‘গল্পের নাম ‘হালদারগোষ্ঠী’। গোষ্ঠী এখান পরিবার এবং পারিবারিক পরম্পরা এই অর্থে গ্রহণ করতে হবে। এই তথা পরিবারতন্ত্র রাজতন্ত্রেরই রকমফের। এই তত্ত্বেও একজন রাজা আছেন, তিনি পরিবারের কর্তা—পিতাই কর্তা। তিনি প্রকাশ্যে বা নেপথ্যে যেভাবেই থাকুন, তাঁর অমোঘ কর্তৃত্বে পরিবার নিয়ন্ত্রিত, নিয়মিত। তিনি প্রবীণ, শারীরিক শক্তিতে নয়, পদের গৌরবে পরিবারের সকল সদস্যের দণ্ডমুণ্ডের কর্তা। ‘হালদারগোষ্ঠী’ গল্পে মনোহরলাল সেই পদাধিকারী। তাঁর ‘সাবেককেলে বড়োমানুষি চাল’ । শুধু পরিবারের কর্তাই তিনি নন, তিনি তাঁর সমাজেরও ‘শিরোভূষণ’, ‘তিনি কাজ না-করিবার ও না-চলিবার বিপুল আয়োজনের কেন্দ্রস্থলে ধ্রুব হইয়া বিরাজ করেন। মনোহরলালের পরে হালদারগোষ্ঠীতে যার স্থান দ্বিতীয়ে, সে বনোয়ারিলাল, মনোহরলালের জ্যেষ্ঠ পুত্র। নিজের পদমর্যাদা বনোয়রিলাল পুরোপুরি ওয়াকিবহাল কিন্তু ‘যোগ্যতা এঞ্জিনের স্টীমের মতো তাহাকে ভিতর হইতে ঠেলে ; সামনে যদি সে রাস্তা পায় তো ভালোই, যদি না পায় তবে যাহা পায় তাহাকে ধাক্কা মারে। এই যোগ্যতা নিয়ে শক্তিমান পিতা, পিতৃতন্ত্র ও সামন্ততন্ত্রের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করলে ফল ভালো হওয়ার কথা নয়। অপিচ এই বিদ্রোহের পিছনে যদি পিতার পদ এবং কর্তৃত্বলাভের প্রলোভন না-থাকে। ‘লম্বাচওড়া পালোয়ানের চেহারা নিয়ে সে রাগ করলে তার ভয়ে লোকে অস্থির হতে পারে কিন্তু তার ‘ভিতরটা ভারি কোমল’। এই কোমলতার বশবর্তী হয়ে সে তার ছোটো ভাই বংশীলালকে মাতৃস্নেহে লালন করেছে, এই একই হৃদয়ের ‘ক্ষুধা’র বশবর্তী হয়ে ‘সুন্দরী স্ত্রী’কে—তার ‘ভরা যৌবন’ থাকা সত্ত্বেও অবিমিশ্র ভালোবাসা সম্ভব হয়নি, ‘কিরণলেখা তরুচ্ছায়ার মধ্যে পথহারা রশ্মিরেখাটুকুর মতোই ছোটো, ছোটো বলিয়াই সে তাহার স্বামীর মনে ভারি একটা দরদ জাগাইয়া রাখিয়াছে। এই কিরণলেখাকে ‘বসনে ভূষণে’ নানারকম করে সাজিয়ে দেখার তার বড়ো আগ্রহ, ‘তাহা ভোগ করিবার আনন্দ নহে, তাহা রচনা করিবার আনন্দ। কেবলমাত্র সংস্কৃত শ্লোক আবৃত্তি করে বনোয়ারির সে শখ মেটেনি, তার নিজের মধ্যে যে ‘পুরুষোচিত প্রভুশক্তি আছে তারও প্রকাশ ঘটানোর আগ্রহ তার সমাধিক, এবং বনোয়ারি চরিত্রের এতো প্রকার পরস্পরবিরুদ্ধে