প্রশ্নঃ হেগেলের দ্বান্দ্বিক পদ্ধতির বিশেষ উল্লেখপূর্বক তার ভাববাদ ব্যাখ্যা কর।

অথবা, হেগেলের দ্বান্দ্বিক পদ্ধতির বিশেষ উল্লেখপূর্বক তার ভাববাদ বর্ণনা কর।

ভূমিকাঃ জার্মান ভাববাদী দর্শনের মধ্যে হেগেলের দর্শন বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। দর্শনের ইতিহাসের একটি বিশাল আলােচনা হলাে হেগেলের দর্শন। কারণ তিনি দর্শনের ইতিহাসের সম্পূর্ণ ভাবমূর্তি পাল্টে দিয়েছেন। হেগেলের দর্শনের ভিত্তি হলাে দ্বন্দ্ববাদ। তার দর্শনের মূল কথা হচ্ছে, যা বাস্তব, তাই যৌক্তিক।

হেগেলের দ্বান্দ্বিক পদ্ধতিঃ “Dialectic” শব্দটি উদ্ভূত হয়েছে ইংরেজি “Dialogue” থেকে। “Dialogue” শব্দটির বাংলা অর্থ সংলাপ বা দু’টি লােকের কথপােকথােন। Dialectic কথাটির অর্থ দুটি বিষয়ের মাধ্যমে আলােচনা চালালে একে বাংলায় দ্বান্দ্বিক। পদ্ধতি বলা হয়েছে। দ্বন্দু মানে বিরােধ, একই বিষয় সম্পর্কে দুটি পরস্পর বিরােধী মতবাদের উদ্ভব হলেই এ বিরােধ দেখা দেয়। দ্বান্দ্বিক পদ্ধতির উদ্দেশ্য এই বিরােধের মাধ্যমে অগ্রসর হয়েই সত্য নিরুপণ করা। হেগেলের দ্বান্দ্বিক পদ্ধতি জ্ঞানের বিরােধিতা নির্দেশ করে। উন্নততর ও ব্যাপকতর জ্ঞানে উন্নিত হতে চায়। তার দ্বান্দ্বিক পদ্ধতির দু’টি রূপ আছে। যথাঃ ১. নঞর্থক দ্বান্দ্বিক পদ্ধতি ও ২। সদর্থক দ্বান্দ্বিক পদ্ধতি।

(১) নঞর্থক দ্বান্দ্রিক পদ্ধতিঃ গ্রীক দার্শনিক সক্রেটিস এবং জার্মান দার্শনিক কান্ট এ পদ্ধতির অনুসরণ করেন। এ পদ্ধতি হলাে বিশেষ করে প্রতিপক্ষের মত অসার বা মিথ্যা প্রমাণ করার পদ্ধতি। এ পদ্ধতির উদ্দেশ্য হলাে অপরের মতের মধ্যে যে অসংগতি আছে তা নিরুপণ করা বা প্রতিপক্ষের মতকে স্ববিরােধ প্রমাণ করে তাকে ধ্বংস করা।

(২) সদর্থক দ্বান্দ্বিক পদ্ধতিঃ সদর্থক দ্বান্দ্বিক পদ্ধতির প্রবর্তন করেন জার্মান দার্শনিক হেগেল। বলাবাহুল্য কান্টের চিন্তায় এ পদ্ধতির ইঙ্গিত পাওয়া যায়। ফিকটে এবং শেলিং ও এর ব্যবহার করেছেন। হেগেল এ পদ্ধতির তিনটি ধাপ চিহ্নিত করেছেন। এর শুরুতেই থাকে এমন একটি বিমূর্ত সঠিক প্রত্যয়, যাকে বলা হয় thesis। এই প্রত্যয় থেকে সৃষ্টি হয় এমন একটি স্ববিরােধ, যাকে বলা হয় প্রতিনয় বা Antithesis. এই দুটি সম্প্রত্যয়ের সমন্বয়ে ঘটে এক উচ্চতর তৃতীয় সম্প্রত্যয় যাকে বলা হয় সমন্বয় Synthesis। এ পদ্ধতিকে বিশ্লেষণ এবং গঠনমূলক মনে করা হয় এই কারণে যে, এ পদ্ধতি মূলত মিলনাত্মক। সমন্বয়সাধনই এ পদ্ধতির বৈশিষ্ট্য নয় এবং প্রতিনয়ের সমন্বয় হিসেবে যে নতুন ধারণার উদ্ভব ঘটে তা থেকে আবার শুরু হয় নতুন বিরােধের। এ বিরােধের আবার সমন্বয় ঘটে এর চেয়েও উচ্চতর এক নতুন সম্প্রত্যয়ে এভাবে দ্বান্দ্বিক প্রক্রিয়া বাস্তব সত্তার সম্প্রত্যয়ের লক্ষ্যে অগ্রসর হয়। যাতে সব বিরােধের সমন্বয় ও সমাধান নিহিত।

