কবি রবীন্দ্রনাথ যে অনন্যসাধারণ গদ্যশিল্পী তা আমরা তাঁর সাহিত্যজীবনের পর্বে পর্বে নানাভাবে উপলব্ধি করেছি। সাধু গদ্যরীতির কতো বৈচিত্র্য কতো বিপুল ঐশ্বর্য—যা বারবার আমাদের মুগ্ধ করেছে, বিস্মিত করেছে। চলিত গদ্যরীতিতে তাঁর অনায়াস সাবলীল ও সম্পন্ন বৈচিত্র্যভঙ্গি ‘কল্লোলে’র কলমবাজ গদ্যলেখকদেরও হতচকিত করেছে। ‘শেষের কবিতা’র কবিত্বমণ্ডিত ঝরঝরে ঋজু পেলব কঠিন গদ্যভঙ্গি দেখে ও পড়ে নিপুণ গদ্যকার বুদ্ধদেব বসুও উচ্ছ্বসিত হয়েছেন, রোমাঞ্চিত হয়েছেন। রাজর্ষি বউঠাকুরাণীর হাট থেকে নৌকাডুবি, নৌকাডুবি থেকে চোখের বালি, চোখের বালি থেকে গোরা, গোরা থেকে চতুরঙ্গ তারপর ঘরে বাইরে তারপর যোগাযোগ, শেষের কবিতা, শেষ পর্বে দুইবোন, চার অধ্যায়, মালঞ—গদ্যভঙ্গিতে পরিবর্তনের পর পরিবর্তন, ক্রম-উত্তরণ, ক্রম-পরিণতি, অথচ প্রতিটি পর্ব অভিনবই নয়, ঋদ্ধ, ক্রম-সমৃদ্ধ।

রবীন্দ্রগদ্যরীতির বিচিত্র ও বিপুল সৃষ্টিভাণ্ডারে আমাদের চোখ ধাঁধিয়ে যায়। তাই অনেক সময় আমরা তাঁর গল্পগুচ্ছের অতুলনীয় অনন্য গদ্যরীতির কথা ভুলে যাই। রবীন্দ্রগল্প যেমন বাংলাসাহিত্যে অপ্রতিদ্বন্দ্বী, তেমনি তুলনারহিত সেই গল্পের গদ্যরীতি। আমার তো মনে হয়, রবীন্দ্রনাথ যদি ছোটগল্পের ক্ষেত্রে তাঁর অননুকরণীয় সাধু গদ্যরীতি আশ্রয় না-করে চলিত গদ্যরীতি অবলম্বন করতেন তাহলে গল্পগুলি এতো উৎকর্ষলাভ করত না। এমনি বিশুদ্ধ চলিত ভাষায় সংলাপ সাধু-চলিত-মেশানো সংলাপের মতো অতো স্বাদু হয়ে উঠতো না।

ভাষা কাব্যবিষয়ের আধার। আধেয় যেমনই হোক আধার যথাযোগ্য ও উপযুক্ত না হলে বিষয় দাঁড়াতে পারে না। ছুটি, কাবুলিওয়ালা, দেনাপাওনা, অতিথি, শান্তি, নিশীথে, ক্ষুধিত পাষাণ, নষ্টনীড় ইত্যাদি গল্পের ভাষা গল্পের অবিকল্পযোগ্য আধার, চলিত গদ্যভাষায় এই জিনিসটি ঘটত কিনা নিঃসংশয়ে বলা কঠিন। স্ত্রীর পত্র, শেষকথা, রবিবার ল্যাবরেটরি প্রভৃতি চলিত গদ্যভাষায় লেখা গল্পগুলি বিষয় অনুসারী, পটভূমিকা ও চরিত্রানুগ, কিন্তু সাধু গদ্যভাষায় রচিত গল্পগুলিতে ভাষার যে-যাদু তা কি চলিত গদ্যভাষায় লেখা গল্পগুলিতে পাওয়া যায়?

হালদারগোষ্ঠী গল্পের কাহিনি পরিকল্পনায় যা-কিছু অভিনবত্ব তা বনোয়ারিলালের মানসগতের রূপচিত্রে, তার আত্মিক দ্বন্দ্বমথিত রূপান্তরে, পরিবর্তনে। কিন্তু গল্পের ঘটনা, চরিত্র সবকিছুই সাবেক কালের বলেই সাবেককালের পক্ষে সমসাময়িক এবং কিছু পরিমাণে আকর্ষণীয়, কিন্তু আমরা একালের পাঠকেরা সে-সবে তেমন করে কি আপ্লুত হতে পারি? হয়ত পুরনো জীবনধারার ছবি পেয়ে যাই বলে কানিকটা নস্ট্যালজিয়া ও রোমান্টিকতা আমাদের মন ছুঁয়ে যাই, তার বেশি প্রাপ্তি কোথায়?

