উপন্যাস অপেক্ষা ছোটগল্প রচনায় প্রেমচন্দের ক্ষেত্র আরও বিস্তৃত এবং জীবনের সত্য ও মনস্তত্ত্ব বর্ণনায় আরও অনুপুঙ্খ-আলোচনা করো।

মুন্সী প্রেমচন্দ শুধু হিন্দী কথাসাহিত্যের ক্ষেত্রে নয়, সমগ্র ভারতীয় সাহিত্যের ক্ষেত্রেই প্রথমসারির সাহিত্যিক হিসাবে বিবেচিত। রোমান্টিক কল্প কাহিনী ও রোমাঞ্চকর মনোরঞ্জনকারী গল্পের ধারায় হিন্দী সাহিত্যে প্রেমচন্দ নিয়ে এলেন বাস্তববাদী দৃষ্টিভঙ্গী ও সাধারণ পল্লীর দারিদ্র্য, লাঞ্ছিত, শোষিত মানুষের জীবনকথা।

হিন্দী কথাসাহিত্যে প্রেমচন্দ উপন্যাস সাহিত্যের স্থপতি হিসাবে স্বীকৃত। প্রেমচন্দই প্রথম হিন্দী উপন্যাসকে কল্পলোক থেকে ভারতীয় সমাজের বাস্তব পরিপ্রেক্ষিতের ওপর স্থাপন করলেন। তাঁর উপন্যাসের বিষয়বস্তুতে প্রতিফলিত হল পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীর লাঞ্ছনা, সামন্ততান্ত্রিক সমাজে কৃষিজীবী, শ্রমজীবী মানুষের শোষণক্লিষ্ট জীবনের ছবি, ব্রাহ্মণ্যতন্ত্রের ভয়ঙ্কর অর্থগৃধুতা এবং সেইসঙ্গে নিম্নবিত্ত, নিম্নবর্ণ শ্রমজীবী মানুষের জীবন সংগ্রাম ও সামাজিক-আর্থিক অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের ছবি। তাঁর প্রথম উপন্যাস প্রকাশিত হয় ১৯০১ খ্রিস্টাব্দে। এটি উর্দুর্তে রচিত। হিন্দীতে রচিত প্রথম উপন্যাস ‘সেবাসদন’। এ ছাড়াও তাঁর অন্যান্য উপন্যাসগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য ‘প্রেমাশ্রম’, ‘রঙ্গভূমি’, ‘নির্মলা’, ‘কর্মভূমি’, ‘কায়াকল্প’, ‘গবন’, ‘গোদান’ ইত্যাদি। তাঁর সর্বশ্রেষ্ঠ উপন্যাস ‘গোদান’ প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দে।

উপন্যাসের ক্ষেত্রে প্রেমচন্দের খ্যাতি এবং ক্ষমতা অনস্বীকার্য হলেও ছোটগল্পের ক্ষেত্রে তাঁর ব্যাপ্তি অপেক্ষাকৃত বেশি বলেই মনে হয়। হিন্দী উপন্যাসের মতো হিন্দী ছোটগল্পের ক্ষেত্রেও প্রেমচন্দকে স্থপতি পুরুষ বা যুগ প্রবর্তক বলে স্বীকার করা যায়। উপন্যাসের ক্ষেত্রে প্রেমচন্দ সামাজিক এবং রাজনৈতিক উপন্যাস রচনা করেছেন। ‘গবন’ উপন্যাসে কেবলমাত্র কিছুটা মনস্তাত্ত্বিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার পরিচয় মেলে। কিন্তু ছোটগল্পের ক্ষেত্রে প্রেমচন্দ সামাজিক, রাজনৈতিক, মনস্তাত্ত্বিক, ঐতিহাসিক, কাহিনী প্রধান চরিত্র প্রধান ইত্যাদি প্রায় সব ধরনের গল্পই রচনা করেছেন। প্রতিটি গল্পে তীব্র বাস্তবতা, সহজ বর্ণনাভঙ্গি এবং ভাষা সারল্য গল্পগুলিকে সজীবতা ও গ্রহণযোগ্যতা দান করেছে।