মানুষের জ্ঞান দ্বান্দ্বিক পদ্ধতিতে অগ্রসর হয়ঃ নয়, প্রতিনয় এবং সমন্বয়ের সমবায়ে গঠিত হেগেলিয় দ্বান্দ্বিকতা সম্পূর্ণরূপে বস্তুনিষ্ঠ। হেগেল দেখলেন যে, মানুষের চিন্তার বা জ্ঞানের গতি ও পরিণতি দ্বান্দ্বিক পদ্ধতিতে অগ্রসর হয়। হেগেলের মতে, জীবাত্মার চেতনায় যে জ্ঞান বা অভিজ্ঞতার প্রকাশ তা আংশিক বা অসম্পূর্ণ। কিন্তু আংশিক বা অসম্পূর্ণ জ্ঞানের অগ্রগতি নির্ধারিত হয় সমগ্র জ্ঞানের বা অভিজ্ঞতার দ্বারা, যা প্রতিটি আংশিক জ্ঞানের মধ্যে সম্ভাবনারূপে প্রথম থেকেই বিরাজ করে। কোনাে খণ্ড অভিজ্ঞতা অখণ্ড অভিজ্ঞতাকে পরিপূর্ণভাবে সর্বত্রভাবে প্রকাশ করতে পারে না। সে কারণেই মানুষের জ্ঞান বা অভিজ্ঞতা দ্বান্দ্বিক পদ্ধতিতে অগ্রসর হয়।

দ্বন্দ মানে বিরােধ নয়ঃ দ্বন্দ্ব কথাটির মানেই কিন্তু বিরােধ নয়। প্রথমে বিরােধ,তারপর ঐক্য বা মিলন। যেকোনাে একটি বিষয় সম্পর্কে যথার্থ ধারণা তার বিরােধী ধারণার সম্বন্ধের পরিপ্রেক্ষিতেই উপলব্ধি হয়। যেমনঃ জড়বস্তু সম্পর্কে ধারণা যে বস্তু জড় নয়, তার সঙ্গে তুলনা করে দেখতে হয়। কিন্তু জড় এবং অজড়ের পার্থক্যের বিরােধিতা স্বীকার করে নিয়েই মন পরিতৃপ্ত হয় না। মন চায় উভয়ের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করে যে বিরােধতাকে স্বীকার করে উভয়কে এক উচ্চতরতার মধ্যে ঐক্য বা সমন্বয়সাধন করতে। সে ধারণা হলাে যে, জড় এবং অজড় উভয়ই দ্রব্য। আবার দ্রব্যের বিপরীত ধারণা হলাে যা দ্ৰব্য নয় এবং দ্রব্য দ্রব্য উভয়কেই এক উচ্চতর ধারণায় অন্তর্ভুক্ত করা হয় যা হলাে সত্তা।

বিরােধ এবং অসংগতির মধ্যে ঐক্যসাধনঃ হেগেল দেখলেন যে, দ্বান্দ্বিক পদ্ধতির মাধ্যমে সদর্থক ধারণা। যেমনঃ জড়, তারপর তার বিরুদ্ধে নঞর্থক ধারণা যেমনঃ অজড় এবং তৃতীয় ধারণা হলাে সমন্বয় যেমনঃ দ্রব্য। সমন্বয় আবার একটি সদর্থককে ধারণারূপে গ্রহণ করে। তার বিরােধী ধারণার সন্ধান করে এবং আরাে ব্যাপকতর কোনাে ধারণায় এদের সমন্বয় হয়। এভাবে দ্বান্দ্বিক পদ্ধতি পরম সমন্বয়ে এসে পৌছায়। যা সব বিরােধ এবং অসংগতির মধ্যে ঐক্য সাধন করে। দ্বান্দ্বিক পদ্ধতির মাধ্যমে পরমসত্তা নিজেকে প্রকাশ করে। জীবাত্মার পদ্ধতি ও দ্বান্দ্বিক পদ্ধতির মধ্যে দাকি পদ্ধতিই অগ্রগতির কারণ। শুধু দ্বন্দ্ব বা বিরােধ থাকলে জগত অচল হয়ে পড়ত।

দ্বান্দ্বিক পদ্ধতি গতিশীলঃ দ্বান্দ্বিক পদ্ধতি বলতে, হেগেল যা বুঝেছেন তা আসলে এমন একটি প্রক্রিয়া, যা গতিশীল, সজীব ও আঙ্গিক অস্তিত্বের নির্দেশক। এটি এমন একটি প্রক্রিয়া যেখানে যাবতীয় বিরােধ অনৈক্যের মীমাংসা ও সমন্বয় হয়ে থাকে। আমরা যাকে সত্তা বলি হেগেলের মতে তা চিশ্চল নয় বরং প্রবহমান। এজন্য সত্তাকে প্রাণ ও চেতন সদৃশ বলা চলে। সত্তা একটি প্রাজ্ঞিক প্রক্রিয়া, আর একটি অর্থ আছে এবং যাকে চিন্তা বলে অভিহিত করা যায়। একে আমরা জানি এর ফলাফলের মধ্যে অর্জিত লক্ষ্যের আলােকে। এভাবে সমন্বয় করা যায় এর যাবতীয় বিরােধ ও বৈপরীত্যকে।

