বাংলাদেশের রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক ইতিহাসে হুসেন শাহি বংশের শাসনকাল বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। এই বংশের দুই প্রধান সুলতান আলাউদ্দিন হুসেন শাহ ও নসরত শাহের কৃতিত্বে বাংলাদেশ তথা বাঙালি জাতি রাজনৈতিক, সামাজিক, ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে এক নতুন ও গৌরবোজ্জ্বল যুগের প্রান্তে এসে উপস্থিত হয়েছিল। রাজনৈতিক সংহতিসাধন, শাসনতান্ত্রিক শৃঙ্খলা, সামাজিক সাম্য, ধর্মীয় সহিষ্ণুতা ও সাংস্কৃতিক বিকাশ যদি আধুনিকতার মানদণ্ড হয়, তাহলে হুসেন শাহি বংশের রাজত্বকালে বাংলাদেশ সেই আধুনিক যুগের আশ্বাস পেয়েছিল, – একথা বললেও অত্যুক্তি হয় না।

হুসেন শাহের রাজত্ব (১৪৯৩-১৫১৯ খ্রিঃ) শুরু হওয়ার সময় থেকে বাংলায় স্বাধীন সুলতানি যুগের এক গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়ের সূচনা হয়। ইলিয়াস শাহি বংশের শাসন অবসানের পর দীর্ঘ ৬ বছর বাংলায় হাবশি শাসন প্রচলিত ছিল। হাবশি শাসনকে বাংলার ‘অন্ধকার যুগ’ বলে অভিহিত করা যায়। হুসেন শাহের সিংহাসন দখলের প্রশ্নে সমসাময়িক ঐতিহাসিকের মধ্যে মতভেদ থাকলেও হাবশি অত্যাচারের অবসান ঘটিয়ে তিনি যে বাংলাকে রক্ষা করেছিলেন—এ বিষয়ে কোনো দ্বিমত নেই। আলাউদ্দিন হুসেন শাহের রাজত্ব ছিল দীর্ঘ। স্যার যদুনাথ সরকারের ভাষায় : “Alauddin Hussain Shah was unquestionably the best, if not the greatest of the medieval rulers of Bengal.” তাঁর দক্ষ প্রশাসনব্যবস্থা, উদারনীতি এবং ভৌমিক বিস্তৃতির ফলে বাংলাদেশে অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক দিক থেকে উন্নতি ও সমৃদ্ধির যে যুগ শুরু হয়, তা প্রতীয়মান হয় তাঁর আমলের নির্মিত কিছু সৌধ থেকে। অভ্যন্তরীণ শান্তিশৃঙ্খলা, ব্যবসা-বাণিজ্যের সুবিধা এবং বাংলাদেশের পূর্বাঞ্চলে মোঙ্গল জাতিগুলির বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান ও উড়িষ্যার রাজা গজপতির রাজ্যসীমা পর্যন্ত বাংলার আঞ্চলিক বিস্তৃতি দেশের সামরিক শ্রেণিকে যেমন বিশেষ অনুপ্রেরণা জোগায়, তেমনি পূর্বভারতে বাংলার প্রাধান্য বিশেষভাবে প্রতিষ্ঠিত করে। সমসাময়িক স্থানীয় সাহিত্যে এর প্রতিচ্ছবি পাওয়া যায়।

উদারতা ও প্রজাহিতৈষণার জন্য হুসেন শাহের নাম শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করা হয়ে থাকে। তাঁর মধুর ব্যবহার, নম্রতা ও দয়ালুতার জন্য জনগণ তাঁকে নৃপতি-তিলক ও জগৎভূষণ আখ্যায় ভূষিত করেছিল। তিনি ছিলেন উদারতার মূর্ত প্রতীক। তাঁর শাসনাধীন বাংলায় অমুসলমানদের জীবন ও ধর্ম সচ্ছল ও নিরাপদ ছিল বলেই অধিকাংশ পণ্ডিতের বিশ্বাস। তাই বলা হয়ে থাকে, হুসেন শাহের মতো উদারতা ও মনের বদান্যতা আকবরের পূর্বে আর কোনো মধ্যযুগীয় সুলতানের কাছে পাওয়া যায় না।