বৈশিষ্ট্যের জন্য ‘ধনীর সন্তান তাহার মানমর্যাদা’, তাহার সুন্দরী শ্ত্রী, তাহার ভরা যৌবন—সাধারণত লোকে যাহা কামনা করে সে-সমস্ত নিয়েও সে ‘সংসারে’ ‘একটা উৎপাতের মতো হয়ে উঠল। সাদাসিধে আত্মসন্তুষ্ট স্ত্রীর ‘সন্তোষগুণটি’ তার পীড়ার কারণ হয়ে উঠল। স্ত্রী যেমন তার সৌন্দর্য এবং গুণে তাকে অভিভূত করেছে, সেও তেমনি তার ‘প্রভুশক্তি’র প্রকাশ দিয়ে স্ত্রীকে অভিভূত করতে চায়। এবং যতো গোল সেখানেই, এরজন্য তার পরিবারতন্ত্র ও পিতৃতন্ত্রের সঙ্গে বিরোধ, পরিবারতন্ত্র ও পিতৃতন্ত্রের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ।
পিতার বিরুদ্ধে বনোয়ারির বিদ্রোহ প্রকাশ্য নয়, প্রচ্ছন্ন; কেননা পিতৃতন্ত্রে পিতার প্রত্যক্ষ সংগ্রামে অবতীর্ণ হওয়ার সুযোগ ও প্রয়োজন দুইই নেই, সে-কাজ সারবার জন্য মনোহরলালের মাইনে-কার এক অনুচর আছে, সে নীলকণ্ঠ, ‘বিষয়রক্ষার ভার এই নীলকণ্ঠের ওপার। সামন্ততন্ত্রে এই নীলকণ্ঠেরাই প্রধান—একাধারে অমাত্য মন্ত্রী কোষাধ্যক্ষ, এমনকি অতি-নিপুণ অতিনির্ভরযোগ্য বিশ্বস্ত সেনাপতিও। এই ‘নীলকণ্ঠের দেহে তাহার অস্থিকঙ্কালের উপর কোনোপ্রকার আব্বু নাই বলিলেই হয়। বাবুর ঐশ্বর্য ভাণ্ডারের দ্বারে সে মূর্তিমান দুর্ভিক্ষের মতো পাহারা দেয়। বিষয়টা মনোহরলালের কিন্তু তাহার মমতাটা সম্পূর্ণ নীলকণ্ঠের। এ-হেন ব্যক্তির সঙ্গে লেখাপড়াজানা, কাব্যরুচিসম্পন্ন, সর্বোপরি প্রেমাভিমানী, প্রেমের উপর প্রভুত্বকামী যুবা জমিদারনন্দনের যুদ্ধকরা এবং যুদ্ধে জয়লাভকরা সঙ্গত কিনা বলা যাবেনা, কিন্তু সম্ভব যে নয় তা নিঃসন্দেহে বলা যায়। জমিদারতন্ত্র ও পিতৃতন্ত্রের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ শেষমেশ জমিদারের ঐশ্বর্যভাণ্ডারের পাহারাদারে বিরুদ্ধে বিদ্রোহ হয়ে দাঁড়িয়েছে ক্রমশ, যে-বিষয় ও ঐশ্বর্যের ‘মমতটা’ সম্পূর্ণ ওই নীলকণ্ঠের যেহেতু—যারা পৃথিবীতে জন্মায় ‘প্রভুর সেবা’ করবারই জন্য ‘ইহারা যেন একপ্রকারের পুরুষ-মা, তাহাও নিজের ছেলের নহে, পরের ছেলের’।