হেগেলের ভাববাদঃ হেগেলের মতবাদ ভাববাদ; কারণ তার। মধ্যে পরমসত্তা হলাে পরম চেতন সত্তা। আবার এ মতবাদকে বস্তুগত ভাববাদও বলা হয়। কারণ পরম চেতন সত্তা থেকে বস্তুজগত ও জীবজগত উদ্ভূত এবং উভয়েরই চেতন সত্তা আছে। জীবাত্মা ও জড়বস্তু উভয়ই পরমসত্তারই প্রকাশ। হেগেলের মতানুসারে, বস্তুগত ভাববাদ, বস্তুবাদ এবং ভাবুবাদের মধ্যে সমন্বয়সাধন করে জ্ঞেয় বস্তুর স্বরূপ সম্পর্কে আমাদের এক সন্তোষজনক মতবাদ দেয়। আত্মগত ভাববাদের বাহ্যজগতের ব্যক্তির মন নিরপেক্ষ অস্তিত্ব অস্বীকার করা হয়েছে। ভাববাদী দার্শনিক হেগেলই প্রথম বিজ্ঞান, দর্শন ও এ ধর্মের মধ্যে সমন্বয়সাধন করেছেন। তিনিই হলেন প্রথম দার্শনিক যিনি উপলব্ধি করেছেন যে, ইন্দ্রিয় ও বুদ্ধি সত্তারই প্রকাশ এবং বস্তু ও সত্তা এক ও অভিন্ন। বিজ্ঞান দর্শন ও ধর্ম এগুলাের মধ্যে এ যাবত যে বিরােধ চলে আসছিল হেগেলের পরমাত্মাবাদই এসব বিরােধের অবসান ঘটিয়ে এদের মধ্যে এক সুষম সমন্বয়সাধনপূর্বক দর্শনের ইতিহাসে এক নব অধ্যায়ের সূচনা করেছে।

সমালােচনাঃ হেগেলের দ্বান্দ্বিক পদ্ধতি নানাভাবে সমালােচিত হয়েছে। যেমন-

প্রথমতঃ হেগেল এ দ্বান্দ্বিক পদ্ধতিকে অত্যন্ত ব্যাপকভাবে প্রয়ােগ করেছেন। আমাদের চিন্তার ক্ষেত্রে যে পদ্ধতি উপযােগী তা যে জীবনের এবং তত্ত্বের ক্ষেত্রে একইভাবে উপযােগী হবে এমন কোনাে কথা নেই।

দ্বিতীয়তঃ চিন্তার ক্ষেত্রে ব্যবহৃত পদ্ধতিকে অন্যান্য ক্ষেত্রেও জোর করে প্রয়ােগ করা হলে জীবন ও জগতের বৈচিত্র্যকে যান্ত্রিভাবে ব্যাখ্যা করা হবে। বস্তুত জীবনের এ বৈচিত্র্য প্রকাশকে কেবলমাত্র দ্বান্দ্বিক পদ্ধতির দ্বারা ব্যাখ্যা করা যায় না।

তৃতীয়তঃ হেগেলের মতে, আমাদের বুদ্ধির বিকাশ ও পরিণতি যেভাবে ঘটে, পরমতত্ত্বের প্রভাব ও পরিণতি সেভাবেই ঘটে। কিন্তু একথা সুনির্দিষ্টভাবে বলা সম্ভব নয়।

চতুর্থতঃ হেগেলের মতে, পরস্পর বিরুদ্ধ ধারণাগুলাে উচ্চতর ধারণার মধ্যে সমন্বয় সাধন করে। পরস্পরবিরােধী ধারণার সমন্বয় আদৌ সম্ভব কিনা তা বুঝে ওঠা কঠিন।

পরিশেষঃ পরিশেষে বলা যায় যে, আজকের এই দিনে হেগেলীয় দর্শনের প্রতিপত্তি যে বহুলাংশে হ্রাস পেয়েছে একথা বলাই বাহুল্য। তা ছাড়া হেগেলকে যে আজো একজন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ আধুনিক দার্শনিক হিসেবে গণ্য করা হয় তাও অনস্বীকার্য। জ্ঞানের ক্ষেত্রে হেগেল যেভাবে তার দ্বান্দ্বিক পদ্ধতির সমন্বয়সাধন করে নতুন জ্ঞানের সৃষ্টি করেছেন তা নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবি রাখে। তাই হেগেলের দ্বান্দ্বিক পদ্ধতির দ্বারা যদিও সবকিছুকে ব্যাখ্যা করা কঠিন তবুও জ্ঞানের ক্ষেত্রে তার এ পদ্ধতি বিপ্লব ঘটিয়েছে।