রবীন্দ্রনাথের ‘হালদারগোষ্ঠী’ গল্পের মধ্যে যে দুটি মাত্র স্ত্রী চরিত্র প্রাধান্য পেয়েছে তার মধ্যে অন্যতম তথা প্রধান স্ত্রী চরিত্র কিরণ। কিরণ হালদার বাড়ির বড়োবউ। সেই সঙ্গে আলোচ্য গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্রের সে স্ত্রী। অথচ নায়িকা চরিত্রের গুরুত্ব সে পায় নি। তার মধ্যে দিয়ে আমরা দেখতে পেয়েছি বনেদী বাড়ির বউকে—নিজের স্বামীর মর্যাদার তুলনায় বংশমর্যাদা যার কাছে অধিক প্রাধান্য পায়। এক কথায় তাকে বলা যেতে পারে হালদার পরিবারের উপযুক্ত বড়োবউ চরিত্র।

কিরণ বনোয়ারির স্ত্রী। বনোয়ারি তাকে খুব ভালোবাসে। ভালোবাসার জন্যে বনোয়ারি মহাসমুদ্রে ডুব দিয়ে মুক্তা তুলে আনতেও পারে। সেই ভালোবাসার প্রত্যুত্তরে কিরণ বরাবরই মৌন অথবা সম্বৃতবাক। বনোয়ারির মনের আবেগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে সে যেমন ভালোবাসার প্রত্যুত্তর দিতে পারে না, তেমনি পারে না স্বামীর আবেগকে প্রশমিত করতে। তাতেই উত্তরোত্তর বাড়তে থাকে বনোয়ারির স্ত্রীকে খুশি করার প্রবণতা। বনোয়ারির আশার মুখে ছাই দিয়ে সে দিনমানের অধিকাংশ সময় কাটায় তার ননদ ও অন্যান্য পুরজনদের সঙ্গে।

বস্তুত, সংসারের বড়োবউ হিসেবে যথা কর্তব্য সে করে থাকে, কিন্তু সেই সঙ্গে স্বামীর সঙ্গে তার যে ভাব বনোয়ারির আবেগ প্রবণ মনের তুলনায় তা মানানসই নয়। সে জানে তাদের অধিকারের সীমা কতটা বিস্তৃত, সে জানে কোন কাজটা সংসারের তথা পরিবারের পক্ষে মঙ্গলের, সে জানে পরিবারের কল্যাণের জন্যে কার সঙ্গে কি ভাবে ব্যবহার করতে হয় এবং কোন অন্যায় আবদারকে মূলেই বিনষ্ট করতে হয়। এই সব কারণেই সে মধুকৈবর্তের স্ত্রী সুখদাকে তাদের ঋণ মকুব করার অপারগতার কথা জানিয়ে ফিরিয়ে দিয়েছিল। বাড়ির আমলা নীলকণ্ঠের সঙ্গে বিষয় সম্পত্তি বুঝিয়ে দিতে যথা কর্তব্য সহায়তা অসঙ্কোচে করেছিল। নিজের সন্তান না হলেও দেবরের সন্তান তথা হালদারগোষ্ঠীর একমাত্র ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে বুকে করে সযত্নে মানুষ করছিল। এমন কি বনোয়ারি যে নীলকণ্ঠ তথা নিজের পরিবারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে উৎপাত শুরু করেছিল, তাতে কিরণ অসন্তুষ্টই হয়েছিল। কেন না, সে জানতো যে তার প্রথম পরিচয় হল সে এই পরিবারের বড়োবউ। এই বাড়ির সম্মান নষ্ট হওয়া মানেই তার সম্মান নষ্ট হওয়া। তাই তার কাছে সকলের প্রথমে বিচার্য ছিল হালদার বাড়ির সম্মান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে নির্বিঘ্নে মানুষ করা।

কিরণের মধ্যে উচিত অনুচিত জ্ঞান প্রবল ছিল। বনোয়ারির বিদ্রোহকে সে যেমন অনায়াসে অন্যায় বলে বুঝতে পেরেছিল, তেমনি মনোহরলাল যখন অত্যন্ত অসন্তুষ্ট হয়ে পুত্র বনোয়ারির মুখ দেখবেন না বলে আদেশ দিয়েছিলেন, সেই সময়ও কিরণের তা ভাল লাগে নি। তবে বনোয়ারির সমস্ত বিদ্রোহকে কিরণ অন্যায় বলতে পারে নি। বিশেষ করে কিরণের কোনো সন্তান সম্ভাবনা না থাকায় নীলকণ্ঠ বনোয়ারির পুনরায় বিবাহের প্রস্তাব কর্তার কাছে করেছিল। সেই সময় বনোয়ারি নীলকণ্ঠের এই প্রয়াসের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিল। এই বিদ্রোহকে অন্যায় বলে মনে করতে পারে নি কিরণ। প্রকৃতপক্ষে কিরণের যে চরিত্র আলোচ্য গল্পের মধ্যে চিত্রিত হয়েছে, তাতে সে এক বনেদী বাড়ির বড়োবউ। বড়োবউ-এর যে কর্তব্য স্বাভাবিক সে তা-ই করে গেছে। তার চরিত্রে সে রকম উল্লেখযোগ্য কোন বিশেষ উপাদান দৃষ্ট হয় না।