জীবনের প্রথম গল্পটি ১৯০৭ খ্রিস্টাব্দে প্রেমচন্দ লিখেছিলেন উর্দুতে। গল্পটির নাম ‘সনসার কা সবসে আনমোল রতন’। এরপর ১৯০৮-এ প্রকাশিত হয় স্বদেশপ্রেমমূলক পাঁচটি গল্পের সংকলন ‘সোজ-এ-বতন’। এই গল্পগুলি রচিত হয়েছিল নবাব রায় নামে। কিন্তু সরকারি বিদ্যালয়ের শিক্ষক হয়ে তীব্র দেশপ্রেমমূলক এই গল্পগুলি ঔপনিবেশিক ইংরেজ প্রশাসনের কাছে রাজদ্রোহমূলক বলে প্রতিভাত হয়। ফলে তৎকালীন জেলা ম্যাজিস্ট্রেট এই গল্পটিকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন এবং গ্রন্থের কপিগুলি দগ্ধ করা হয়। প্রেমচন্দের তথা ধনপত রায় তথা নবাব রায়ের উপরেও সরকারি অনুমতি ছাড়া সাহিত্য রচনার ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। তাৎক্ষণিকভাবে চাকরিতে ইস্তফা না দিলেও কৌশল হিসাবে এরপরেই তিনি প্রেমচন্দ ছদ্মনাম গ্রহণ করেন। ১৯১০-এ প্রকাশিত হয় প্রেমচন্দ নামে রচিত প্রথম হিন্দী ভাষায় রচিত গল্প ‘বড়ে ঘর কী বেটী।

প্রেমচন্দের রচিত ছোটোগল্পের সংখ্যা প্রায় আড়াই শত। গল্পগুলি ‘মানসরোবর’ নামক ৮টি খণ্ডে প্রকাশিত গ্রন্থে সংকলিত। এ ছাড়া তাঁর কয়েকটি গল্প সংকলন গ্রন্থ ‘প্রেম-দ্বাদশী’, ‘প্রেম-পচিশী’, ‘প্রেম-পূর্ণিমা’, ‘প্রেমপ্রসূন’, ‘সপ্ত-সরোজ’ ইত্যাদি।

উপন্যাসের মতো ছোটগল্পেও ভারতীয় সমাজের বিশেষত জীবনের বহুবিধ সমস্যা ও যন্ত্রণাকে বিস্তৃত ও জীবন্তভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন প্রেমচন্দ। ছোটগল্পের ক্ষেত্রে বরং প্রেমচন্দের দৃষ্টি আরও প্রখর, ইঙ্গিতবাহী এবং বহুমুখী সমস্যার ক্ষেত্রে আলোকসঞ্চারী।

তাঁর কয়েকটি অবিস্মরণীয় গল্প হল ‘পঞ্চপরমেশ্বর’, ‘সোয়াসের গেহ্ব’ ‘নমক কা দারোগা’, ‘কফন’, ‘শতরঞ্জ কী খিলাড়ী’, ‘সদগতি’ ইত্যাদি।

প্রেমচন্দের অধিকাংশ গল্পেই নিম্নবিত্ত সর্বহারা মানুষের প্রতি ব্রাহ্মণ্যতন্ত্র ও সামন্ততান্ত্রিক শোষণের চিত্র তীব্র বর্ণে অঙ্কিত। ‘সোয়াসের গেহু’ গল্পেও দরিদ্র কৃষকের ধর্মভীরুতা ও তার উপর ব্রাহ্মণ্যতন্ত্রের শোষণের চিত্র উপস্থাপিত।

কুর্মী-কৃষক শংকর স্বভাবতই দরিদ্র। কিন্তু তার দেবভক্তি ও ব্রাহ্মণভক্তি যথেষ্ট। একদা তার ঘরে এক সাধু উপস্থিত হলে তাঁর সেবার জন্য স্থানীয় বিপ্লজীর কাছ থেকে মাত্র সোয়াসের গম ধার করতে হয় শংকরকে। পরে বিপ্রজীকে ব্রাহ্মণসেবার জন্য ভেট দেবার সময় অতিরিক্ত দান করে সে সেই ঋণ শোধ করতে চায়। শংকর ভাবে মাত্র সোয়া সের গমের ঋণ তার শোধ হয়ে গেছে।

পরে শংকরের আর্থিক দুরবস্থা আরও খারাপ হয়। আর সাত বছর পরে বিপ্র মহাজনে পরিণত হন। হঠাৎ একদিন বিপ্র শংকরকে জানান যে শংকরের কাছে তাঁর সুদে আসলে সাড়ে পাঁচ মন গম পাওনা আছে।

