বিশ্বযুদ্ধের উন্মত্ততার পরেই অবসাদ। আবার তরবারি অপেক্ষা লেখনীর জয়ধ্বনি দেবার অনুকূল অবসর দেখা দিল। এশিয়ার প্রথম ‘নোবেল লরিরেট’ রবীন্দ্রনাথের তখন অভিনন্দনের জোয়ার চ’লেছে….দিনে দিনে ভক্তমণ্ডলী দেখা দিচ্ছে দিকে দিকে। হিন্দি সাহিত্যে আধুনিকতা সূত্রপাত হয়েছে। নাটকে, গল্পে, উপন্যাসে হিন্দি সাহিত্যিকরা বাংলা সাহিত্যের অক্ষয় রত্নভাণ্ডার হ’তে সম্পদ আহরণ করে আপন সাহিত্য সমৃদ্ধ করে চ’লেছেন। সুতরাং এ অবস্থায়, রবীন্দ্রনাথের ক্রমবর্ধমান ‘গুরু’ গৌরবের সঙ্গে, হিন্দি কবিরা যে বাংলা সাহিত্যের প্রতিচ্ছায়া আপন আপন কাব্যে দেখতে চাইবেন এটা খুবই স্বাভাবিক।


একদল কবি রবীন্দ্রনাথের ভাব, ভাষা, ছন্দকে আদর্শ করে হিন্দি সাহিত্যের সমৃদ্ধি বিধানে অগ্রসর হলেন। এঁদের বলা হয়ে থাকে ‘ছায়াবাদী’। হিন্দি কবিগোষ্ঠীর মধ্যে গতানুগতিক কাব্যধারার প্রতি ঔদাসীন্য এমন ক’রে আর কেউ কোনও দিন দেখাননি। এই ‘ছায়াবাদী মূলত রবীন্দ্রনাথের ছায়ানুগমনের নামান্তর হলেও হিন্দিতে ‘ছায়াবাদ’ ঠিক সে অর্থে প্রযুক্ত হয়নি। ‘ছায়াবাদ ঔর রহস্যবাদ’ গ্রন্থের লেখক গঙ্গাপ্রসাদ পাণ্ডের মতে ‘ছায়াবাদ’ হ’ল এই পরিদৃশ্যমান রূপজগতে রূপাতীতের ছায়ানুভব, অথবা বলা যেতে পারে যে, লেখকের আন্তর উপলব্ধির রঙে বহির্বিশ্বের অনুরঞ্জনই ছায়াবাদ। শ্রীমতী মহাদেবী বর্মা ‘ছায়াবাদ এর আলোচনা প্রসঙ্গে বলেছেন যে বহির্বিশ্বের আপাতবিচ্ছিন্ন খণ্ডবস্তুসমূহের মধ্যে একটা অখণ্ডতা, একটা নিরবচ্ছিন্নতা অনুভব করেন ছায়াবাদীরা। তাঁরা জানেন পৃথিবীর প্রতিটি খণ্ড সুন্দরের মধ্য দিয়ে এক অখণ্ড সুন্দর আপনাকে নিরন্তর অভিব্যক্ত করে চলেছেন।


রবীন্দ্রনাথের মধ্যে এই উপলব্ধি যে অতি অল্প বয়সেই হয়েছিল তা ‘জীবনস্মৃতি’র পাঠকেরা জানেন। তিনি জল পড়ে, পাতা নড়ে, নারিকেল পাতার চিকণ মাধুর্য্য, পাখির ডাক—এই ‘সকল খণ্ড বিচ্ছিন্ন বস্তুতরঙ্গের সঙ্গে একটি অখণ্ড সুন্দর সমুদ্রের সম্বন্ধ’ বিষয়ে শৈশবেই সচেতন হয়েছিলেন (“all things that had seemed like graw waves were revealed to my mind in relation to a boundless sea.”); উত্তর জীবনে রবীন্দ্রনাথের সাধনার মূল কথা হল প্রকৃতির পরিদৃশ্যমান সীমার মধ্য দিয়ে সেই অচেনা অসীম পুরুষের সন্ধান। রবীন্দ্রনাথের ‘গীতাঞ্জলি’র অভিনন্দন এবং কবিখ্যাতির সঙ্গে সঙ্গে এই ‘ছায়াবাদ’-এর ছায়া নামল হিন্দি সাহিত্যে। পণ্ডিত শুক্রের ভাষায় : ‘য়হ শব্দ….রবীন্দ্র বাবু কী ধুম মচনে পর হিন্দি কে সাহিত্য ক্ষেত্র মেঁ ভী প্রকট হুয়া। হিন্দি সাহিত্য-ক্ষেত্রে বৃহৎ ত্রয়ী প্রসাদ-পত্ত নিরালার আবির্ভাবে ছায়াবাদী কাব্যশাখায় স্বর্ণযুগ উপস্থিত হ’ল।


