প্রায় সর্বক্ষেত্রেই দেখা গেছে যে, রবীন্দ্রনাথ নামকরণ করতেন নামীর স্বভাব ব্যক্ত করে। সে পদ্ধতি শুধু তাঁর সাহিত্য সৃষ্টির মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না। তিনি নামকরণ করতেন গাছপালার, ফুলেরও। এবং বলা বাহুল্য, সর্বক্ষেত্রেই তাঁর নামকরণ আদর্শ রূপেই বিবেচিত হয়েছিল। কোন মানব শিশুর নামকরণের সঙ্গে, সাহিত্যের সামগ্রীর নামকরণের কিছু পার্থক্য আছে। শিশুর নাম শ্রুতিমধুর এবং সহজ আহ্বান যোগ্য হলেই চলে, কিন্তু সাহিত্যের সামগ্রীর নামকরণের মধ্যে নিহিত থাকে নামকৃত উপাদানটির মর্মকথা বা উদ্দেশ্য বা কোন বিশেষ বক্তব্য। আবার কখনো বা গল্প বা উপন্যাসের পটভূমিই হয়ে থাকে শিল্পসামগ্রীর নামকরণ। আমাদের আলোচ্য ‘হালদারগোষ্ঠী’ গল্পের নামকরণ প্রসঙ্গেও এই একই কথা বলা চলে।
‘হালদারগোষ্ঠী’ গল্পটি একটি পরিবারিক গল্প। মনোহরলাল হালদারের পরিবারকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে গল্পটি। মনোহরলাল সুখী মানুষ। বিষয় সম্পত্তি রক্ষার ভার তাঁর বিশ্বস্ত অনুচর নীলকণ্ঠের ওপর ন্যস্ত করে নিশ্চিন্ত জীবন যাপন করছেন। সেই শান্তিপূর্ণ হালদার পরিবারের মধ্যে অশান্তি প্রবেশ করল বড়ো ছেলে বনোয়ারির আচরণের মধ্যে দিয়ে।
বনোয়ারি তার স্ত্রী কিরণকে খুব ভালোবাসে। স্ত্রীকে খুশি করার জন্যে সে নানা উপায় উদ্ভাবন করে। দুর্মূল্য দ্রব্যাদি উপহার দিয়ে সে কিরণের মন অধিকার করতে চায়। কিন্তু কিরণের মধ্যে বনোয়ারির এই আবেগ ধরা পড়ে না। ফলে বনোয়ারির স্ত্রীকে খুশি করার উপায় অন্বেষণের স্পৃহা আরো বেড়ে যায়। বনোয়ারিলালের এই দুর্বলতার সূত্রধরেই হালদার পরিবারের মধ্যে অশান্তি প্রবেশ করে।
মধু কৈবর্ত মাছ ধরার জন্যে চড়া সুদে মনোহরলালের কাছে প্রায় হাজার টাকা ঋণ করেছিল। কিন্তু লাভ না হওয়ায় তা পরিশোধ করতে পারে নি। এখন ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদ হওয়ার ভয়ে, ঋণ মকুব করার আর্জি জানাতে তার স্ত্রী সুখদাকে কিরণের কাছে পাঠিয়েছিল। কেন না, মধু জানতো হালদার পরিবারের বিষয় রক্ষক নীলকণ্ঠের সঙ্গে বনোয়ারির বনিবনা নেই। তাই নীলকণ্ঠকে উপেক্ষা করে বনোয়রির শরণাপন্ন হয়ে নিজের ভিটে মাটি রক্ষা করার উপায় নির্দ্ধারণ করেছিল সে। সুখদা কিরণের কাছে তাদের ঋণ মকুবের প্রার্থনা জানালে কিরণ তাকে বিষয়সম্পত্তির ব্যাপারে নিজেদের অপারগতার কথা জানিয়ে বিদায় করতে চেয়েছিল, কিন্তু আড়াল থেকে বনোয়ারি তাদের কথা শুনে, কিরণের মনে বিজয়গর্ব ধ্বনিত করার অভিপ্রায়ে নীলকণ্ঠের তথা হালদার পরিবারের ব্যবস্থার বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে বিদ্রোহ ঘোষণা করল। মনোহর তাতে এতই বিরক্ত হলেন যে পুত্রকে কেবলমাত্র ত্যাগ করতে বাকি রাখলেন।
