১.৩ হিসাববিজ্ঞানের উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশের ইতিহাস

Origin and Evolution of Accounting

প্রশ্নঃ হিসাববিজ্ঞানের উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ বর্ণনা কর।

অথবা, হিসাববিজ্ঞানের উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশের ইতিহাস আলোচনা কর।

ভূমিকাঃ মানব সভ্যতার ইতিহাসের মতাে হিসাববিজ্ঞানের ইতিহাসও অতি প্রাচীন। মানব সভ্যতার শুরু থেকে বর্তমান পর্যন্ত হিসাববিজ্ঞানের ব্যাপক পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। হিসাববিজ্ঞানের এ উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশের ইতিহাসকে মূলত চারটি পর্যায়ে ভাগ করা যায়।

আদিকাল (Development Period): মানব সভ্যতার শুরু থেকে ১৪৯৪ সালের পূর্ব পর্যন্ত উন্মেষ কালের বিস্তার। বাস্তবিকপক্ষে হিসাববিজ্ঞানের প্রচলন কখন কোথায় শুরু হয়েছিল তার কোনাে নির্ভরযােগ্য ঐতিহাসিক তথ্য নেই। তবে ঐ সময়ে সাধারণ মানুষ বিভিন্ন পন্থা অবলম্বন করে হিসাব তথ্যাদি সংরক্ষণ করত। ১৪৯৪ সালের পূর্ব পর্যন্ত যুগে যুগে হিসাব সংরক্ষণের ধরনে কিছুটা ভিন্নতা পরিলক্ষিত হয় যা নিচে আলােচনা করা হলােঃ

১. প্রস্তর যুগ (Stone Age): প্রস্তুর যুগে মানুষ গুহায় বাস করত এবং গাছের ফলমূল সংগ্রহ করে ও বন্য পশু শিকার খ করে জীবন ধারণ করত। আদিম মানুষ তখন শিকারকৃত জীবজন্তু ও সংগৃহীত ফলমূলের সংখ্যা গুহায় বা প্রাচীরের গায়ে খােদাই করে এবং প্রস্তর খণ্ডে আঁচড় কেটে হিসাব রাখত।

২. প্রাচীন যুগ (Ancient Age): এ সময় মানুষ গুহা ছেড়ে সমভূমিতে বসবাস করা শুরু করে। এরপর কৃষিকাজের কৌশলগুলাে তারা আয়ত্ত করে। কৃষিকাজের মাধ্যমে উৎপাদিত ফসলাদির হিসাব তারা ঘরের দেয়ালে দাগ কেটে এবং রশিতে গিঁট দিয়ে রাখত।

৩. বিনিময় যুগ (Exchange Age): সমাজের আয়তন বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে মানুষের চাহিদা দিন দিন বৃদ্ধি পেতে থাকে। তারা তাদের উৎপাদিত ফসলাদি বিনিময়ের মাধ্যমে একে অপরের চাহিদা পূরণ করত। এ সময় মানুষ তাদের উৎপাদিত ফসলাদির পাশাপাশি পণ্য বিনিময়ের হিসাবও রাখত দরজার কপাটে বা মাটির দেয়ালে রং দিয়ে দাগ কেটে।

৪. মুদ্রার যুগ (Currency Age): বিনিময় প্রথার অসুবিধা দূর করার জন্য মুদ্রার প্রচলন হয়। এ সময় বণিক শ্রেণির উদ্ভব, শিক্ষা ব্যবস্থার প্রচলন এবং বাকিতে ক্রয়-বিক্রয় শুরু হয়। তখন হিসাব-নিকাশের বিজ্ঞানসম্মত কোনাে পদ্ধতি না থাকলেও তারা তাদের লেনদেন খাতায় লিখে রাখত, যা একতরফা দাখিলা পদ্ধতি নামে পরিচিত।

প্রাক-বিশ্লেষণ কাল (Pre-analytical Period): ১৪৯৪ সাল থেকে ১৮০০ সাল পর্যন্ত সময়কালকে প্রাক-বিশ্লেষণ কাল ধরা হয়েছে। ইতালির একজন প্রখ্যাত দার্শনিক, ধর্মযাজক ও গণিতশাস্ত্রবিদ লুকা প্যাসিওলি ১৪৯৪ সালে হিসাববিজ্ঞানের বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনেন। তার গণিতশাস্ত্রের ওপর রচিত গ্রন্থ “Summa de Arithmetica geometria. Proportioni: et proportionalita” তে আধুনিক হিসাববিজ্ঞানের কলাকৌশল অর্থাৎ দু’তরফা দাখিলা পদ্ধতি নিয়ে আলােচনা করেন। এ দু’তরফা দাখিলা পদ্ধতির ওপর ভিত্তি করে হিসাববিজ্ঞানের উন্নতি সাধিত হয়েছে।

বিশ্লেষণ কাল (Analytical Period): ১৮০০ সাল থেকে ১৯৫০ সাল পর্যন্ত সময়কালকে বিশ্লেষণ কাল হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এই সময়ে হিসাববিজ্ঞানের জনক লুকা প্যাসিওলি কর্তৃক প্রবর্তিত দু’তরফা দাখিলা পদ্ধতির ওপর ভিত্তি করে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের হিসাব-নিকাশের কার্যক্রম পরিচালিত হওয়ার প্রচলন হতে থাকে। পরবর্তীতে হিসাবরক্ষকের কার্যক্রম বিভিন্নভাবে বিশ্লেষণ করা শুরু হয়। এ পর্যায়ে হিসাববিজ্ঞানের যে শাখাগুলাে দেখা যায় তা হলাে- আর্থিক হিসাববিজ্ঞান, নিরীক্ষা ও কর হিসাববিজ্ঞান, উৎপাদন ব্যয় হিসাববিজ্ঞান, সরকারি হিসাববিজ্ঞান, সামাজিক হিসাববিজ্ঞান, অবচয়ের ধারণা, রক্ষণশীলতার নীতি ইত্যাদি।

আধুনিক কাল (Modern Period): ১৯৫০ সাল থেকে বর্তমান পর্যন্ত সময়কালকে হিসাববিজ্ঞানের আধুনিক সময়কাল হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এ সময়ে হিসাববিজ্ঞান ব্যাপক প্রসার লাভ করে। হিসাব তথ্যের ওপর ব্যাপক নির্ভরশীলতা পরিলক্ষিত হয়, যার ফলে হিসাববিজ্ঞানের শাখা-প্রশাখার উৎপত্তি ঘটে। হিসাববিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখা, যেমন: ব্যবস্থাপনা হিসাববিজ্ঞান, মুদ্রাস্ফীতি হিসাববিজ্ঞান, মানব সম্পদ হিসাববিজ্ঞান ইত্যাদি। ব্যবসায়ে সংরক্ষিত হিসাবসমূহের গ্রহণযােগ্যতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে হিসাব মানের উন্নয়ন ঘটানাে হয়। ফলে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক হিসাব মান সংস্থার উদ্ভব ঘটে। যেমন: International Accounting Standards Board (IASB), হিসাবরক্ষণের ক্ষেত্রে গ্রহণযােগ্য হিসাব মান International Accounting Standards (IAS) ইস্যু করে থাকে। বর্তমানে হিসাব বিশারদগণ হিসাববিজ্ঞানকে অধিকতর উন্নত করার জন্য নিরলস প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।

পরিশেষঃ হিসাববিজ্ঞানের অগ্রযাত্রা এখনো চলমান আছে। বিশেষত চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের প্রেক্ষাপটে হিসববিজ্ঞান প্রজুক্তির সাথে সমন্বয় করে এগিয়ে চলছে।