বনোয়ারি বাড়ির ‘বড়োবাবু’, কর্তার প্রশ্রয়ে নীলকণ্ঠ সেই বড়োবাবুর উপর ‘প্রভুত্ব’ করে, এ-সমস্তে ‘যে অসুবিধা ও ও অপমান’ তা-ও বানোয়ারি সহ্য করে নিতে পারে, কিন্তু ‘পাঙ্খশরের তূণে মনের মতো শর জোগাবার অক্ষমতা’ স্ত্রীর ওপর প্রভুত্বকামী বনোয়ারি আদপেই সহ্য করতে পারেনা। ‘এমনি করিয়াই এই ধনীর সন্তান তাহার মানমর্যাদা, তাহার সুন্দরী স্ত্রী, তাহার ভরা যৌবন—সমস্ত লইয়াও সংসার একদিন একটা উৎপাতের মতো হইয়া উঠিল।
কাজেই, একটা তুচ্ছ, হালদারগোষ্ঠীর পরিবারের পক্ষে নিতান্তই নগণ্য ঘটনা একটা বিরাট গুরুত্ব পেয়ে গেল, সেই ঘটনার মধ্যে দিয়েই বনোয়ারির বিদ্রোহ প্রকাশ্য হয়ে পড়ল, নিছক বাইরের ঘটনায় শুধু হালদার গোষ্ঠীর সরলরৈখিক জীবনেও নয়, বনোয়ারির জীবনে অস্তিত্বের এবং মানসগতের সংকটও ঘনিয়ে তুলল।
মধুকৈবর্তের সঙ্গে হালদারগোষ্ঠীর কোনো আত্মিক নৈতিক বা ব্যবহারিক সম্পর্ক ছিল না, নিছক অর্থনৈতিক সম্পর্কসূত্র ছিল যৎসামান্য, যা হালদারগোষ্ঠীর প্রজাশাসন-কর্তৃত্বের কর্তা নীলকণ্ঠের দ্বারাই সেই সূত্র-সমস্যার সমীকরণের নির্বিঘ্ন সমাধান হতে পারত। কিন্তু ঘরের শত্রু যদি বিভীষণ হয়, তাহলে সহজ জিনিস কঠিন হয়ে পড়ে, জল গড়িয়ে যায় অনেকদূর।
একথা মনে করার কারণ নেই যে, এই সংকট-সংঘটনে জেলেদের প্রতিনিধি মধুকৈবর্তের কোনো হাত আছে, বা এই সংকট-সমস্যায় মধু জমিদারশক্তির বিরুদ্ধে পক্ষ। মধু নয়, হালদারগোষ্ঠীর বিরুদ্ধ পক্ষ যে সে হালদারগোষ্ঠীরই দ্বিতীয় স্থানধিকারী বনোয়ারি।
এদিকে বনোয়ারির শরণাপন্ন হওয়া নীলকণ্ঠের রোষে পড়ে মধুর ‘পেয়াদার উৎপীড়নে কৈবর্তপাড়ায় আর মানসম্ভ্রম থাকে না। কলকাতায় গিয়ে বন্দুক ও হীরের আংটি বিক্রি করে অর্থসংগ্রহ করে ফিরে সে মধুর ছেলের কাছ থেকে জানতে পারল, নীলকণ্ঠ মধুকে কাছারিতে বন্ধ করে রেখেছে। ‘বনোয়ারির সর্বশরীর কাঁপিতে লাগিল। কহিল, এখনি গিয়া থানায় খবর দিয়ে আয় গে। মধু পুলিশের সাহায্যে খালাস হল, পুলিশ নীলকণ্ঠ ও কাছারির কয়েকজন পেয়াদাকে আসামি করে ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে চালান করে দিল। বনোয়ারির টাকায় কলকাতা থেকে ব্যারিস্টার এল। তথাপি নীলকণ্ঠের জেল হল।
