প্রহসন মাত্রেই হাস্যরসাত্মক, আর হাসির সঙ্গে থাকে নাট্যকারের সমাজচেতনা— তাই সে হাসি একটু উদ্দেশ্যমূলক ও ক্ষুরধার হয়ে দেখা দেয়। ‘একেই কি বলে সভ্যতায় মধুসূদনের হাস্যরস সৃষ্টি উদ্দেশ্যমূলক হলেও এতে অনাবিল পরিচ্ছন্ন কৌতুক হাস্যের উপাদানও যথেষ্ট। আসলে সাধারণ লঘু কৌতুক নাট্য এবং প্রহসন দুয়েরই লক্ষ্য থাকে একটি দিকেই বক্তব্য বিষয়ের অসংগতিকে তুলে ধরা। স্থিতিস্থাপকতার মধ্যে উৎকেন্দ্রিক অসংগতিই কৌতুকহাস্যের উপাদান। আলোচ্য নাট্যকে সে লক্ষণ দুর্লক্ষ্য নয়।

একদা মধুসূদনের দুটি প্রহসন সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে শশাঙ্কমোহন সেন মন্তব্য করেছেন—“এই দুটি প্রহসন মধুসূদন যেন একটা দুমুখো করাত হাতে লইয়াই যুগপৎ বিলাতি সভ্যতার বাঁদরামীকে এবং দেশীয় হিন্দুস্থানির ভণ্ডামিকে সরলভাবে কাটিয়েছেন। বিদেশি সভ্যতার বর্জ্য পদার্থগুলিকে গ্রহণ করে নবকুমার ও কাশীনাথ যে ভণ্ডামি ও বাঁদরামির পরিচয় দিয়েছে তাকে ব্যঙ্গ-বিদ্রুপের আঘাতে যেভাবে ছিন্নভিন্ন করেছেন নাট্যকার তাতে তাঁর Satire ধর্মী মনোভাবটি স্পষ্ট হয়ে ওঠে।

নাটকের প্রথম দৃশ্যেই কালীনাথ যেভাবে শ্রীমদ্ভাগবত গীতা ও জয়দেবের গীত গোবিন্দকে ‘শ্রীমতী ভাগবতীর গীতি’ এবং ‘বোপদেবের বিন্দা দূতী’ বলে উল্লেখ করেছে তাতে পাঠকের পক্ষে হাস্য সংবরণ করা অসম্ভব হয়ে পড়ে। নবুকমারের সঙ্গে কথোপকথন কালে যখন সে বলে যে—“সোনাগাছিতে আমার শত শাশুড়ীর আলয়” তখন একটু নিম্নস্তরের হলেও একটা হাস্যরস সৃষ্টি করে। নিজে ভণ্ড হয়েও যখন যে বৈষ্মব বাবাজিকে ‘হিপক্রিট’ বলে কিংবা নিজে নীতিহীন হয়েও সিকদার পাড়ায় বাবাজিকে দেখে ভীত নবকুমারকে যখন সে বলে ‘তোমার…মরাল কারেজ নেই’—তখন পাঠকের হৃদয়ে কৌতুক রসের ছটা ছড়িয়ে পড়ে।

