প্রশ্নঃ হেগেলের বস্তুগত ভাববাদ ব্যাখ্যা কর।

অথবা, ভাববাদের আলােকে হেগেলের বস্তুগত ভাববাদ ব্যাখ্যা ও মূল্যায়ন কর।

অথবা, যা বৌদ্ধিক তাই বাস্তব, যা বাস্তব তাই বৌদ্ধিক- আলােচনা কর।

ভূমিকাঃ ভাববাদের যে চর্চা শুরু হয়েছিল প্লেটোর লেখনীতে, সেই শিশুবৃক্ষটি মহীরূহ হয় দাঁড়িয়েছে বার্কলে, স্পিনােজা, লাইবনিজ এবং কান্টের রচনায়। তারা ভাববাদকে এমন একটা তুরীয় অবস্থানে নিয়ে গেছেন, যেখান থেকে দৃশ্যমান ইন্দ্রিয় জগতের দূরত্ব অনেক। হেগেলই প্রথম ভাববাদী দার্শনিক যিনি এই দূরত্বকে কমিয়ে আনতে চেয়েছেন। তার এই সমন্বিত মতবাদ দর্শনের ইতিহাসে শ্রেষ্ঠ ভাববাদী মতবাদ হিসেবে গণ্য হয়েছে।

ভাববাদ (Idealism): ভাববাদের ইংরেজি প্রতিশব্দ Idealism. এই Idealism শব্দটি এসেছে Idea (ধারণা) থেকে। ভাববাদ শব্দটি বিভিন্ন অর্থে ব্যবহৃত হয়ে থাকলেও দর্শনের ইতিহাসের ন্যায় ভাববাদের ইতিহাস সুদীর্ঘ এবং বিভিন্ন সময়ে এর ব্যবহারও হয়েছে বিচিত্র অর্থে। কিন্তু দর্শনে ভাববাদ বলতে এমন একটি মতবাদকে বুঝায়, যে মতবাদ মনে করে সত্তা হলাে আধ্যাত্মিক। আদি সত্তা বা উপাদান হচ্ছে ভাব বা তার প্রকৃতি আধ্যাত্মিক। ভাববাদ অনুসারে “Mind is real and matter just an appearance.” অর্থাৎ “Reality is thoughts ideas of self or mind.” এক কথায়, Reality is Spiritual. দার্শনিক মতবাদে ভাব বা ধারণা বা আত্মাকে একমাত্র প্রকৃত সত্তা এবং বিশ্বজগতের মূল উপাদান বা সত্তা মানসিক বা আধ্যাত্মিক বলে মনে করা হয়, তাকে বলা হয় ভাববাদ।” এই মতবাদ অনুসারে বাহ্যবস্তু প্রকৃত সত্তা নয়, ভাবের প্রতিচ্ছবি মাত্র।

হেগেলের বস্তুগত ভাববাদঃ বস্তুবাদ ও ভাববাদের সুদীর্ঘ বিরােধ হেগেলের মতবাদে একটা নিষ্পত্তির দিকে অগ্রসর হয়। তিনি তার বস্তুগত ভাববাদে বস্তুবাদ ও ভাববাদের, একটা সমন্বয় সাধন করেন। প্রথম ভাববাদী দার্শনিক হিসেবে তিনি উচ্চারণ করেন, বস্তুজগৎ পরম সত্তারই প্রকাশ। তার মতবাদকে এজন্য বস্তুগত ভাববাদ বলা হয়। আর জগতের বাস্তব সত্তাকে তিনি অস্বীকার করেননি। এই স্বীকৃতির বিভিন্ন পর্বে তিনি পূর্ববর্তী ভাববাদী মতগুলাে খণ্ডন করেন।

বাকলির মত খণ্ডনঃ বার্কলে তার আত্মগত ভাববাদে বস্তুজগতের স্বতন্ত্র অস্তিত্ব অস্বীকার করে বলেন, সবকিছুই মনের ধারণা। হেগেল তার সমালােচনা করে বলেন, মন ও বাহ্যবস্তু উভয়ই পরমাত্মার প্রকাশ। তারা একই পরমাত্মায় প্রকাশ বলে মন বাহ্যবস্তু সম্পর্কে জানতে পারে। সুতরাং বিষয় হিসেবে বহির্জগতের অস্তিত্বকে অস্বীকার করা যায় না।