বিষয়বস্তুতে রবীন্দ্রনাথের প্রতিচ্ছায়া :

নিম্নলিখিত বিষয়বস্তু রবীন্দ্রনাথের ছায়াপাত ঘটেছে—


(ক) প্রকৃতিকে সজীব সত্তা রূপে অনুভব, (খ) মানুষী প্রেমের রূপকে ঈশ্বর-এযণা নর নারীর প্রেমের রূপকে গ্রহণ করেছেন বাউল সম্ভ, বৈষ্ণব কবিদের মতো। (গ) দীনাতিদীন তৃণ-ধূলি হতে ‘প্রকাণ্ড’ পৰ্ব্বত অবধি সকল সীমাবদ্ধ রূপই অসীম অনন্ত অরূপের অভিব্যক্তি মাত্র। (ঘ) ‘সীমা’ ও ‘অসীম’-এর মিলন সাধনা। (ঙ) ভক্ত ভগবানের পারিভাষিক শব্দ ‘আমি’ ‘তুমি’। (ছ) সত্য শিব-সুন্দরই সাধনার চরম ও পরম লক্ষ্য। শেষোক্ত বিষয়টি সুমিত্রানন্দন পন্ত কর্তৃক হিন্দিতে বিশেষভাবে পরিগৃহীত হয়েছে।


শব্দ-রূপকে রবীন্দ্রনাথের ছায়া :

কেবল ভাব বা বিষয়বস্তুতেই ছায়াবাদীরা রবীন্দ্রনাথের ‘ছায়ামূর্তি’ বা ‘অনুচর’ নন, ভাষাতেও তাঁর রবীন্দ্র-পথগামী। রবীন্দ্রনাথের ভাষা ঠাকুরবাড়ির অনন্যসাধারণ বক্রোন্তিতে সংস্কৃতের কমলাকান্ত পদাবলির সার্থক অনুসৃতিতে মধুর। রবীন্দ্রনাথের মধ্যে মরমী সন্ত কবি এবং রোমান্টিক কবিদের প্রতীক ভাষার সম্মিলন লক্ষ করা যায়। রবীন্দ্রনাথের অসংখ্য শব্দ-প্রতীকের মধ্যে নিম্নোদ্ধৃত কয়েকটি বিশেষ প্রিয়— খেয়া, নাবিক, রজনীগন্ধা, রক্তজবা, দিনের শেষ, পূর্ব্বাচল, অস্তাচল ইত্যাদি।


ছায়াবাদীরা উদ্ভাবিত এই ধরনের নূতন প্রতীক-শব্দ সম্বন্ধে আলোচনা পণ্ডিত শুরু করেছেন তাঁর হিন্দি সাহিত্যের ইতিহাসে।


ছায়াবাদী কবিতায় রবীন্দ্রনাথের ছন্দ :

ছন্দের ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথের নবনবান্মেষশালিনী প্রতিভা কোনও দিন শ্রান্তি মানে না। নিত্য নূতন ছন্দের উদ্ভাবনে নিরন্তর ব্যস্ত রবীন্দ্রনাথ। রবীন্দ্রনাথের ছন্দে (১) মিত্রাক্ষরের এবং (২) মিলহীনতার দু-প্রকার ছন্দের প্রাধান্য লক্ষ করা যায়।