জেল থেকে ফিরে চতুর নীলকণ্ঠ বড়োবাবুর সঙ্গে প্রত্যক্ষ সংগ্রামের পথ পরিহার করে কৌশলের পথ অবলম্বন করল। মানরক্ষার জন্য মধুকে ভিটে ছাড়া করতে হয়। কিন্তু প্রত্যক্ষ সংগ্রাম নেমে পড়ল বনোয়ারি, সে নীলকণ্ঠকে পরিষ্কারভাবে জানিয়ে দিল ‘মধুকে উচ্ছেদ হইতে সে দিবে না’। মধুর সমস্ত দেনা সে শোধ করে দিল, নীলকণ্ঠ মধুকে বিপদে ফেলবার ‘উদ্যোগ’ করছে সেকথা ম্যাজিস্ট্রেটকে জানিয়েও এল। কিন্তু একদিন দেখা গেল—‘মধুর ঘরে তালা বন্ধ। রাতারাতি সে যে কোথায় গিয়াছে তাহার খবর নাই। নীলকণ্ঠের কৌশলে জমিদার সরকারের টাকায় মধু সপরিবারে কাশীবসে চলে গেছে। এখবর পুলিস জানে, কিন্তু প্রজারা গুজব শুনল—’মধুকে তাহার স্ত্রী-পুত্র-কন্যা-সমেত অমবস্যারাত্রে কালীর কাছে বলি দিয়া মৃতদেহগুলি ছালায় পুরিয়া মাঝগঙ্গায় ডুবাইয়া দেওয়া হইয়াছে। ভয়ে সকলের শরীর শিহরিয়া উঠিল এবং নীলকণ্ঠের প্রতি জনসাধারণের শ্রদ্ধা পূর্বের চেয়ে অনেক পরিমাণে বাড়িয়া গেল।
বনোয়ারির আপাতত শান্তি হল, কিন্তু, ‘সংসারটি তাহার কাছে আর পূর্বের মতো রহিল না। যে-বংশী তার অত্যন্ত স্নেহপাত্র ছিল তাকেও সে হালদারগোষ্ঠীর অন্যতম বলে মনে করল। আর একদা ‘হৃদয়বিহারিণী’ কিরণকেও হালদারগোষ্ঠীর বড়োবউ ছাড়া আর কিছু মনে করতে পারলনা।
ইতিমধ্যে বংশীর বিবাহ হয়েছে, ছোটোবউ একটি পুত্রসন্তানও লাভ করেছে, এই শিশুসন্তানের দৌলতে বংশীর ‘আদরের সীমা’ রইল না। বাড়িসুদ্ধ লোক ছেলেটিকে নিয়ে পড়ল। কিরণ তাকে এক মুহূর্ত কোল থেকে নামায় না, মধুকৈবর্তের ‘স্বভাবের কুটিলতার কথাও’ সে ভুলে গেল। বনোয়ারির বাৎসল্য ছিল গভীর, কিন্তু বংশীর ছেলে হলে তার মনে ‘একটু ঈর্ষার বেদনা’ জন্মেছিল, ক্রমে তা দূর হয়ে যায় ; তথাপি কিরণের ভ্রাতুষ্পুত্রের প্রতি আত্যন্তিক স্নেহপ্রকাশে শিশুটিকে বনোয়ারি স্বতঃস্ফূর্তভাবে ভালোবাসতে পারল না। কিরণকে দেখে বনোয়ারির মনে হল শিশুটিকে পেয়ে কিরণের ‘হৃদয় সত্যসত্যই পূর্ণ’ হয়েছে, আর তার নিজেকে মনে হল যে, সে ‘স্ত্রী হৃদয়ধর্মের একজন ভাড়াটে’।
এবার জন্মান্তর হল বনোয়ারির। সমস্ত ‘প্রাণের যত্ন’ দিয়ে শিশুটিকে মানুষ করতে লাগল । জন্মান্তর শুধু বনোয়ারির নয়, কিরণেরও হয়েছে। কেননা, দেখা গেল, ‘এই শিশু সম্বন্ধে কিরণ তাহার প্রতি বিশ্বাস হারাইয়াছে….