থিসিস-অ্যান্টিথিসিস-সিনথিসিস। বাদ-প্রতিবাদ-সমন্বয়। এইভাবেই কূল ভাঙে, কূল গড়ে। এলিজাবেথের যুগের কবিরা ছিলেন রোমান্টিক। জাতীয় জীবনে ও সাহিত্যে সেই নবজাগরণের যুগে স্পেন্সার, শেক্‌সপীয়ার প্রমুখ দিগ্বিজয়ী সাহিত্যিকদের রচনায় আমরা এই রোমান্টিক ভাবনার উৎসার দেখতে পেয়েছি। কিন্তু জাতীয় জীবনে ও কাব্যভাবনায় এই রোমান্টিকতার পথ বেয়ে যে আবিলতা এসেছিল ভোগবিলাস ও সচ্ছলতার স্রোত, তারই প্রতিক্রিয়ারূপে পরবর্তীকালে মিল্টন প্রভৃতির রচনায় দেখা দিল নীতিবাদ ও শুচিবাদ। পরবর্তী পিউরিটান যুগ পূর্ববর্তী যুগেরই যেন প্রতিবাদ। কিন্তু জাতির ইতিহাসের মতো সাহিত্যের ইতিহাস মিল্টনেই থেমে থাকেনি। পিউরিটান যুগের অস্তে দেশে আবার রাজতন্ত্র এসেছে। পিউরিটান যুগের নীতিবাদের অতিশয়তার অনেকটা প্রতিক্রিয়ারূপেই এই রাজতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার যুগ বা রেস্টোরেশনের যুগে (Restoration Age), সমাজজীবনে ভোগবিলাসের ঝোঁক দেখা দিল। সাহিত্যেও পড়ল তার প্রভাব। কিন্তু সেই সঙ্গে সঙ্গে বাস্তবপন্থী চিন্তা, যুক্তিনিষ্ঠতাও এই যুগের সাহিত্যে দেখা যায়।

সপ্তদশ শতাব্দীর দ্বিতীয় অর্ধে সাহিত্যে এই বাস্তববাদী প্রবণতা ও যুক্তিনিষ্ঠতার যে প্রকাশ দেখা গেল, অষ্টাদশ শতকে ক্ল্যাসিক্যাল যুগে সেই ভাবনারই পরিপক্কতা লক্ষ্য করা যায়। এই সঙ্গে বক্তব্যে ভাবাবেগ ও স্বাধীন কল্পনা অপেক্ষা পরিশীলিত বক্তব্য পরিবেশন, আঙ্গিক ও বহিঃসৌষ্ঠবের পরিপাট্য এবং চিরায়ত (classic) নিয়মবন্ধনের প্রতি লেখকদের নজর পড়ে। জ্ঞানচর্চার প্রতি ঝোঁক পড়ে। সাহিত্যের বেশিরভাগ অঙ্গন জুড়ে থাকে গদ্যচর্চা। এইজন্যই এই যুগকে বলা হয় ‘ক্ল্যাসিক্যাল যুগ’ বা ‘অগস্টান যুগ’। এই যুগের বুদ্ধিপ্রধান, যুক্তিবাদী, বিচারশীল লেখকগণ মনের ভাবকে সোজা কথাতেই প্রকাশ করতেন। মতামত প্রকাশ, যুক্তি, তর্ক ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ এ সব যেমন পদ্যের নয়, গদ্যের বিষয়, তেমনি পদ্য যা রচিত হয়েছে, তাও অনেকটা গদ্যের মতোই চিন্তাধর্মী। প্রকৃত কবিতার মতো আবেগধর্মী বা কল্পনাধর্মী নয়। এই যুগের প্রতিনিধিস্থানীয় হচ্ছেন পোপ (Alexander Pope, ১৬৯৮-১৭৪৪খ্রিঃ) এবং জনসন (Samuel Johnson, ১৭০৯-১৭৮৪ খ্রিঃ)।

পুরো অষ্টাদশ শতক বা তার কিছুকাল আগে থেকে সাহিত্যের এই যে পথ চলা, এই চলাকে তাই সমালোচকগণ নদীর সোজা পথে চলার সঙ্গে তুলনা করেছেন। নদীর এই চলার মতোই একালের সাহিত্যিকদের বলা অত্যন্ত স্পষ্ট, ঋজু, সোজা।