(১) মিত্রাক্ষর : বলাকার ছন্দ : রবীন্দ্রনাথের ‘বলাকা’ কাব্যগ্রন্থে ব্যবহৃত ছন্দ ‘বলাকার ছন্দ’ নামে বিশিষ্টতা লাভ করেছে বাংলায়। এই ছন্দ মিত্রাক্ষর অথচ অমিত্রাক্ষর, অর্থাৎ অভ্যানুপ্রাস বিশিষ্ট হলেও, অসমপক্তিক। বাংলা হতে ওড়িয়া, হিন্দি প্রভৃতি ভাষায় এই ছন্দ বিশেষ জনপ্রিয়তা অর্জ্জন করেছে। পক্তির এই প্রসারণশীলতা বা হ্রস্ব-দীর্ঘ কুঞ্জন ও প্রসারণশীলতা লক্ষ্য করে হিন্দিতে অনুকৃত এই ছন্দকে অনেকে ‘রবর ছন্দ (বা কেঁচুয়া ছন্দ) বলেছেন। হিন্দিতে নিরালা-জী এই ছন্দের প্রধান ভক্ত।


(২) মিলহীন ছন্দ : মিলহীন কবিতার মাত্রাসমকত্ব বা মাত্রাহীনতা দুইই দেখা যায়। অমিত্রাক্ষর জাতীয় মিলহীন ছন্দ মাত্রাভূমক নয় বলা চলে না, তাতে ছন্দের স্পন্দনটুকুও স্পষ্ট কবিতায় প্রান্তিক মিলহীনতা সত্ত্বেও অন্তঃস্থিত মাত্রাসমকত্ব রবীন্দ্রনাথের কবিতায় লক্ষ করা যায়। এ ছন্দ ‘পরিশেষ’-এ বিশেষ রূপে গৃহীত। মাত্রাহীন, মিলহীন (অনেকের মতে ছন্দহীন) ছন্দ কবিতায় ‘গদ্য ছন্দ’ নামে পরিচিত। ইংরাজিতে বলা হয় Prose-verse. ইংরেজ কবি ওয়াল্ট হুইটম্যান-এর ‘লীভস্ অফ গ্রাস্’ গদ্য-কবিতার সূত্রপাত ঘটে ১৮৫৫ সালে ‘হিন্দি সাহিত্য কা ইতিহাস’ গ্রন্থে।


পণ্ডিত শুক্লও গদ্য কবিতার উদ্ভব ও ক্রমবিকাশ বিষয়ে একই অভিমত দিয়েছেন (ওই : পৃষ্ঠা ৬৪১)। বাংলা সাহিত্যের একাধিক ঐতিহাসিকের মতে ওয়ালট হুইটম্যান এর অনুসরণে বাংলায় যে গদ্য কবিতা দেখা যায় তার প্রবর্ত্তক রাজকৃষ্ণ রায় এবং প্রচারক রবীন্দ্রনাথ। রবীন্দ্রনাথ ইংরাজি ‘গীতাঞ্জলি’তে গদ্য কবিতায় সিদ্ধিলাভ করার পর বাংলায় গদ্য কবিতা নিয়ে ব্যাপক চর্চা শুরু করেন। হিন্দিতে কবি ‘নিরালা’ সূর্যকান্ত ত্রিপাঠী) এ বিষয়ে রবীন্দ্রনাথের শ্রেষ্ঠ শিষ্য।


মধুসূদনের পয়ারভিত্তিক অমিত্রাক্ষর ছন্দ থেকে স্বতন্ত্র মাত্রাবৃত্তে যে ছন্দে বিখ্যাত বাঁশী’ (‘পরিশেষ’ কাব্যগ্রন্থে) কবিতাটি রবীন্দ্রনাথ রচনা করেছেন তার অনুসরণে ‘প্রসাদ’ এবং ‘নিরালা’ বিশিষ্টতা অর্জ্জন করেছে।



অনার্স বাংলা প্রথম পত্রের সব প্রশ্ন উত্তর
অনার্স বাংলা দ্বিতীয় পত্রের সব প্রশ্ন উত্তর
অনার্স বাংলা তৃতীয় পত্রের সব প্রশ্ন উত্তর
অনার্স বাংলা চতুর্থ পত্রের সব প্রশ্ন উত্তর
অনার্স বাংলা পঞ্চম পত্রের সব প্রশ্ন উত্তর
অনার্স বাংলা ষষ্ঠ পত্রের সব প্রশ্ন উত্তর
অনার্স বাংলা সপ্তম পত্রের সব প্রশ্ন উত্তর
অনার্স বাংলা অষ্টম পত্রের সব প্রশ্ন উত্তর