্র সম্পর্কিত সাক্ষ্যের বেশ গুরুত্ব থাকে। ভাল চরিত্র প্রাসঙ্গিক হলেও ৫৪ ধারার বিধান মতে আসামীর চরিত্র খারাপ এটা অপ্রাসঙ্গিক। তবে আসামী যদি তার সচ্চরিত্রতা প্রমাণ করার জন্য সাক্ষ্য দেয়, তবে সেক্ষেত্রে তার চরিত্র যে খারাপ তা প্রাসঙ্গিক হয়ে পড়ে এবং খারাপ চরিত্র প্রমাণের জন্য সাক্ষ্য দেয়া যায়।
থমসন বনাম চার্চ (Root, 312) নামক এক আমেরিকান মামলায় আদালত মন্তব্য করেন যে, আদালতের কাজ হচ্ছে মামলার বিচার করা—মানুষের বিচার করা নয়। খুব একটি খারাপ লোকেরও অত্যন্ত ন্যায়সঙ্গত বিবাদের কারণ থাকতে পারে। প্রকৃতপক্ষে মামলায় পক্ষগণের বিরোধের কারণসমূহ বিচার করতে গিয়ে পক্ষসমূহের বা সাক্ষীগণের চরিত্র নিয়ে অযথা টানাটানি শুরু হয়ে যায়। চরিত্র যদি বিচার্য বিষয় না হয় তবে পক্ষগণের চরিত্র সম্পর্কে বক্তব্য রাখা অপ্রাসঙ্গিক। চরিত্র বিচার্য বিষয় হলে দেওয়ানী ও ফৌজদারী উভয় মামলায় ভাল চরিত্র বা খারাপ চরিত্র সম্পর্কে সাক্ষ্য দেয়া যাবে। সাধারণত এ বিধির কতিপয় ব্যতিক্রম রয়েছে।
চরিত্র মানুষের একটা বড় সম্পদ। সাক্ষ্য আইনের ৫৫ ধারার ব্যাখ্যা অনুসারে মানুষের সুনাম ও প্রকৃতির সমন্বয়ে গঠিত হয় তার চরিত্র। সুনাম হচ্ছে তার সম্পর্কে অন্য লোকের ধারণা এবং প্রকৃতি হচ্ছে তার স্বভাব সম্পর্কে অন্য লোকের অভিমত। কোন লোক শান্ত প্রকৃতির না হিংস প্রকৃতির, আমুদে না বদমেজাজী ইত্যাদি মতামত তার প্রকৃতিকে স্পর্শ করে। কিন্তু কোন এক ব্যক্তি বেশ নীতিবান, শিক্ষিত, মার্জিত, সমাজে যথেষ্ট প্রভাব রয়েছে ইত্যাদি ধরনের অভিমত তার সুনামকে স্পর্শ করে।
ওয়েবস্টারের মতে, এই চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের দ্বারা এক ব্যক্তি অপর ব্যক্তি হতে স্বতন্ত্র। কোন এক বিশেষ ঘটনা বা বিক্ষিপ্ত বিষয় নিয়ে একজনের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য জানা যায় না। তার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য জানতে হলে তার সামগ্রিক সুনাম ও প্রকৃতি বিবেচনা করতে হবে।
Leave a comment