কিন্তু নদীর উপরিতলে দৃশ্য বহমান স্রোতের বিপরীতে নদীর গভীরে যেমন অন্তঃস্রোত থাকে তেমনি অগস্টান যুগ বা ক্ল্যাসিক যুগের যুক্তিধর্মী, আবেগবর্জিত সোজা, ঋজু বক্তব্যের অন্তরালেও এই ক্ল্যাসিক যুগের অনেকটা প্রতিক্রিয়ারূপেই আবেগধর্মী, কল্পনাধর্মী রচনার একটা অন্তঃস্রোত ক্রমে স্পষ্ট হয়ে উঠতে আরম্ভ করল। আপন মনের মাধুরী মিশানো রোমান্টিক কাব্যের পূর্বাভাস ধীরে ধীরে স্পষ্ট হতে আরম্ভ করল। উনিশ শতকের রোমান্টিক যুগের পূর্বসুরী কবিরূপে অষ্টাদশ শতকে টমাস গ্রে (Thomas Gray, ১৭১৬-১৭৭১ খ্রিঃ), অলিভার গোল্ডস্মিথ (Oliver Goldsmith, ১৭২৮-১৭৭৪ খ্রিঃ), উইলিয়াম কূপার (William Cowper : ১৭৩১ ১৮০০ খ্রিঃ), রবার্ট বার্নস (Robert Burns, ১৭৫৯-১৭৯৬ খ্রিঃ) এবং উইলিয়াম ব্লেক (William Blake, ১৭৫৭-১৮২৭ খ্রিঃ) উল্লেখ্য।

অষ্টাদশ শতকে রোমান্টিক ভাবনার এই ফল্গুধারাই শতাব্দীর শেষ পাদে বার্নস ও ব্রেকের হাতে ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে উঠতে লাগল এবং শতকের একেবারে অন্তিমে ১৭৯৮ খ্রিস্টাব্দে ওয়ার্ডসওয়ার্থ ও কোলরিজ এই দুই কবির রচিত কবিতাবলী নিয়ে প্রকাশিত ‘লিরিক্যাল ব্যালাড্স’ প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে ইংরেজি সাহিত্যে আবার নতুন অধ্যায় রোমান্টিক যুগ সূচিত হল। ইংরেজি কবিতা অষ্টাদশ শতক জুড়ে নদীর মতো সামনের দিকে সোজা চলতে চলতে হঠাৎ বাঁক ফিরল রোমান্টিকতার দিকে।

রোমান্টিকতার দিকে সাহিত্যপ্রবাহের এই বাঁক ফেরার কারণ যেমন একদিকে পূর্ববর্তী ক্ল্যাসিক্যাল যুগের প্রতিক্রিয়া, তেমনি অপরদিকে রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক চিন্তা ও চেতনার দিক পরিবর্তনের প্রভাব। ইংল্যান্ডের শিল্প বিপ্লবের ফলে নগর জীবন ও নগর সভ্যতার প্রতি ঝোঁক দেশের মানুষকে প্রকৃতির বুক থেকে বিচ্ছিন্ন করে তুলেছিল, সেই সঙ্গে দেশে অপরিমেয় সম্পদ থাকা সত্ত্বেও সম্পদের অসম বণ্টন সাধারণ মানুষের জীবনে অসহ্য দারিদ্র্য ও ক্ষুধা নিয়ে এল। এ ছাড়া ‘প্রকৃতির কোলেই মানুষ হয় সুখী ও সৎ, কৃত্রিম সভ্যতা মানুষকেও কৃত্রিম করে তোলে, দার্শনিক রুশোর এই বক্তব্য দেশের চিন্তাশীল ও ভাবুক তরুণ সমাজকে মূল ধরে নাড়া দিল। ১৭৮৩ খ্রিস্টাব্দের আমেরিকার স্বাধীনতা লাভ মানব স্বাধীনতার আদর্শকেই তুলে ধরল। এর পরে এল অষ্টাদশ শতকের শেষ দশকে ফরাসি বিপ্লব। ফরাসি বিপ্লবের সাম্য, মৈত্রী ও স্বাধীনতার বাণী ইংলিশ চ্যানেল পেরিয়ে ইংল্যান্ডের বুকে প্রচণ্ড বেগে আছড়ে পড়ল। এই সাময়িক ঘটনাবর্তের সামগ্রিক ফলশ্রুতিই হচ্ছে ইংল্যান্ডের সামাজিক মানুষের ভাবনার দিক পরিবর্তন। অষ্টাদশ শতকের শেষদিকে প্রকাশিত ‘লিরিক্যাল ব্যালাড্স’ এবং উনিশ শতকের প্রথম পাদ বা সাধারণভাবে উনিশ শতকের প্রথমার্ধের রোমান্টিক কবিকুল রচিত রোমান্টিক সাহিত্য সেই সমাজভাবনারই প্রতিফলন।