মূলত টানে গল্পের ভাষা। প্রত্যক্ষতা পরিহার করে পরিহাস রসিকতা এবং সূক্ষ্ম হিউমার-ছোঁয়া গদ্য ভাষারীতি গল্পটির শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত অনবচ্ছিন্ন, যা আমাদের মগজ এবং মনের কাছে যথেষ্ট আকর্ষণীয় হয়ে থাকে।

গল্পের সূচনায় কোনো নাটকীয় ঘটনা নেই, কিন্তু নাটকীয়তা খুঁজে পাই ভাষায়। গল্পটি শুরু হয়েছে এইভাবে

‘এই পরিবারটির মধ্যে কোনোরকমের গোল বাধিবার কোনও সংগত কারণ ছিল না। অবস্থাও সচ্ছল, মানুষগুলিও কেহই মন্দ নহে, কি গোল বাধিল’

গল্পের প্রধান, কেন্দ্রীয় চরিত্র বনোয়ারিলালের পরিচয় সহজ বিবৃতির ভাষা ছেড়ে বক্র ভাষায়, তির্যক শব্দব্যবহারে কী চমৎকার ফুটেছে, নিচের অংশটি তার উদাহরণ

‘যে পরিবারের কথা উপস্থিত করিয়াছি তাহার মধ্যে সব চেয়ে যোগ্য মানুষ যে বনোয়ারিলাল, তাহাতে সন্দেহ নাই। সে নিজেও তাহা বিলক্ষণ জনে এবং সেইটেতেই তাহাকে অস্থির করিয়া তুলিয়াছে। যোগ্যতা ইঞ্জিনের স্টীমের মতো তাহাকে ভিতর হইতে ঠেলে, সামনে যদি সে রাস্তা পায় তো ভালোই, যদি না পায় তবে যাহা পায় তাহাকে ধাক্কা মারে।’

স্থূলাঙ্কর অংশটিতে বনোয়ারিলালের যে চরিত্রচিত্র আমাদের সামনে মূর্তিমান হয়ে দাঁড়ায়, গল্পটি পড়ার পর সেই মূর্তিটিই তার পরিণতিসহ যেন আমরা প্রোজ্জ্বলভাবে প্রত্যক্ষ করি। সহজ বর্ণনাধর্মী ভাষায় এ জিনিসটি হতে পারত মনে হয় না।

জমিদারতন্ত্রে জমিদারদের কর্মচারীদের (হালদারগোষ্ঠী গল্পে রামচরণ ও নীলকণ্ঠ) চরিত্র পরিচয় বা চরিত্রবৈশিষ্ট্য বোঝাতে রবীন্দ্রনাথ কী কুশলী ভাষা অবলম্বন করেছেন, দেখা যেতে পারে

‘….পৃথিবীতে একদল লোক জন্মায় সেবা করাই তাহাদের ধর্ম। তাহারা আপন প্রকৃতির চরিতার্থতার জন্যই এমন অক্ষম মানুষকে চায় যে-লোক নিজের ভার ষোলো আনাই তাহাদের উপর ছাড়িয়া দিতে পারে। এই সহজ সেবকেরা নিজের কাছে কোনো সুখ পায় না, কিন্তু আর-একজনকে নিশ্চিন্ত করা, তাহাকে সম্পূর্ণ আরামে রাখা, তাহাকে সকলপ্রকার সংকট হইতে বাঁচাইয়া চলা, লোকসমাজে তাহার সম্মানবৃদ্ধি করা, ইহাতেই তাহাদের পরম উৎসাহ। ইহারা যেন এক প্রকারের পুরুষ-মা ; তাহাও নিজের ছেলের নহে, পরের ছেলের।’

রোমান্টিপ্রকৃতি, লম্বাচওড়া, পালোয়ানের মতো চেহারা-বিশিষ্ট অথচ কোমল স্বভাব স্নেহপ্রবণ বনোয়ারি, যে ছোটো ভাই বংশীকে ছোটো বয়সে মাতৃস্নেহে লালন করেছে, যার ‘হৃদয়ে যেন একটি লালন করিবার ক্ষুধা আছে, তার বাইরের আকৃতির সঙ্গে ভিতরে প্রকৃতিটির পরিচয় দিতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ এভাবে কথা বলেছেন

