‘হালদারগোষ্ঠী’ গল্পের যে দুটি নারী চরিত্রকে আমরা সামনে আসতে দেখি তাদের মধ্যে একজন হল মধুকৈবর্তের স্ত্রী সুখদা আর অন্যজন হল বনোয়ারির স্ত্রী তথা হালদার বাড়ির বড়োবউ কিরণ। এ ছাড়া মনোহরলালের স্ত্রী তথা বাড়ির গিন্নীর উল্লেখ ও তার মৃত্যু সংবাদ অবগত হলেও তাকে পাঠকরা কেউ প্রত্যক্ষ করে নি। আর বংশীর পুত্র হরিদাসের জন্ম ও ক্রমশ বেড়ে ওঠার সংবাদ পেলেও বাড়ির ছোটোবউ-এর দেখা এমনকি নামোল্লেখ পর্যন্ত আলোচ্য গল্পে পাওয়া যায় না। ফলে আলোচ্য গল্পে আলোচনা যোগ্য দুটি মাত্র নারী চরিত্র রয়েছে। তারও মধ্যে কিরণ হল গল্পের নায়ক বা কেন্দ্রীয় চরিত্রের স্ত্রী। কিন্তু সুখদা সে তুলনায় কিছুই নয়। সুখদা ভিটে বাড়ির প্রজা মধুকৈবর্তের স্ত্রী। তাই স্বাভাবিক ভাবেই এই দুটি নারীর মধ্যে গল্পের মধ্যে অধিকতর স্থান ও গুরুত্ব পেয়েছে বনোয়ারির স্ত্রী তথা হালদার বাড়ির বড়োবউ কিরণ। কিন্তু ঘটনা সংঘটনের কারণে ক্ষণেকের জন্যে উপস্থিত হলেও সুখদার ভূমিকা অপরিসীম।
মধুকৈবর্তের স্ত্রী সুখদা, নিজের সংসারের দারিদ্র্য ও দীনতার কথা বোঝে। এবং সে তার স্বামীর পরামর্শ অনুযায়ী কাজও করে থাকে। বছর কয়েক আগে নদীতে বেড়াজাল ফেলবার জন্যে অন্যান্য জেলেদের সঙ্গে সেও প্রত্যেক বারের মতো মনোহরলালের কাছে থৎ লিখে এক হাজার টাকা ঋণ নিয়েছিল। আশা ছিল নদীতে মাছ ধরে সুদে আসলে সেই টাকা অনায়াসে শোধ দিতে পারবে। তাই চড়া সুদে টাকা নিতে তারা কেউই আপত্তি করে নি। বস্তুত লাভের আশায় অন্য কোনো চিন্তাকেই তারা তখন মনের মধ্যে ঠাই দেয় নি। কিন্তু তারপর থেকে পর পর তিন বৎসর নদীর বাঁকের মুখে এত কম মাছ এল যে তাদের খরচই পোষাল না, উপরন্তু তারা ঋণের জালে জড়িয়ে পড়ল। এই বেগতিক অবস্থা দেখে অন্যান্য জেলেরা যারা ভিন্ন এলাকার বাসিন্দা-তারা সরে পড়াতে সমস্ত ঋণের বোঝা এসে চাপল ভিটে বাড়ির প্রজা মধুকৈবর্তের ওপর। তার আর পালাবার উপায় রইল না। তখন আর উপায়ান্তর না দেখে, মধু তার স্ত্রী সুখদাকে কিরণের কাছে পাঠালো। কেননা সে জানতো কিরণের শাশুড়ি তথা হালদার বাড়ির গিন্নীর কাছে সুখদাকে পাঠালে কোনো ফল হবে না।
সুখদাও স্বামীর পরামর্শ মতো গিয়েছিল কিরণের পায়ে ধরে তাদের ঋণ মকুব করানোর আবেদন জানাতে। এই আবেদনের পশ্চাতে তাদের দুরভিসন্ধি এই ছিল যে, তারা জানতো হালদার পরিবারের আমলা নীলকণ্ঠের ওপর বনোয়ারির আক্রোশ আছে। আর কিরণকে বনোয়ারি প্রাণের চেয়ে বেশি ভালোবাসে। কাজেই কিরণের কাছে গিয়ে কান্নাকাটি করলে, কিরণ নিশ্চয়ই বনোয়ারিকে বলে ঋণ মকুব করার ব্যবস্থা করে দেবে।
কিরণ সুখদার আবেদনের উত্তরে তার অপারগতার কথা জানিয়ে দিয়েছিল। সংসারে নীলকণ্ঠের ব্যবস্থাপনায় যে কেউ আঁচড়টুকুও কাটতে পারে না সে কথা জানিয়ে সুখদাকে ফিরিয়ে দেবার উদ্যোগ করেছিল। কিন্তু তাদের এই বাক্যালাপ আড়াল থেকে বনোয়ারি শুনতে পেল। এবং কিরণ যে প্রতিকার করতে অক্ষম এই কথা তার বুকে শেলের মতো বিধল। সে ভাবল এই বিপদ থেকে মধুকৈবর্তকে উদ্ধার করতে পারলে তবেই কিরণকে যোগ্য উপহার প্রদান করা যায়। কেন না, সব স্ত্রীরাই স্বামীর ক্ষমতা ও পৌরুষ দেখতে আগ্রহী। অথচ, নীলকণ্ঠের তুল্য ক্ষমতা তার নেই এই কথা তাকে অশান্ত করে তুললো। এই ঘটনার পর থেকেই ঘটনা অন্য খাতে বইতে শুরু করল। সুখী শান্ত হালদার পরিবারে ত্তির পালাবদল শুরু হল। পদ্মবনে মত্ত হাতির দাপাদাপি প্রত্যক্ষগোচর হল।
হালদার পরিবারে এই অশান্তির আঁচ পর্যন্ত লাগতো না যদি মধু কৈবর্ত নিজে গিয়ে বনোয়ারিকে তার ঋণ মকুব করার কথা বলতো। বনোয়ারি অনায়াসে তাকে ফেরাতে পারতো, কিম্বা অন্য কোনো উপায় বাংলাতে পারতো। কিন্তু মধু যে চক্রান্ত করে তার স্ত্রী সুখদাকে বনোয়ারির স্ত্রী কিরণের কাছে পাঠিয়েছিল—তা থেকেই এই পরিবারের ভাঙন শুরু হয়েছিল। তাই আলোচ্য গল্পে মধুকৈবর্তের স্ত্রী সুখদার আবির্ভাব স্বল্প ক্ষণের হলেও তার গুরুত্ব অপরিসীম। এক কথায় বলা যেতে পারে যে সুখদাও আলোচ্য গল্পের মূল চাবিকাঠি।
Leave a comment