এরই মাঝে অনেকদিন পরে বংশীর একটি পুত্র সন্তান হল। হালদার বংশের প্রথম সন্তান। নাম রাখা হল। হরিদাস। কিরণ হরিদাসকে নিয়ে এতই মেতে উঠল যে, বনোয়ারি হরিদাসকে আদর করতে গেলেও হরিদাসের অমঙ্গল আশঙ্কায় হাঁ হাঁ করে উঠতে লাগল।
ক্রমে ক্রমে বনোয়ারি সমস্ত পরিবারের থেকে মানসিকভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল। তারপর একদিন কর্তার মৃত্যুর পর জানা গেল—তিনি হরিদাসকে তাঁর সমস্ত সম্পত্তি দিয়ে গেছেন এবং নীলকণ্ঠকে তা দেখাশোনা করার দায়িত্ব দিয়ে গেছেন। বনোয়ারিকে দিয়ে গেছেন মাসে মাসে দুশো টাকা পেনসন ভোগ করার অধিকার। মনোহরলালের উইল পড়ে বনোয়ারি অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হয়ে সমস্ত সম্পত্তি নাশ করার বাসনায় কর্তার বাক্স থেকে দলিল চুরি করল। সে দলিলপত্র আকস্মিক কোনো বৃদ্ধার কুটির পুড়ে যাওয়ার ঘটনায় হারিয়েও ফেললো। পরে শিশু হরিদাস তাকে সেই দলিলপত্র খুঁজে এনে দিলে, বনোয়ারির ক্রোধ প্রশমিত হল। তার মনের ওপর থেকে জমাট বাঁধা বিদ্বেষ অপগত হল। তখন সে দেখল, তার স্ত্রী কিরণ কখন তার অলক্ষে হালদার বাড়ির গিন্নীর মতোই মোটাসোটা হয়ে গেছে। প্রেমের আবেগে আগে যাকে কিছুতেই বর্ণনা করতে পারতো না, কোনো কবিতা কোনো উপহার যার কাছে কিছুতেই মানানসই মনে হত না, সেই কিরণই যেন আজ অত্যন্ত সাধারণ গিন্নীর মতো রূপে তার সামনে প্রতিভাত হল। হঠাৎ মনে হল এই পরিবারে সে বাহুল্যমাত্র। মনে হওয়া মাত্র পিতার শ্রাদ্ধ পর্যন্ত না করে বাইরে চাকরি খুঁজতে চলে গেল। গ্রামের লোকেরা ধিক্ ধিক্ করতে লাগল।
আলোচ্য গল্পটির মধ্যে প্রাথমিকভাবে দেখা যায় যে সেখানে বনোয়ারির জীবনেতিহাস লিপিবদ্ধ হয়েছে কিন্তু গল্পের মধ্যে প্রধান রূপে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে নায়কের পরিচয়ের চেয়েও তার পরিবারের গতানুগতিকতা। বনোয়ারি নায়ক হলেও সে তার স্ত্রীর চোখে প্রথমে হালদার বংশের বড়োবাবু, তারপর তার অন্যান্য পরিচয়। এমনকি বনোয়ারির কর্মকৃতিত্ব বা অকৃতিত্বও কিরণের চোখে পড়ে না। কিরণ নিজেও প্রথমে হালদার বাড়ির বড়োবউ। আবার হরিদাস হল হালদার বংশের সন্তান। আলোচ্য গল্পের ঘটনা সংঘঠনও রচিত হয়েছে পরিবারের সম্পত্তি ও মান মর্যাদাকে কেন্দ্র করে। বনোয়ারিলালের চেয়ে বংশের কাহিনিই বিবৃত হয়েছে বেশি। তাই গল্পটির নাম ‘হালদার গোষ্ঠী’ রাখা সঙ্গত হয়েছে বলেই মনে করি।
Leave a comment