রবীন্দ্রনাথের ‘হালদারগোষ্ঠী’ গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র বনোয়ারিলাল হালদার পরিবারের বড়োছেলে। অর্থাৎ সে-ই ছিল পরিবারের ভবিষ্যৎ কর্তা। এ কথা সে জানতো। এবং সেই সঙ্গে এ কথাও জানতো যে এই পরিবারের সমুদয় সম্পত্তি সম্পদের একমাত্র অধিকারী হবে সে। কিন্তু যা হবে তা ভবিষ্যতে হবে। আপাতত বর্তমানে তার ইচ্ছে মতো অর্থব্যয় করার অধিকার নেই। যৌবনের প্রেমের আবেগপূর্ণ দিনগুলিতে যখন অর্থ তার একান্ত প্রয়োজন তখন তাকে অর্থ বরাদ্দের চেয়ে অধিক প্রয়োজনীয় অর্থের জন্যে বাড়ির বেতনভুক আমলা নীলকণ্ঠের অনুগ্রহের অপেক্ষা করতে হত। এমন কি স্ত্রী কিরণের জন্যে গয়না বানাতে দিলেও তার মনোমত গহনার ফরমাশ করার অধিকার নেই, কেন না, খরচটা নীলকণ্ঠের মাধ্যমে হবে। এই সব কারণে সে নীলকণ্ঠের ওপর অসন্তুষ্ট ছিল।

একদা মধুকৈবর্তের পক্ষে পরিবারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার ফলে কর্তা তার থেকে বিমুখ হয়েছিলেন। এমনকি ত্যজ্যপুত্র করতেও চেয়েছিলেন। কিন্তু তাতে অনেক ঝামেলা দেখে তিনি বনোয়ারির মুখ দর্শন করবেন না বলে হুকুম দিয়েছিলেন। সেই থেকে পিতাপুত্রের মধ্যে দেখাশোনা ও কথা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল।

বনোয়ারি তার স্ত্রী কিরণকে প্রাণের চেয়ে বেশি ভালোবাসতো। স্ত্রীকে খুশি করানোর জন্যে সে রকমারি পরিকল্পনা করতো, উপহার দিত। কিন্তু কোনো উপহারেই কিরণ উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠত না বলে বনোয়ারি মনে করতো উপহারটি তার স্ত্রীর পক্ষে মানানসই হয়নি। স্ত্রীর প্রতি তার এই রকম ভালোবাসার কথা ঘরে বাইরে কারো অজ্ঞাত ছিল না। ভিটে বাড়ির প্রজা মধুকৈবর্তও বনোয়ারির এই ভালোবাসাকে পুঁজি করে ঋণ মকুবের দরবার করতে তার স্ত্রী সুখদাকে কিরণের কাছে পাঠিয়েছিল। কেন না, সে জানতো কর্তা মনোহরলালকে অনুরোধ করে কোনো ফল হবে না, তিনি নীলকণ্ঠের কাছেই তাকে পাঠিয়ে দেবেন। তাই কিরণ যদি বনোয়ারিকে অনুরোধ করে তবে অনায়াসেই মধু ফল লাভ করতে পারে।

কিরণ সুখদাকে তার অপারগতার কথা জানালো। আড়াল থেকে সে কথা শুনতে পেয়ে বনোয়ারি ভাবল, এর প্রতিবিধান করতে যদি না পারে তবে সে কাপুরুষ। এই ভেবে সে পরিবারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করল। নিজের বন্দুক ও হীরের আংটি বিক্রি করে মধুর ঋণ পরিশোধ করল এবং নীলকণ্ঠকে হাজত বাস করাল।

এই ঘটনার পর থেকে বাড়ির অন্যান্য কাজে সকলেই বনোয়ারির পরামর্শের প্রত্যাশা ত্যাগ করল। এমনকি কিরণও দেবর বংশীর সঙ্গে স্বামীর অন্যায়ের প্রতিবাদী অনুযোগ করতে লাগল। এরই মধ্যে হালদার পরিবারে জন্ম হল বংশীর সন্তান হরিদাসের। কিরণ তাকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। কিছুদিন পরে ক্রমে ক্রমে মারা গেল বংশী, হালদার গিন্নী এবং কর্তা মনোহরলাল। তার পরেই জানা গেল কর্তা তাঁর সমস্ত বিষয় নাতি হরিদাসকে অর্পণ করে গেছেন এবং সে সম্পত্তি দেখা শোনার ভার দিয়ে গেছেন নীলকণ্ঠকে। আর বনোয়ারি কেবল মাসে মাসে দুশো টাকা পেনশন ভোগ করবে মাত্র।

এই সিদ্ধান্তে স্বাভাবিক ভাবেই বনোয়ারি অসন্তুষ্ট হয়েছিল। হালদার পরিবারের পরবর্তী কর্তা যার হওয়ার কথা ছিল, সে যখন কেবলমাত্র দুশো টাকা পেনশন ভোগীতে পরিণত হল, তখন স্বাভাবিক ভাবেই মনের দিক থেকে তার ভেঙে পড়ারই কথা। বনোয়ারিও ক্ষুব্ধ হয়ে পরিবারের বিনাশ ঘটাতে তৎপর হয়ে উঠল। সিন্দুক থেকে দলিলপত্র চুরি করে প্রতিবেশী ও প্রতিযোগী প্রতাপপুরের বাঁড়ুজ্যেদের হাতে তুলে দেবার ব্যবস্থায় প্রয়াসী হল।

কিন্তু এরই মধ্যে শিশু হরিদাসের সরলতা তাকে ভুলিয়ে দিল। তার সমস্ত রাগদ্বেষ ধুয়ে মুছে দিল। তখন সে দেখল, এই বংশে কেউ তাকে আর প্রয়োজনীয় বলে মনে করে না। সম্পত্তি থেকে সে বঞ্চিত, হরিদাসকে আদর করতে গেলে সকলে সন্দিহান হয়ে ওঠে। অথচ শাস্ত্রীয় অনুশাসন অনুযায়ী কেবলমাত্র পিতার শ্রাদ্ধাধিকারী বলেই নীলকণ্ঠ তার পরামর্শ প্রার্থনা করতে আসে। এমনকি তার স্ত্রী কিরণও তারই অলক্ষে কখন মোটাসোটা হয়ে হালদার বাড়ির গিন্নীতে পরিণত হয়ে গেছে। সে দেখল সবদিক থেকেই যেন এই পরিবারের পক্ষে সে বাহুল্য, অপ্রয়োজনীয়। সংসারে কোনো অধিকারই যার নেই, মৃতের প্রতি ঘটা করে লোকদেখানো শ্রাদ্ধের অধিকার নিয়ে সে কী করবে। তাই পিতার শ্রাদ্ধ না করেই বনোয়ারি চাকরির সন্ধানে চলে গিয়েছিল।