‘সোয়াসের গেহু’ গল্পে বিপ্রের এই অমানবিক লোভ ও মহাজনীবৃত্তির নির্মমতা দেখানো হয়েছে। শংকরকে এই ঋণের দায়ে তো গোলামী করতে হয়েছেই, গল্পে আরও দেখানো হয়েছে, শংকরের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্রকেও বংশপরম্পরায় ঋণের বোঝা বহন করতে হচ্ছে।

প্রেমচন্দের একটি অসাধারণ ছোটগল্প ‘কফন’। নিম্নবর্গীয় মানুষের পশুবৎ জীবন ও তাদের উপর উচ্চবর্ণীদের শোষণের চিত্র প্রেমচন্দের অধিকাংশ গল্পেরই কেন্দ্রীয় বিষয়। ‘কফন’ গল্পেও সেই নিম্নবর্গীয় মানুষের অবক্ষয়িত জীবনকথা বর্ণিত।

‘কফন’ গল্পের কেন্দ্রভূমিতে রয়েছে মাত্র দু’টি চরিত্র-চামার ঘিসু এবং তার পুত্র মাধব। দুজনেই চূড়ান্ত দরিদ্র শ্রমজীবী। তারা স্বভাবত অলস, ফাঁকি দিয়ে দু পয়সা অর্থোপার্জন হলেও মদ ও নেশায় সে অর্থ শেষ না হওয়ায় পর্যন্ত তারা আর কোনো কাজ করতে রাজী নয়। নিম্নবিত্ত মানুষের পরিশ্রম প্রবণতা তাদের মধ্যে অনুপস্থিত এবং ফাঁকি দিতে তারা দক্ষ।

মাধবের স্ত্রী বিনা চিকিৎসায় ও যত্নে প্রসব হতে গিয়ে নিতান্ত অযত্নে মারা গেলে তার পারলৌকিক ক্রিয়ার জন্য ঘিসু ও মাধব জমিদারের কাছে ও অন্যান্য মাতব্বরদের কাছে অর্থসংগ্রহ করে। কিন্তু ক্রিয়াকর্মের জন্য সামান্য কিছু ব্যয়ের পর শবাচ্ছাদনের কাপড় (কফন) কেনার পরিবর্তে সেই টাকা তারা মদ খেয়ে উড়িয়ে দেয়।

নিম্নবিত্ত মানুষের অবক্ষয়িত হীন জীবনচিত্র অত্যন্ত নির্মোহ নির্মম ভাষা ও ভঙ্গিতে ‘কফন’ গল্পে‌ উপস্থাপিত।

‘শতরঞ্জ কী খিলাড়ী’ গল্পের প্রেক্ষাপট ঐতিহাসিক। ওয়াজিদ আলির সমকালীন লক্ষ্ণৌর নবাব-জায়গীরদারদের বিলাসিতা ও বাস্তববিমুখতার চিত্র এখানে উপস্থাপিত। দেশে যখন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি তার বজ্র থাবা বিস্তার করতে চাইছে, যখন তার বিরুদ্ধে দেশরক্ষার প্রয়োজনেই রাজনৈতিক ও সামরিক প্রতিরোধ গড়ে তোলা প্রয়োজন, তখন গল্পের প্রধান দুই চরিত্র জায়গীরদার মির্জা সাজ্জাদ আলি ও মীর রৌশন আলি দিবারাত্র সুরা সহযোগে পাশা (শতরঞ্জ) খেলায় নিমগ্ন হয়ে থাকেন। শহরে যখন কোম্পানির ফৌজ ঢুকে পড়ে, তখনও তাঁরা পাশার নেশায় মশগুল এবং শেষপর্যন্ত এই পাশা খেলাকে কেন্দ্র করে পারস্পরিক বিবাদের জেরে উভয়ে উভয়কে অস্ত্রাঘাতে হত্যা করে সাজ্জাদ আলি ও রৌশন আলি।

জগৎ বিমুখ বাস্তব বিমুখ উচ্চবিত্ত বিলাস কিভাবে শুধু ব্যক্তিগত স্তরে নয়, সামগ্রিক দেশীয় অবস্থাকেও ভয়ংকর পরিণামের মুখে ঠেলে দেয়, শতরঞ্জ কী খিলাড়ী’ গল্পে তা দেখানো হয়েছে অপূর্ব কৌশলে।