হুসেন শাহের পর বাংলার সিংহাসনে বসেন তাঁরই পুত্র নসরৎ শাহ (১৫১৯-১৫৩২ খ্রিঃ)। অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক ক্ষেত্রে তিনি পিতার নীতি যথাযথভাবে পালন করেন। তাঁর রাজত্বের প্রথমার্ধ মোটামুটি শান্তিতে কেটেছিল। ওই সময় তিনি শিল্প ও সংস্কৃতির উন্নয়নে নিজেকে আত্মনিয়োগ করতে পেরেছিলেন। কিন্তু রাজত্বের দ্বিতীয়ার্ধে সাম্রাজ্যের নিরাপত্তার সমস্যা তাঁকে বিব্রত করে তোলে। মুঘলবংশীয় বাবর ইতিমধ্যে ‘পানিপথের প্রথম যুদ্ধে’ (১৫২৬ খ্রিঃ) ইব্রাহিম লোদীকে পরাজিত করে দিল্লির সিংহাসন দখল করলে বাংলার বিপদ উপস্থিত হয়। নসরৎ শাহ বাবরের প্রতি আনুগত্য জানিয়ে নিজ অধিকার অব্যাহত রাখতে সক্ষম হন। দুর্ভাগ্যবশত এক আততায়ীর হাতে তিনি নিহত হন। অতঃপর সিংহাসনে বসেন তাঁর পুত্র আলাউদ্দিন ফিরোজ। নসরতের মৃত্যুর পর আসাম ও রায়েত অঞ্চলে বাংলার সুলতানি প্রাধান্য নষ্ট হয়ে যায়। ফিরোজকে হত্যা করে সিংহাসনে বসেন গিয়াসউদ্দিন মামুদ শাহ। মাত্র পাঁচ বছর রাজত্ব করার পর তিনি সিংহাসনচ্যুত হন। এবং এরই সাথে বাংলায় হুসেন শাহি বংশের শাসনের অবসান হয়।

বাংলার শিক্ষা-সংস্কৃতির ইতিহাসে হুসেন শাহি বংশের শাসনকাল বিশেষভাবে চিহ্নিত হয়ে আছে। আলোচ্য সময়ে বাঙালি প্রতিভার অভূতপূর্ব বিকাশ ঘটে। স্থানীয় মনীষার ভিত্তিতে বাংলা-সাহিত্যের নবজাগরণ ঘটে। এই যুগের জাগরণ স্বতস্ফূর্ত এবং এর মূলে ছিল পুরাণের আখ্যানের প্রতি সাধারণ মানুষের শ্রদ্ধাবোধ এবং সুলতান হুসেন শাহ ও নসরৎ শাহের পৃষ্ঠপোষকতা।