কিরণের মনে সর্বদাই ভয়, পাছে বনোয়ারির বিদ্বেষদৃষ্টি ছেলেটির অমঙ্গল ঘটায়। অবশ্য শেষ অবধি ‘বাড়ির সকলের আদরে ক্রমে ছেলেটি বড়ো হইয়া উঠিল। সেও ‘ক্ষীণ এবং ক্ষণভঙ্গুর’, তাগা-তাবিজ-মাদুলিতে’ তার ‘সর্বাঙ্গ আচ্ছন্ন’ এবং ‘রক্ষকের দল’ সদাসর্বদা তাকে ঘিরে থাকে। এর ফাঁকে ফাঁকে মাঝেমধ্যে বনোয়ারির সঙ্গে শিশুটির মেশামেশি, দেখাসাক্ষাৎ। বনোয়ারির চাবুকের ওপর তার খুব ঝোঁক, বনোয়ারি সেই চাবুক বাতাসে সাঁই সাঁই শব্দে গুরিয়ে তাকে আনন্দ দেয়। কিন্তু তাকে ঘোড়ার ওপর বসিয়ে দিলে বাড়িসুদ্ধ লোক হাঁ-হাঁ করে ছুটে আসে। বনোয়ারি শিশুর সঙ্গে বন্দুক নিয়ে খেলা করলে কিরণ ছুটে এসে তাকে সরিয়ে নিয়ে যায়। বাড়ির কেউ, বিশেষত কিরণ বনোয়ারিকে বিশ্বাস করেনা।
আবার ঘটনা। প্রথমে মনোহরের স্ত্রীর, তারপর মনোহরের মৃত্যু। মৃত্যুর আগে মনোহর শিশু হরিদাসকে কিরণ এবং নীলকণ্ঠের হাতে সমর্পণ করে গেলেন। বনোয়ারির জন্য যাবজ্জীবন বরাদ্দ দুশো টাকা করে মাসোহারা। এবার বনোয়ারি বিদ্রোহ নয়, প্রতিবাদও নয়, ‘নীলকণ্ঠের পেন্সন’ খেয়ে বেঁচে থাকার অনিচ্ছা প্রকাশ করে কিরণকে নিয়ে কলকাতায় গিয়ে থাকার প্রস্তাব দিল। কিরণ আবার স্বামীকে ভুল বুঝল—’তাহার স্বামীর হৃদয় কী কঠিন। এই কচি ছেলের পরেও ঈর্ষা করিতে তাহার মন ওঠে? শুধু তাই নয়, তার মনে হল : ‘শ্বশুরের কুলে বাতি জ্বালিবার দীপটি তো ঘরে আসিয়াছে, এখন তাহার তৈলসঞ্চয় যাহাতে নষ্ট না হয় নীলকণ্ঠই তো তাহার উপযুক্ত প্রহরী।
নীলকণ্ঠ কর্তব্যপরায়ণ, অতএব কর্তার গুরুদায়িত্ব পালনের মহতী অবীপ্সায় সে ‘সমস্ত জিনিসপত্রের লিস্ট’ করতে এবং সমস্ত সিন্দুক বাক্স তালাচাবি লাগাতে ব্যস্ত হল। ক্রোধে ক্ষিপ্ত হয়ে বনোয়ারি নীলকণ্ঠকে তার ঘর থেকে বের হয়ে যেতে বলল। নীলকণ্ঠ নম্র কণ্ঠে বড়োবাবুকে জানাল, কর্তার উইল অনুসারে হরিদাসের পক্ষে সমস্ত বুঝে নেওয়া তার কর্তব্য, এমনকি ‘আসবার’ পর্যন্ত সবকিছুই তো হরিদাসের।
এরপর ক্লাইম্যাক্স। নীলকণ্ঠের সঙ্গে ‘সকলেই অন্তঃপুরে তৈজসপত্র ও গহনা প্রভৃতি খবরদারি করিতে গিয়াছে। অত্যন্ত সাবধান লোকেরও সাবধানতায় ত্রুটি থাকিয়া যায়। নীলকণ্ঠের হুঁশ ছিল না যে, কর্তার বাক্স খুলিয়া উইল বাহির করিবার পরে বাক্সয় চাবি লাগানো হয় নাই। সেই বাক্সয় তাড়া বাঁধা মূল্যবান সমস্ত দলিল ছিল। সুবর্ণসুযোগ বুঝে নীলকণ্ঠকে, সেইসঙ্গে হরিদাসকে ভরাডুবির মধ্যে ঠেলে দেওয়ার অসদুদ্দেশ্যে সেই দলিলের কাগজগুলি রুমালে জড়িয়ে বনোয়ারি বাড়ি