এই রোমান্টিক ভাবান্দোলনের নানান দিক। এর এক এক দিকে লক্ষ্য করে সমালোচকগণ এই যুগের একটা নাম দিয়েছেন। কারও মতে এটা রোমান্টিক বিদ্রোহ (Romantic Revival)। এই বিদ্রোহ গতানুগতিক ও প্রথাসর্বস্ব জীবন ও সাহিত্যের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ, এ বিদ্রোহ এতদিন চলে আসা শুষ্ক যুক্তিবাদ ও হিসেবী বুদ্ধির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ। পোপ, ড্রাইডেন, জনসন-কর্ষিত সাহিত্যের বিষয় রীতির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ।

সাধারণভাবে এই যুগের লক্ষণ এবং বিশেষভাবে ‘লিরিক্যাল ব্যালাড্স’-এ প্রকাশিত কাব্য লক্ষণের কথা বলতে গিয়ে বলা হয় যে এই কবি-যুগল ওয়ার্ডওয়ার্থ এবং কোলরিজ অষ্টাদশ শতকের ক্লাসিক কবিদের পথ থেকে সরে এসে প্রকৃতি ও মানুষের দিকে ফিরে তাকালেন। এ হল ‘প্রকৃতিতে প্রত্যাবর্তন’ (Return to Nature), শুধু তাই নয়, এদের মধ্য দিয়ে ঘটল বিস্ময় রহস্যের পুনর্জন্ম (Renaissance of Wonder and Mystery)। ওয়ার্ডস্ওয়ার্থের কবিতায় নিত্যপরিচিত জগৎ নতুন আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে কবির বিস্ময়-বিমুগ্ধ দৃষ্টিতে ধরা পড়েছিল। ফলে সাধারণ প্রকৃতি ও সাধারণ মানুষের অন্তর্জগতে প্রবেশ করে এক অজানিত বোধ আবিষ্কারের বিস্ময় ওয়ার্ডসওয়ার্থের কবিতাকে নতুন ব্যঞ্জনা দিয়েছে। কোলরিজের মধ্যে ঘটেছে অবশ্য রহস্যে পুনর্জাগরণ। কোলরিজ লিখেছিলেন অলৌকিক রহস্যের কবিতা। ক্ল্যাসিক্যাল যুগের কবিদের রচনায় ছিল শৃঙ্খলা, সৌষ্ঠব, স্পষ্টতা এবং যথাযথতা, কিন্তু যে গুণে একটা কবিতা সত্যকার কবিতা হয়ে ওঠে সেই প্রেরণা ও কল্পনা ছিল না। যুগ লক্ষণের দিক দিয়ে পূর্ববর্তী কবিদের সঙ্গে রোমান্টিক যুগের কবিদের এইখানেই মৌল পার্থক্য। এ ছাড়া এই যুগের কবিদের মধ্যে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য বা ব্যক্তিমনের বিভিন্নমুখী প্রকাশ এই রোমান্টিক কবিদের একটা বড়ো বৈশিষ্ট্য। এর ফলে একই গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত হয়েও ওয়ার্ডওয়ার্থ, শেলী, কীটস্ প্রমুখ কবিরা আপন আপন মানসিকতা অনুযায়ী ভিন্ন ভিন্ন ঘরানার সৃষ্টি করেছেন। অবশ্য অনুপুঙক্ষরূপে দেখলে এই রোমান্টিক যুগের কবিদের মধ্যে ভিন্নতা থাকলেও সামগ্রিক বা সাময়িক বিচারে এঁরা একই গোষ্ঠীভুক্ত কবি, সে গোষ্ঠী হচ্ছে রোমাণ্টিক কবিগোষ্ঠী। ধ্যান, ধারণা ও ভাবনায়, মন ও মননে এই কবিগোষ্ঠী তাঁদের পূর্বযুগের ক্ল্যাসিক্যাল বা অগস্টান যুগ থেকে পৃথক এবং এই নতুন যুগের সোচ্চার সূচনা ওয়ার্ডওয়ার্থ ও কোলরিজ এই কবিবন্ধুদ্বয়ের প্রকাশিত ‘লিরিক্যাল ব্যালাডস্’ থেকেই আমরা দেখতে পেলাম। তাই বলা যায়, অষ্টাদশ শতকের মধ্যভাগ থেকে ইংরেজি সাহিত্যে রোমান্টিক ভাবনায় অতি মৃদু টান অনুভব করলেও ভোরের আগে ব্রাত্ম মুহূর্ত সংকেতিত হলেও প্রকৃতপক্ষে ওয়ার্ডওয়ার্থ ও কোলরিজের যুগ্ম সৃষ্টি প্রকাশিত ‘লিরিক্যাল ব্যালাডস্’ কবিতা গ্রন্থই নতুন যুগের প্রভাতকে ঘোষণা করল।