সুকান্ত ভট্টাচার্যের ‘বোধন’ কবিতাটি নিছক ১৩৫০-এর “মহামন্বস্তরের দুর্গতির চিত্র নয়, কবিতাটিতে আসলে উচ্চারিত হয়েছে দুর্গত কালের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের উজ্জীবন মন্ত্র।” কবিতার নামকরণেও এই সদর্থক সংগ্রামী জীবনভাবনার প্রতিফলন ঘটেছে। উদ্ধৃত পক্তিগুলিতে কালচৈতন্যের কাছে সেই সংগ্রামী শক্তি ও সংহতিশক্তিই প্রার্থনা করেছেন কবি।
‘বোধন’ কবিতার পটভূমিতে রয়েছে পঞ্চাশের মন্বন্তরের পরিপার্শ। ১৯৪৩ তথা ১৩৫০-এর বাংলায় যে মহামন্বস্তর কালরাত্রির মতো নেমে এসেছিল, সেই ভয়ংকর দুর্ভিক্ষে প্রাণ গিয়েছিল লক্ষ লক্ষ দরিদ্র কৃষিজীবী মানুষের। ঔপনিবেশিক সরকারের তোষণকারী ইতিহাসকার ও সংখ্যাতত্ত্ববিদেরা দেখাতে চেয়েছিলেন এই দুর্ভিক্ষ প্রকৃতিসৃষ্ট। কিন্তু যথার্থ বিচারে প্রমাণিত হয়েছে, যে এই দুর্ভিক্ষ আসলে মানুষেরই সৃষ্টি।
প্রথমত, ভারতের ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ শাসক চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের কাল থেকেই ভারতের সমাজ ও সভ্যতার প্রাণশক্তি কৃষি অর্থনীতিকে ক্রমে ক্রমে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিয়েছিল। কিন্তু সে অর্থে যথার্থভাবে এদেশে শিল্পের বিকাশ ঘটানো হয় নি। ফলে কার্যত ভারতবর্ষ এক ভিত্তিহীন আধুনিকতার প্রবেশ করলেও তার প্রাণকেন্দ্র গ্রাম ও কৃষিজীবী সমাজ মরণাপন্ন হয়ে পড়েছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় প্রবল আর্থিক ঘাটতি তাই কৃষি অর্থনীতি ও দেশের দরিদ্র কৃষিজীবীদের প্রাণধরনের ন্যূনতম সম্বলটুকুও কেড়ে নিয়েছিল। তার ওপর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় সৈন্যদের জন্য প্রচুর পরিমাণে খাদ্যশস্য মজুত করতে শুরু করে ভারতের ব্রিটিশ সরকার। ফলে স্বাভাবিকভাবেই খাদ্যভাণ্ডারে টান পড়ে। এর ওপর ১৯৪২-এ জাপানের আক্রমণে বার্মার পতন ঘটলে বার্মা থেকে চালের আমদানিও বন্ধ হয়ে যায়। অতএব আন্তর্জাতিক যুদ্ধ ও শাসক ইংরেজের সাম্রাজ্যবাদী নীতিই এই প্রবল খাদ্যাভাবের কারণ হয়ে ওঠে।
দ্বিতীয়ত, যুদ্ধের সময় ব্যতিব্যস্ত ব্রিটিশ প্রশাসনও দেশের নিয়মশৃঙ্খলা ও বিচার ব্যাপারে যথেষ্ট মাত্রায় শিথিল হয়ে যায়। এই প্রশাসনিক শৈথিল্যের কারণে সুযোগসন্ধানী মুনাফাবাজ, কালোবাজারী, মহাজন, মজুতদাররা অবৈধ কারবারে অতিমাত্রায় সক্রিয় হয়ে ওঠে। মাত্রাতিরিক্ত মুনাফার লোভে খাদ্য ঘাটতির সময়েই মজুতদার কালোবাজারীরা সাধারণের ক্ষুধার অন্ন অন্যায়ভাবে গোপনভাণ্ডারে মজুত করে এক কৃত্রিম অভাব সৃষ্টি করে।
এমতাবস্থায় গ্রামের কৃষিজীবী মানুষ তাদের হাল-বলদ জমি-ভিটে সমস্ত হারিয়ে নিঃস্ব-নিরন্ন হয়ে গঞ্জে-শহরে এসে ভিড় করে। একমুঠো ভাত বা এক আঁজলা ফ্যানের জন্য তাদের আর্ত কান্নায়, কঙ্কালসার মানুষের মিছিলে, অনাহারক্লিষ্ট মানুষের আর্তনাদে, লক্ষ লক্ষ মৃতদেহে ভরে উঠতে থাকে শহরের পথ-ঘাট।