থেকে বের হয়ে এসে সেগুলো চাঁপাতলায় লুকিয়ে রাখল। হঠাৎ অদূরে হাটের সংলগ্ন একটি বিধবার কুটিরে আগুন লাগার দৃশ্য দেখে সে স্থির থাকতে পারল না, দলিলের কাগজগুলো ফেলে রেখে সেই আগুন নেভাতে ছুটে গেল। ফিরে এসে কাগজের তাড়া খুঁজে পেলনা। তার মনে হল নীলকণ্ঠ তা হস্তগত করেছে। নীলকণ্ঠের সঙ্গে চাপান-উতোর চলল, নীলকণ্ঠের উদ্দেশে তর্জন-গর্জন চলল, কিন্তু নীলকণ্ঠ স্বীকার করল না। আসলে দলিলের কী পরিণতি হয়েছে তা তো নীলকণ্ঠ জানেই না, সে কীভাবে স্বীকার করবে ? পরে জানা গেল, বাঘের ছবি আঁকা রুমালের লোভে বালকটি পিতৃব্যের চুরিকরা ধনের ওপর বাটপাড়ি করেছিল। সে চাঁপাতলায় পড়ে থাকা রুমালের লোভে সেই রুমালের মধ্যে যা ছিল শেষমেশ সবশুদ্ধ জ্যাঠার হাতে ফিরিয়ে দিল।
আবার জন্মান্তর ঘটল বনোয়ারির। এবার catastrophe—উপসংস্কৃতি, রসপরিণাম। আনন্দে চোখের জল মুছে বনোয়ারি হরিদাসকে কাঁধে চড়িয়ে অন্তঃপুরে গেল। বনোয়ারির কাঁধের ওপর হরিদাসকে দেখে কিরণ উদ্বিগ্ন’ স্বরে বলল—’নামাইয়া দাও, নামাইয়া দাও—উহাকে তুমি ফেলিয়া দিবে?
কিরণ আবার স্বামীকে, তার মহৎহৃদয় স্বামীকে ভুল বুঝল। বাঞ্ছিতা প্রেমাস্পদার এহেন ক্ষুদ্রতা, সংকীর্ণতা, ক্ষুদ্ৰবুদ্ধি মহৎহৃদয় স্বামীরপক্ষে দুর্ভাগ্যজনক, দুঃসহ-দুর্বিসহ। বনোয়ারি হরিদাসকে কাঁধ থেকে নামিয়ে কিরণের কাছে তাকে এগিয়ে দিয়ে, ‘হরিদাসের বিষয় সম্পত্তির দলিল’ কাগজগুলো দিয়ে সেগুলো যত্ন করে রাখতে বলল। নিজে চোর সেজে সেই চোর আবার মালিকের রক্ষয়িত্রীর হাতে সেই চুরিকরা ধন ফিরিয়ে দিয়ে স্নেহের ভাইপোর হাতে তার লোভের বস্তু বাঘের মুখ আঁকা রুমালটাও—’জ্যাঠামশায়ের মূল্যবান সম্পত্তিটি ও দান করে দিল।
এরপর নিজের আশ্রয় খুঁজে নেওয়া সর্বাপেক্ষা জরুরি। কিরণের দিকে তাকিয়ে বনোয়ারিলাল দেখল, ‘সেই তন্বী এখন তো তন্বী নাই,—মোটা হইয়াছে….। এতদিনে হালদারগোষ্ঠীর বড়োবাউয়ের উপযুক্ত চেহারা তাহার ভরিয়া উঠিয়াছে। আর কেন, এখন অমরু-শতকের কবিতাগুলাও বনোয়ারির অন্য সম্পত্তির সঙ্গে বিসর্জন দেওয়াই ভালো। ‘তারপরেই বনোয়ারি অন্তর্ধান করল।
এইভাবে গোটা গল্প জুড়ে রয়েছে একটি পরিবারের কাহিনি সেই দিক থেকে বিচার করলে গল্পের নামকরণ সার্থক হয়েছে।
Leave a comment