কান্টের মত খণ্ডনঃ কান্ট দৃশ্যমান জগৎ থেকে আলাদা একটা অতীন্দ্রিয় জগতের কথা বলেন। তার মতে, অতীন্দ্রিয় অগতকে জানা সম্ভব নয়। কারণ দৃশ্যমান জগতের জ্ঞানের আকারসমূহ অতীন্দ্রিয় সত্তার ক্ষেত্রে প্রাপ্য নয়। হেগেল কান্টের এই দ্বৈতবাদকে অস্বীকার করে বলেন, দৃশ্যমান জগতই আসল জগৎ, জীবাত্মা ও জড়বস্তু সবকিছুই পরম সত্তার প্রকাশ। এদের মাধ্যমে ধীরে ধীরে প্রকাশিত হওয়াই পরম সত্তার লক্ষ্য। কাজেই এই জগৎ মরীচিকা নয় এবং মন বাহ্যবস্তুকে জানতে পারে।

পরম সত্তার স্বরূপঃ হেগেলের মতে, পরমসত্তা সর্বব্যাপী আধ্যাত্মিক শক্তি, জীবাত্মা বা মন তারই খণ্ড প্রকাশ। বিচিত্ররূপে তিনি এই জগতে নিজেকে প্রকাশ করে চলেছেন। এ প্রসঙ্গে বিশিষ্ট লেখক প্যাট্রিক বলেন, যাকে আমরা প্রকৃতি বলি- তা পরম চিন্তনেরই প্রকাশ। আর পরম কারণ এভাবেই নিজেকে প্রকাশ করে চলেছেন। এই পরম চিন্তনশক্তি একাধারে তাতা ও জ্ঞেয়। তার সীমাহীন সত্তাকে তিনি সসীম বস্তসমহের মধ্য দিয়ে ধীরে ধীরে জানেন। সসীম জগতে বসবাস করে ঐ অসীমের সুরটি ধরতে পেরেছিলেন আরও একজন- তিনি হলেন বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তার একটি কবিতায় আছে

“সীমার মাঝে অসীম তুমি বাজাও আপন সুর,

আমার মাঝে তােমার প্রকাশ তাই এত মধুর।”

সুতরাং হেগেলের পরম সত্তা স্পিনােজার দ্রব্যের মতাে নয়, কিংবা শেথিং-এর অভেদ্য সত্তার মতােও নয়। হেগেলের পরম সত্তা সক্রিয় ও গতিশীল।

পরম সত্তার প্রকাশভঙ্গিঃ হেগেলের মতে, পরমসত্তার প্রকাশের প্রক্রিয়াটি দ্বান্দ্বিক। বাদ-প্রতিবাদ-সমন্বয়ের মাধ্যমে দ্বান্দ্বিক গতি সম্ভব হয়। মানুষ সর্বাত্মক ধারণা থেকে নঞর্থক ধারণার পৌঁছে এবং পরে উভয়ের সমন্বয় সাধন করে। এই সমন্বিত রূপটি পরবর্তী কোনাে বিষয়ের ক্ষেত্রে সদর্থক ধারণা বলে গণ্য হয়। এভাবে দ্বান্দ্বিক প্রক্রিয়া চালু থাকে। এই প্রক্রিয়ার অন্তিম স্তরটি হলাে পরমসত্তায় প্রকাশের স্তর। বিশুদ্ধ চিন্তা- সেখানে সদর্থক ধারণা জগৎ বা প্রকৃতি হচ্ছে নঞর্থক ধারণা আর সমন্বিত চেহারাটিই আত্মা। পরমসত্তায় উপনীত হলেই এই সর্বব্যাপী দ্বান্দ্বিক প্রক্রিয়ার অবসান ঘটবে।