ব্যক্তিগত জীবনে হুসেন শাহ ছিলেন সংস্কৃতমনা এবং পরধর্মসহিষ্ণুতার মূর্ত প্রতীক। শিক্ষা ও শিক্ষিত ব্যক্তিদের প্রতি শ্রদ্ধাবশত তিনি রাষ্ট্রীয় তহবিল থেকে রাজস্বের একটি বড়ো অংশ শিক্ষাখাতে ব্যয় করতেন। একই সঙ্গে যুক্ত ছিল তাঁর প্রজাহিতৈষণার কাজ। বিদ্বান এবং ধর্মজ্ঞানীদের জন্য তিনি যেমন নিয়মিত ভাতা-র ব্যবস্থা করেছিলেন, তেমনি প্রতিটি জেলায় তৈরি করেছিলেন মসজিদ, হাসপাতাল প্রভৃতি। হুসেন শাহের শাসনব্যবস্থা ছিল মূলত ধর্মনিরপেক্ষ। তাঁর উজির রূপ ও সনাতন গোস্বামীকে সুলতান ব্যক্তিগত সচিবের পদে উন্নীত করেছিলেন। তাঁর আমলে সংস্কৃত ও বাংলা সাহিত্যের নবজাগরণ ঘটেছিল বলা যায়। এই পর্বে রূপ গোস্বামী সংস্কৃতে বিদগ্ধমাধব ও লতিতমাধব নামে দুখানি গ্রন্থ রচনা করেন। সুলতানের পৃষ্ঠপোষকতায় মালাধর বসু শ্রীমৎভাগবত বাংলায় অনুবাদ করেন এবং এই কাজের জন্য সুলতান মালাধরকে ‘গুণরাজ খাঁ’উপাধিতে ভূষিত করেন বলে অনেকে মনে করেন। সেনাপতি পরাগল খাঁর আগ্রহ ও আতিশয্যে পরমেশ্বর কবীন্দ্র নামে জনৈক কবি সমগ্র মহাভারত বাংলায় অনুবাদ করেন। পরাগল খাঁ’র পুত্র ছুটি খাঁ’র আনুকূল্যে মহাভারতের অশ্বমেধ পর্বের অনুবাদ করেন শ্রীধর নন্দী। আবার রাজদরবারের পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়াই বিজয় গুপ্ত, বিপ্রদাস প্রমুখ ‘মনসামঙ্গল’ কাব্য রচনা করে খ্যাতি অর্জন করেন। বাংলা ভাষার সাথে সাথে সংস্কৃত সাহিত্য ও দর্শনচর্চা সে যুগে বৃদ্ধি পেয়েছিল। এ ছাড়া হস্তলিখন পদ্ধতিও উৎকর্ষতা অর্জন করেছিল।

হুসেন শাহি বংশের রাজত্বকালে মানবতাবাদী ও ভাবসর্বস্ব কাব্যেরও বিশেষ উন্নতি সাধন হয়েছিল। ভক্তিবাদী আন্দোলনের প্রাণপুরুষ শ্রীচৈতন্য ভক্তিবাদের উদারতা প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে বাংলা সাহিত্যের বিকাশেও বিশেষ সহায়তা করেছেন। শ্রীচৈতন্যের জীবনী-গ্রন্থগুলি দেশীয় সাহিত্যের শ্রীবৃদ্ধিতে সাহায্য করে। সুলতানদের ধর্মীয় উদারতা বাংলার ধর্মজীবনে নিয়ে আসে নতুন আস্বাদ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রকাশিত বাংলাদেশের ইতিহাসগ্রন্থের মতে, এই যুগে বৈষ্ণববাদ ও বাংলা সাহিত্যের বিকাশ সমসাময়িক গৌড়রাজ্যের উদারতা ও আলোকপ্রাপ্ত মন ছাড়া সম্ভব হত না। শ্রীচৈতন্যের জীবন ও বাণী বাঙালির চিন্তা ও জীবনধারায় বয়ে আনে নতুন বিপ্লব।

স্থাপত্যশিল্পের বিকাশের ক্ষেত্রেও হুসেন শাহি বংশের অবদান অনস্বীকার্য। হিন্দু ও ইসলামীয় রীতির সংমিশ্রণে এ যুগেই বহু মন্দির ও মসজিদ নির্মিত হয়। এই প্রসঙ্গে বড়ো সোনা মসজিদের নাম উল্লেখযোগ্য। ইট ও পাথর দ্বারা নির্মিত এইসব মন্দিরে প্রাদেশিক রীতির প্রভাব লক্ষণীয়।