সিকদার পাড়া স্ট্রিটে দুই বারাঙ্গনা যেভাবে বাবাজিকে নাস্তানাবুদ করেছে কিংবা পথচারী জনৈক মাতাল গেরুয়াবসনধারী বাবাজিকে দেখে বলেছে—“ওগো এখানে কোথায় যাত্রা হচ্ছে গো”—তখন খুব স্বাভাবিক ভাবেই দর্শকচিত্তে কৌতুকরস উচ্ছ্বসিত হয়ে ওঠে। লোভী উৎকোচ গ্রহণে পটু ও নারীসঙ্গলিপ্সু বাবাজির চরিত্রটি যেন হাস্যরসের খনি। গেরুয়া বসন, কপালে তিলক, হাতে জপমালা, মুখে সর্বদাই ‘রাধা কৃষ্ণ’ ভেকধারী এই বৈষ্মব যখন দুই সুন্দরী বারাঙ্গনাকে দেখে সতৃষ্ম নয়নে তাকায় তখন বাবাজির আসল স্বরূপটি দেখে দর্শকেরা কৌতুক অনুভব করে। চৌকিদার ও সার্জেন্টের হাতে ধরা পড়ে এবং তাদের হাতে ঠ্যাঙানি খেয়ে সে যখন কাকুতি মিনতি করে—‘আমি যাচ্ছি বাবা, আর মারিসনে বাবা, দোহাই বাবা, তোর পায়ে পড়ি বাবা, তখন বাবাজির হেনস্থা দেখে দর্শক উচ্চহাসিতে ফেটে পড়ে। অন্যদিকে সার্জেন্ট যখন থলির ভেতর থেকে জপমালা বের করে নিজের গলায় পরে রসিকতা করে— তখন সেই রসিকতাও দর্শকদের মনে হাস্যরসের উদ্রেক করে।

নবকুমার যেভাবে ইংরেজি বাংলা মিশ্রিত খিচুড়ি ভাষা ব্যবহার করেছে এবং যেভাবে জ্ঞানতরঙ্গিনী সভায় ঊনবিংশ শতাব্দীর মহৎ মানুষদের ব্যর্থ অনুকরণ করে বাগাড়ম্বরপূর্ণ বক্তৃতা দিয়েছে তা দর্শকদের মনে কৌতুক জাগায়। বাড়িতে ফিরে এসে মদের ঘোরে নিজ স্ত্রীকে সম্বোধন করে যখন সে বলে—“এ কী পয়োধরী যে? আরে এসো এসো, এ অভাজনকে কি ভাই তুমি এত ভালেবাস, যে এরজন্য ক্লেশ স্বীকার করে এত রাত্রে এই নিকুঞ্জ বনে এসেছো”— বিকারগ্রস্ত নবকুমারের এই প্রেমালাপ শুনে দর্শক উচ্চহাসিতে ফেটে পড়ে।

নাটকের অন্তিম দৃশ্যের একেবারে শেষ অংশে ভূলুণ্ঠিত নেশাগ্রস্ত নবকুমারকে দেখে পিতা ক্রোধান্বিত হয়ে যখন বলেন—“কাল প্রাতেই আমি তোমাদের সকলকে সঙ্গে নিয়ে শ্রীবৃন্দাবনে যাত্রা করব। এ লক্ষ্মীছাড়াকে আর এখানে রেখে কাজ নেই। চল এখন আমরা যাই। এ বানরটা একটু ঘুমুক।” তখন মদ্যপ নবকুমার নিজের অজ্ঞাতেই বলে ওঠে—“হিয়ার হিয়ার আই সেকেন্ড দি রেজোলুসন।” এ কৌতুক হাস্য উচ্চাঙ্গের। পিতা তাকে ‘বানর’ বলে সম্বোধন করছে, আর মাতাল নবকুমার নেশার ঘোরে তাকে সম্বোধন করছে—হাস্যরসের এ দৃষ্টাত্ত সাহিত্যে বড়ো বিরল।

সর্বোপরি, মধুসুদন আগাগোড়া এইভাবে তাঁর মনের সঞ্চিত বেদনা প্রকাশ করেছেন “একেই কি বলে সভ্যতা”য়। উৎকৃষ্ট humour-এর লক্ষণ এটাই। নবকুমার কালীনাথ, বাবাজি চরিত্রের অসঙ্গতি ও নানা ত্রুটি-বিচ্যুতি নিয়ে হাস্যরস সৃষ্টি করা হয়েছে বটে, কিন্তু কোথাও কোনো ব্যক্তিগত বিদ্বেষ ও ঈর্ষার জ্বালা প্রকাশ পায়নি। মাঝে মাঝে কিছু ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ থাকলেও মূলত প্রহসনটি যে প্রথম শ্রেণির humour তাতে কোনো সন্দেহ নেই।