যা বৌদ্ধিক তাই বাস্তব যা বাস্তব, তাই বৌদ্ধিকঃ হেগেলের মতে, বুদ্ধির নিয়মটিও দ্বান্দ্বিক। বুদ্ধি ও সত্তা এক ও অভিন্ন। তাই ব্যক্তির নিকট জগৎ ও তার বিকাশ বুদ্ধিগ্রাহ্য। প্রকৃতির নিয়মানুবর্তিতা, শৃঙ্খলা, সংহতি প্রভৃতি বুদ্ধির অস্তিত্ব প্রমাণ করে। কান্ট জ্ঞানের ক্ষেত্রে যে বারােটি ক্যাটাগরির কথা বলেন, হেগেলের মতে এগুলাে শুধু আত্মগতই নয়, বস্তুগতও। এভাবেই হেগেল ঘােষণা করেন, “Whatever is rational is real whatever is real is national” বা যা বৌদ্ধিক তাই বাস্তব, যা বাস্তব তাই বৌদ্ধিক। অর্থাৎ পরমসত্তাকে ইন্দ্রিয় বা মরমী কোনাে প্রকার অভিজ্ঞতার মাধ্যমেই জানা সম্ভব নয়। একমাত্র বুদ্ধিই তার স্বরূপ উম্মােচন করতে সক্ষম। জগতে বুদ্ধিরই রাজত্ব।

সমালােচনাঃ দার্শনিক মতবাদ হিসেবে কোনাে মতবাদই সমালােচনার ঊর্ধ্বে নয়। তাই অন্যান্য মতবাদের ন্যায় হেগেলের বস্তুগত ভাববাদও সমালােচনার সম্মুখীন হন। নিম্নে সে সমালােচনাগুলাে তুলে ধরা হলাে-

প্রথমত, স্বজ্ঞা কিংবা অনুভবের ক্ষমতাকে ছােট করে দেখাঃ হেগেলের বস্তুগত ভাববাদ বুদ্ধিসর্বস্ব। এই মতবাদে বুদ্ধি বা প্রজ্ঞার উপর অত্যধিক গুরুত্ব আরােপ করা হয়। আমাদের জীবনের অনুভবের ভূমিকা সম্পর্কে হেগেল কিছুই বলেন না। কিন্তু মানব জীবনে কিংবা বিকাশের উচ্চতর পর্যায়ে বুদ্ধির সীমাবদ্ধতা পরিলক্ষিত হয়। স্বজ্ঞা কিংবা অনুভব ক্ষমতাকে গুরুত্ব না দেয়ায় বস্তুগত ভাববাদ সর্ববুদ্ধিবাদে পরিণত হয়েছে।

দ্বিতীয়ত, যুক্তিপূর্ণ উপস্থাপন হয়নিঃ হেগেলের মতে বুদ্ধি বা চিন্তা নিজেকে প্রকাশ করে। কিন্তু কীভাবে? এ বিষয় তিনি যুক্তিপূর্ণভাবে বক্তব্য উপস্থাপন করেননি।

তৃতীয়ত, বাট্রান্ড রাসেলের সমালােচনাঃ একটি বৌদ্ধিক প্রক্রিয়ার উধ্বগামিতার মাধ্যমে যে পরম সত্তার প্রকাশের কথা হেগেল বলেছেন, সেই সত্তাটি যেন বুদ্ধির নিগড়ে বাধা। বাট্রান্ড রাসেল তাই ঠাট্টা করে হেগেলের পরম সত্তাকে (Professor’s God) বা অধ্যাপকের ঈশ্বর আখ্যায়িত করেন।

পরিশেষঃ পরিশেষে বলা যায় যে, নানাবিধ ত্রুটি সত্ত্বেও হেগেলের বস্তুগত ভাববাদ সুসংহত, সুসামঞ্জস্য এবং ব্যাপক। আমরা দেখি যে, আধুনিক দর্শনের জনক ডেকার্ট দর্শনের ক্ষেত্রে যে যুগান্তকারী আলােচনা করে গােড়াপত্তন করে, আর হেগেলের সাথেই-সেই ধারাটির অবসান ঘটে। সুতরাং সার্বিক আলােচনার প্রেক্ষাপটে হেগেলের বস্তুগত ভাববাদকে কোনােক্রমেই ছােট করে দেখা যায় না। অন্তত অস্তিত্ববাদ, নব্য বাস্তববাদ, স্বজ্ঞাবাদ, দুঃখবাদ কিংবা মার্কসবাদ ইত্যাদি মতবাদগুলাের জন্য আমরা কোনাে না কোনােভাবে হেগেলের কাছে ঋণী।