প্রসঙ্গত স্মরণীয়, হুসেন শাহি বংশের উদারতা ও ধর্মনিরপেক্ষতার প্রসঙ্গ সমালোচনামুক্ত নয়। ড. রমেশচন্দ্র মজুমদার তাঁর ‘বাংলাদেশের ইতিহাস’ গ্রন্থে নানা তথ্যসহ প্রমাণ করতে চেয়েছেন যে, হুসেন শাহি বংশের উদারতা, ধর্মনিরপেক্ষতা, সাহিত্যানুরাগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়নি। তাঁর মতে, হুসেন শাহের শিলালিপিগুলির সাক্ষ্য বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, তিনি একজন অত্যন্ত নিষ্ঠাবান সুলতান ছিলেন এবং ইসলামধর্মের মাহাত্ম্য প্রচার ও মুসলমানদের মঙ্গলসাধনের জন্য বিশেষভাবে সচেষ্ট ছিলেন। উড়িষ্যার ‘মাতলাপঞ্জি; বাংলায় ‘চৈতন্যচরিত’ গ্রন্থগুলি থেকে জানা যায় যে, হুসেন শাহ উড়িষ্যা অভিযানে গিয়ে বহু দেবমন্দির ও দেবমূর্তি ধ্বংস করেছিলেন। বৃন্দাবন দাস চৈতন্যভাগবতে হুসেন শাহকে ‘পরম দুর্বার যবন রাজা’ বলে অভিহিত করেছেন। সমসাময়িক পোর্তুগীজ বণিক ফ্রেডারিক বারবোসা হুসেন শাহ সম্বন্ধে লিখেছেন যে, তাঁর এবং তাঁর অধীনস্থ শাসনকর্তাদের আনুকুল্য অর্জনের জন্য প্রতিদিন বাংলায় অনেক হিন্দু ইসলামধর্ম গ্রহণ করত। সুতরাং হুসেন শাহ যে হিন্দু-মুসলমানের প্রতি সমদর্শী ছিলেন, একথা বলা যুক্তিসঙ্গত নয়। শাস্তিবিধানের সময় তিনি হিন্দুদের প্রতি অনুদার ব্যবহার করতেন। হিন্দুদের গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ ড. মজুমদার বলেছেন যে, এই ধারা হুসেন শাহি বংশের অনেক আগে থেকে চলে আসছিল। এবং এর অন্যতম কারণ ছিল। যোগ্যতাসম্পন্ন মুসলমান কর্মচারীর অভাব। কিন্তু একথা মনে রাখা দরকার যে, হিন্দুদের তিনি যে ধরনের গোপনীয় কাজে নিযুক্ত করেছিলেন, তা ইতিপূর্বে কেউ করেননি; এবং সেটা তাঁর উদারতার জন্যই সম্ভব হয়েছিল। ড. মজুমদারও স্বীকার করেছেন যে, হুসেন শাহ, নসরৎ শাহ প্রভৃতি সুলতানগণ ছিলেন বিচক্ষণ ও চতুর রাজনীতিবিদ। সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুদের গুরুত্ব তাঁরা বুঝতেন; তাই তাদের হিন্দুবিদ্বেষ কখনো মাত্রা ছড়িয়ে যায়নি।