প্রেমচন্দের একটি অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য গল্প ‘নমক বা দারোগা’। মধ্যবিত্ত আদর্শবাদের অন্তঃসারশূন্যতাকে কটাক্ষ করা হয়েছে আশ্চর্য শিল্পকৌশলে এই গল্পে।

আলোচ্য গল্পে আদর্শবাদী যুবক বংশীধর লবণের দারোগাপদে ন্যায়পরায়ণতার সঙ্গে কাজ করতে লাগল। একদিন তার কঠোর প্রহরায় ধরা পড়ে গেলেন গ্রামের জমিদার পণ্ডিত আলোপীদিন। ক্ষমতার ও প্রতিপত্তির ভয় দেখিয়ে বা অর্থলোভ দেখিয়েও বংশীধরকে নিরস্ত করা গেল না। আলোপীদিনের নামে চোরাকারবারের মামলা রুজু করা হল। কিন্তু প্রশাসনের সমস্ত শক্তি ন্যায়ের পরিবর্তে ক্ষমতাবানের পক্ষেই যায়। ফলে আলোপীদিনের সাজা হবার পরিবর্তে চাকরি গেল বংশীধরের।

গল্পের শেষাংশে দেখি, দারিদ্রক্লিষ্ট আদর্শবাদী যুবক বংশীধরকে নিজ সেরেস্তায় বার্ষিক ছহাজার টাকা বেতনে সম্পত্তির ম্যানেজার পদে বহালের প্রস্তাব নিয়ে এসেছেন আলোপীদিন। এবং আরও আশ্চর্য, একদা আদর্শবাদী বংশীধর এখন বিনাতকে এই প্রস্তাব নিতান্ত বংশধরদের মতো গ্রহণ করে কৃতার্থ হয়ে যায়।

মুন্সী প্রেমচন্দের একটি অবিস্মরণীয় ছোটগল্প ‘সদ্‌গতি’। ‘সদ্‌গতি’ গল্পে দুখী চামার অত্যন্ত ধর্মভীরু মানুষ। ব্রাহ্মণের কাছে সে অস্পৃশ্য। কিন্তু দেব-দ্বিজে ভক্তি তার প্রচুর। ব্রাহ্মণেরা মাঙ্গলিক ক্রিয়াকর্মে তাদের সাংসারিক কল্যাণ করেন বলে সে দৃঢ়বিশ্বাস করে। কন্যার বিবাহের শুভ দিন নির্ধারণের জন্য দুখী ব্রাহ্মণ পণ্ডিত ঘাসীরামের কাছে যায়।

কিন্তু অপ্রত্যাশিত দুখীকে পেয়ে গিয়ে ঘাসীরাম বিনাপয়সায় ঘরের কিছু কাজ করিতে নিতে থাকে। উঠোন ঝাঁট দিয়ে এবং গোয়ালঘরে ভুসির বস্তা বয়ে এনে দিয়েও তাকে একটি কঠিন এবং বিশাল কাঠের গুঁড়ি চিরতে হয়। অশক্ত শরীরে অভুক্ত অবস্থায় সারাদিন চেষ্টা করেও দুখী কাঠটা চিরতে পারে না এবং অবশেষে অমানুষিক পরিশ্রমের আঘাতে মারা যায়।

ব্রাহ্মণ্যতন্ত্রের স্বার্থসর্বস্ব অমানবিক শোষণের জ্বলন্ত চিত্র উপস্থাপিত হয়েছে ‘সদ্‌গতি’ গল্পে। তবে চামার সম্প্রদায়ের ক্ষোভ ও প্রতিবাদের ইঙ্গিতও এখানে আছে।

শুধু হিন্দী সাহিত্যে নয়, ভারতীয় সাহিত্যে–এমনকি বিশ্বসাহিত্যেও প্রেমচন্দের ছোটগল্পগুলি বিষয় বর্ণনায়, সমাজ-প্রতিফলনে, মানবিক দর্শনের উদ্ভাসনে, গল্পের শিল্পময় প্রযুক্তি কৌশলে অসাধারণ বলে স্বীকৃত হয়েছে। নিম্নবিত্ত অসহায় মানুষের জীবনসংগ্রাম ও প্রচলিত বৈষম্যময় সমাজব্যবস্থার প্রতি প্রেমচন্দের এই ছোটগল্পগুলি এক তীব্র আঘাত। এদিক থেকে প্রেমচন্দের ‘কলম বা সিপাহী’ অভিধা সার্থক।