‘তাহার স্ত্রীকে সে যে ভালোবাসে তাহার সঙ্গে এই জিনিসটিও জড়িত, এই লালন করিবার ইচ্ছা। কিরণলেখা তরুচ্ছায়ার মধ্যে পথহারা রশ্মিরেখাটুকুর মতোই ছোটো ছোটো বলিয়াই সে তাহার স্বামীর মনে ভারি একটু দরদ জাগাইয়া রাখিয়াছে; এই স্ত্রীকে বসনে ভূষণে নানারকম করিয়া সাজাইয়া দেখিতে তাহার বড়ো আগ্রহ।

একেবারে সাধারণ, সাদাসিধে, গড়পড়তায় স্ত্রীবুদ্ধিসম্পন্ন, অল্পে সুখী, অথচ সুন্দরী স্ত্রী কিরণলেখাকে বনোয়ারি নিজের মনোভূমিতে মনের ঐশ্বর্যে অপ্রাপণীয়া করে গড়ে তুলেছিল, কিন্তু গল্পের শেষে যখন তার নিজের ভুল ধরা পড়ল তখন তার অবস্থার বর্ণনা

‘….তাহার কিরণ, যাহার ধ্যানরূপটি যৌবনারম্ভের পূর্ব হইতেই ক্রমে ক্রমে তাহার হৃদয়ের লতাবিতানটিকে জড়াইয়া আচ্ছন্ন করিয়া রহিয়াছে, সেও সম্পূর্ণ তাহার নহে, সেও হালদারগোষ্ঠীর। একদিন ছিল, যখন নীলকণ্ঠের ফরমাশে-গড়া গহনা তাহার এই হৃদয়বিহারিণী কিরণের গায়ে ঠিকমতো মানাইত না বলিয়া বনোয়ারি খুঁতখুঁত করিত। আজ দেখিল, কালিদাস হইতে আরম্ভ করিয়া অমরু ও চৌর কবির যে-সমস্ত কবির সোহাগে সে প্রেয়সীকে মণ্ডিত করিয়া আসিয়াছে আজ তাহা এই হালদারগোষ্ঠীর বড়োবাউকে কিছুতেই মানাইতেছে না।’

অত্যন্ত বিষয়ী, আরামপ্রিয়, নিরুদ্বিগ্ধচিত্ত, আত্মসুখী জমিদারের চরিত্রের সঙ্গে মানানসই সাধুভাষার আশ্চর্য সংলাপ

“মনোহর অত্যন্ত বিরক্ত হইয়া কহিলেন, ‘আচ্ছা, আচ্ছা, নীলকণ্ঠ কী করে না-করে সে কথা তোমাকে ভাবিতে হইবে না। সেই সঙ্গে ইহাও বলিলেন, ‘দেখো দেখি, বংশীর তো‌ কোনো বালাই নাই । সে কেমন পড়াশুনা করিতেছে। ওই ছেলেটা তবু একটু মানুষের মতো।”

সংলাপের ভাষা, ভঙ্গি বিষয়ী মানুষটির সদর ও অন্দর মহল দুই-ই এক লহমায় ফুটিয়ে তোলে।

গল্পের শেষভাগে, যেখানে একদা-বঞ্ছিতা মনোরমা প্রিয়তমা কিরণলেখা সম্পর্কে, কিরণলেখার বাস্তব চালচিত্র সম্পর্কে বনোয়ারির বোধোদয় হল সেই অংশটি উদ্ধৃত করেই আলোচনা শেষ করব

‘তাহার পর আর-একবার ভালো করিয়া কিরণের দিকে তাকাইয়া দেখিল। দেখিল, সেই তন্বী এখন তো তন্বী নাই, কখন মোটা হইয়াছে সে তাহা লক্ষ্য করে নাই। এতদিনে হালদারগোষ্ঠীর বড়োবউয়ের উপযুক্ত চেহারা তাহার ভরিয়া উঠিয়াছে। আর কেন এখন আমরুশতকের কবিতাগুলাও বনোয়ারির অন্য সমস্ত সম্পত্তির সঙ্গে বিসর্জন দেওয়াই ভালো।

মোহভঙ্গের এমন ভাষা চলিত গদ্যরীতিতে এতোটা ফুটত কি ? দেখা যাক

তারপর আর একবার ভালো করে কিরণের দিকে তাকিয়ে দেখল। দেখল, সেই তন্বী এখন তো তন্বী নেই, কখন মোটা হয়েছে সে তা লক্ষ করে নি। এতদিনে হালদার গোষ্ঠীর বড়োবাউয়ের উপযুক্ত চেহারা তার ভরে উঠেছে। আর কেন, এখন অমরুশতকের কবিতাগুলোও বনোয়ারির অন্য সমস্ত সম্পত্তির সঙ্গে বিসর্জন দেওয়াই ভালো।