সমসাময়িক বিভিন্ন পর্যটকদের বিবরণ, বৈষ্ণব পদাবলী ও মঙ্গলকাব্য থেকে সে যুগের অর্থনৈতিক অবস্থার বিবরণ পাওয়া যায়। হুসেন শাহি বংশের শাসনকাল ব্যবসা-বাণিজ্যে ক্রমোন্নতির পথে অগ্রসর হয়েছিল। অনেক মঙ্গলকাব্যেরই নায়ক একজন সওদাগর। নিকোলো কন্টির বিবরণ থেকে জানা যায়, পঞ্চদশ শতকে ভারতে প্রস্তুত নৌকা ইউরোপের নৌকার থেকে বড়ো এবং মজবুত ছিল। এই ঘটনা নৌবাণিজ্যের অগ্রগতির সূচনা করে। বাঙালি বণিকেরা বঙ্গোপসাগর পার হয়ে ব্রহ্মদেশ, ইন্দোচীন, ইন্দোনেশিয়াতে বাণিজ্য ব্যাপারে যাতায়াত করতেন। এই আমলে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বন্দর হল পুরী, কলিঙ্গপত্তনম্, চিল্কাচুলী, লঙ্কাপুরী, রামেশ্বর, বিজয়নগর প্রভৃতি। ষোড়শ শতকের প্রথমে পোর্তুগীজ পর্যটক বারবোসার একটি বিবরণ থেকে জানা যায়, এ দেশের সমুদ্রতীরে ও দেশের অভ্যন্তরে বহু নগরী ছিল। সেগুলিতে দেশি-বিদেশি বণিকরা বসবাস করতেন। উৎকৃষ্ট সাদা চিনি, সুতি কাপড়, মসলিন খুব চড়া দামে বিদেশের বাজারে বিক্রি হত। ষোড়শ শতকের প্রথমদিকে রচিত ইতালীয় পর্যটক ভার্থেমার বিবরণী থেকেও বাংলাদেশের বিস্তৃত বাণিজ্যসম্ভার এবং সুতা ও রেশম কাপড়ের উল্লেখ পাওয়া যায়। ভার্থেমা বলেন যে, বাংলাদেশের মতো ধনী বণিক তিনি অন্য কোথাও দেখেননি। আর এক পোর্তুগীজ জাঁয়া দে-বারস লিখেছেন যে, গৌড় নগরী বাণিজ্যের একটি প্রধান কেন্দ্র ছিল। নয় মাইল দীর্ঘ এই শহরে প্রায় ২০ লক্ষ লোক বাস করত। দোকানপাট, বাণিজ্য-সম্ভারে শহর পরিপূর্ণ ছিল। সোনারগাঁ, হুগলী, চট্টগ্রাম ও সপ্তগ্রাম ছিল ব্যস্ততম বাণিজ্যকেন্দ্র। ষোড়শ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে সিজার ফ্রেডারিক সাতগাঁওকে খুব সমৃদ্ধিশালী বন্দর বলে বর্ণনা করেছেন। এদের বিবরণ থেকে জানা যায় যে, ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রদেশের বণিকরা বাংলায় বাণিজ্য করতে আসত। এদের মধ্যে কাশ্মীরি, মুলতানি, পাঠান, ভুটিয়া ও সন্ন্যাসীদের বিশেষ উল্লেখ পাওয়া যায়।

ব্যবসা-বাণিজ্যের ব্যাপক প্রচলন থাকলেও কৃষি ছিল বাঙালির প্রধান জীবিকা। সমসাময়িক সাহিত্য ও বিদেশি পর্যটকের বিবরণীতে বাংলার অতুলনীয় সম্পদের উল্লেখ পাওয়া যায়। হুসেন শাহের আমলেও বাংলাদেশে বছরে তিনবার ফসল হত। সাধারণভাবে বাঙালি ছিল পরিশ্রমী। বহু কষ্টস্বীকার করেও জঙ্গল কেটে সে যুগে জমিকে চাষের উপযোগী করার নিদর্শন আছে। সরকারি রাজস্বের পরিমাণ ছিল খুবই কম; উৎপন্ন ফসলের এক-পঞ্চমাংশ মাত্র। পঞ্চদশ শতকের শেষদিকে আগত চৈনিক রাজদূতের বিবরণ থেকে জানা যায়, বাংলাদেশে কৃষিজাত সম্পদের প্রাচুর্য ছিল এবং ব্যবসা-বাণিজ্যে বহু অর্থাগম হত। পোশাক-পরিচ্ছদ ও মণিমুক্তাখচিত অলংকারের প্রাচুর্য দেখে চৈনিক রাজদূতেরা বিস্মিত হয়ে গিয়েছিলেন।

তবে এই যুগে দারিদ্র্য যে একেবারে ছিল না, তা নয়। দ্রব্যাদির দাম সস্তা হলেও সাধারণ কৃষক ও প্রজাদের দুঃখদুর্দশার অবধি ছিল না। রাজকর্মচারীদের অযথা অত্যাচার ও উৎপীড়ন অব্যাহত ছিল। রাজস্বের টাকা দিতে না পারলে হিন্দুদের স্ত্রী ও সন্তানদের নিলামে বিক্রি করা হত। যুদ্ধকালে সৈন্যদের লুটপাট অব্যাহত ছিল।