১৩৫০-এর দুর্ভিক্ষ তাই যেন এক মৃত্যুর সংকেত বহন করে আনল। এই সমূহ বিপর্যয়, এই লক্ষ মানুষের মৃত্যুর জন্য কবি দায়ী করেছেন তাই শাসক ও শোষকের অমানবিক লোভবৃত্তিকেই। আলোচ্য কবিতায় প্রতিরোধহীন অসহায়তায় বিপর্যয় ও মৃত্যুকে স্বীকার করে নিতে চাননি কবি সুকান্ত। তিনি যুগচৈতন্যের কাছে প্রার্থনা করেছেন দুর্গত মানুষের সংহতি ও অন্যায়কারীর বিরুদ্ধে হিংস্র সংগ্রামী শক্তি। যুগ যুগ ধরে যে অন্যায়। ও শোষণ ক্লিষ্ট করেছে সাধারণ-দরিদ্র মানুষদের। ধূর্ত প্রবঞ্চনায় এতকাল যাদের মুখের অন্ন চুরি করে গুপ্ত কক্ষে জমিয়ে যারা স্বর্ণমুদ্রার পাহাড় বানিয়েছে, তাদের বিরুদ্ধে কবি তাঁর ক্রোধকে গোপন করেন নি এতটুকু। মানবতার বিরুদ্ধে এই ক্ষমাহীন পাপের উপযুক্ত শাস্তিবিধানের জন্য তিনি উদ্বুদ্ধ করেছেন দুর্গতদের। সে শাস্তি নির্মম, নিষ্ঠুর। স্বজন হারানো শ্মশানে’ তাদের চিতা রচনা কিংবা ‘ফসল ফলানো মাটিতে রোপন’ করেই সেই পাপের শাস্তিবিধান সম্ভব।
কিন্তু এজন্য চাই দুর্গত শোষিত মানুষের মধ্যে ঐক্যশক্তি। চাই নিজেদের জীবন ও অধিকারের প্রতি আস্থা এবং জনশক্তির প্রচণ্ডতায় বিশ্বাস। মানবতার অর্থ কেবল প্রেম-প্রীতি-করুণা-ক্ষমার মতো সুকুমার বৃত্তিসমূহ নয়। বিরুদ্ধ শক্তির বিরুদ্ধে সংগ্রামও মানবতার এক বৈশিষ্ট্য। অর্থাৎ শুধু কোমলতা নয়, কঠোরতাও এক মানবতার শক্তি। তাই ‘শাসক’ এবং ‘শোষক’—যারা ১৩৫০-এর ভয়ংকর বিপর্যয়ের, চক্রান্তকারী, যারা ‘লক্ষ লক্ষ প্রাণের দাম’-এ মুনাফা অর্জনকারী, যারা মানুষের ক্ষুধার অন্ন লুণ্ঠনকারী তাদের বিরুদ্ধে যুগ-যুগ সঙ্খিত ক্ষোভকে বৈপ্লবিক হিংস্র ক্লোধে রুপান্তরিত করার শক্তি প্রার্থনা করেন কবি চৈতন্যের কাছে। সেই শক্তি দুর্দমনীয়। শীতরাত্রির জড়তা ও কুঁকড়ে থাকা শৈত্যের নিশ্চেষ্টতা ভেঙে ‘শীতের শেষের তুষার গলানো উত্তাপ’-এ দুর্গত জনতাকে উদ্বোধিত করার উজ্জীবন মন্ত্র প্রার্থনা করেছেন কবি। জন্মান্তরবাদ, ভাগ্যনির্ভর, দৈবনির্ভরতা, আনুগত্য ইত্যাদিসূত্রে যে দুর্বলতা ও ক্লীবতা এযাবৎ সজ্জিত হয়েছে, সেই ক্লীবতা ভীরুতার কাহিনিকে মিথ্যা প্রমাণ করে জনশক্তিকে হয়ে উঠতে হবে সংঘবদ্ধ বিপ্লবশক্তি।
এই বিপ্লবশক্তির মূল কথা সংহতি বা ঐক্যচেতনা। যুগে যুগে শোষিত, তাদের কোনো জাত নেই। তাদের একমাত্র পরিচয়, তারা শোষিত। তাই শোষিত মানুষ সংঘবদ্ধ না হলে ‘ধূর্ত প্রবঞ্জক’ শাসক ও শোষকদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম অসম্ভব। অথচ নিজেদের স্বার্থেই শাসক ও শোষক যুগে যুগে নিজেদের ঐক্যবদ্ধ রেখে উদ্দেশ্যসাধন করে চলেছে। তাদের সে ঐক্যের উদ্দেশ্য শাসন, শোষণ, প্রবঞ্চনা ও স্বার্থসিদ্ধি। শোষক ও শাসকের সেই অমানবিক নিষ্ঠুর একতার বিরুদ্ধে শ্রমজীবী-কৃষিজীবী শোষিত-দুর্গত-সর্বহারারা ঐক্যবদ্ধ হয়ে সংগ্রামমুখর হয়ে ওঠার শক্তি ও সামর্থ্য অর্জন করুক, এটাই কবির একান্ত প্রার্থনা।
Leave a comment