অথবা, হাম্মুরাবির আইন সংহিতার বর্ণনা দাও এবং মানব সভ্যতায় এর অবদান মুল্যায়ন কর।
ভূমিকাঃ ব্যাবিলনীয় সভ্যতা মেসােপটেমিয়া সভ্যতার দ্বিতীয় অধ্যায়। কোনাে কোনাে ঐতিহাসিকের মতে, খ্রিস্টপূর্ব চার হাজার বছর পূর্বে ইরাকের ব্যাবিলনে এ সভ্যতার উদ্ভব ঘটেছিল। ব্যাবিলনীয় সভ্যতার পূর্ণ বিকাশ ঘটে প্রসিদ্ধ সম্রাট হাম্মুরাবির আমলে। তিনি সমগ্র মেসােপটেমিয়ায় কর্তৃত্ব স্থাপন করে ভূমধ্যসাগর পর্যন্ত রাজ্য সীমানা বিস্তৃত করেন। ব্যাবিলনের শ্রেষ্ঠ নৃ-পতি হাম্মুরাবী একটি সুষ্ঠু মানবাধিকার সম্পন্ন ও সত্যনিষ্ঠার ওপর প্রতিষ্ঠিত আইন প্রণয়ন করে বিশ্ব সভ্যতায় এক অনবদ্য অবদান রাখেন।
(১) হাম্মুরাবির কৃতিত্বঃ সম্রাট হাম্মুরাবি শুধু বিরাট সাম্রাজ্যের অধিকারীই ছিলেন না। তিনি একটি বিখ্যাত আইন সংহিতা প্রণয়ন করে ইতিহাসে খ্যাতি লাভ করেন। হাম্মুরাবির আইন সংহিতা থেকে প্রাচীন ব্যাবিলনের সমাজ ও অর্থনীতি সম্বন্ধে অনেক কিছু জানা যায়। হাম্মুরাবির পর তার সাম্রাজ্য ক্রমশ শক্তিহীন হতে থাকে। খ্রিস্টপূর্ব ১৬৫০-এর দিকে ক্যাসাইটরা ব্যাবিলন জয় করে নেয়। বর্বর ক্যাসাইটরা ব্যাবিলনের সংস্কৃতির প্রতি আগ্রহান্বিত ছিল না।
(২) হাম্মুরাবির আইন সংহিতার সংরক্ষণঃ সম্রাট হাম্মুরাবি তার রাজত্বের শেষের দিকে তার আদেশিত বিধানমালা প্রস্তর স্তম্ভে খােদাই করার নির্দেশ দেন। এ খােদাই করা প্রস্তরগুলি বিভিন্ন মন্দিরে স্থাপন করা হয়। এরকম একটি প্রস্তর স্তম্ভ সিপপার শহরে শামাস দেবতার মন্দিরে স্থাপন করা হয়েছিল। খ্রিস্টপূর্ব দ্বাদশ শতকে পশ্চিম ইরানে দুর্ধর্ষ এলামিয়রা এটিকে যুদ্ধে লুষ্ঠিত দ্রব্য হিসেবে তাদের রাজধানী সুসায় নিয়ে যায়। ফরাসি প্রত্নতত্ত্ববিদরা ১৯০১ সালে এটিকে সুসার ধ্বংসাবশেষ খুঁড়ে বের করেন। তখন থেকেই প্রস্তর খণ্ডটি প্যারিসের লুভ যাদুঘরের সংগ্রহশালায় রক্ষিত আছে। এটি আট ফুট উঁচু মসৃণ ব্যাসেল্ট পাথর।
(৩) হাম্মুরাবির আইন সংহিতার বিষয়বস্তুঃ হাম্মুরাবির বিধানমালা প্রস্তর স্তম্ভের ওপর লিখিত। তিনি প্রার্থনার ভঙ্গিতে সিংহাসনে উপবিষ্ট শামাস দেবতার সামনে দাঁড়িয়ে আছেন। দেবতা শামাস তাকে এ আইন সংহিতা দেন- এরকম একটা দৃশ্যও খােদাই করা আছে। স্তম্ভের বাকি অংশের সামনে ও পেছনে দু’দিকে সংবাদপত্রের মতাে কলামে দু’শত বিরাশিটি আইন অত্যন্ত বিশুদ্ধ ব্যাবিলনীয় ভাষায় খােদাই করা আছে।
(৪) ভূসম্পত্তি আইনঃ ভূ-সম্পত্তি বিষয়ক আইনসমূহ হাম্মুরাবির সংহিতায় অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে বর্ণিত হয়েছে। দেশের অধিকাংশ ভূমি রাজকীয় মালিকানাধীন হলেও ব্যক্তিগত ভূ-সম্পত্তি রাখার বিধান আইন সংহিতায় আছে। ভূ-সম্পত্তি ক্রয়-বিক্রয় একটা যৌথ মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে সম্পাদিত হতাে। এ যৌথ মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানের একটা বিশেষ দায়িত্ব ছিল সেনাবাহিনী এবং জনকল্যাণমূলক সংস্থার জন্য লোকবল সংগ্রহ করা।
(৫) বিবাহ আইনঃ বিবাহ প্রথার জন্য কতকগুলি আইন প্রসিদ্ধ ছিল। ছেলের বিয়ে বাপ-মাকে ঠিক করতে হতাে। সাধারণত, কনের ব্যক্তিগত জিনিসপত্র বা সম্পত্তি অথবা আসবাবপত্র যৌতুক হিসেবে দেয়া হত। এগুলি কনের মৃত্যু পর্যন্ত তার নিজস্ব সম্পত্তি হিসেবে থাকতাে। প্রতিটি বিবাহ একটি চুক্তিপত্র দ্বারা বৈধ করতে হতাে। কনের পক্ষ অপর পক্ষকে পরিত্যাগ করলে এর ফলাফল সম্বন্ধে ঐ চুক্তিপত্রে উল্লেখ করা থাকতাে। চুক্তিপত্রে সম্মতির পর বর-কনে আইনসঙ্গত স্বামী-স্ত্রীতে পরিণত হতাে।
(৬) তালাক সংক্রান্ত আইনঃ কোনাে স্বামী স্বেচ্ছায় তার স্ত্রীকে তালাক দিতে পারতাে। কিন্তু তালাকপ্রাপ্তা স্ত্রীর এবং তার সন্তানের রক্ষণাবেক্ষণের ভার উক্ত স্বামীকে নিতে হতাে। সন্তান না থাকলে স্বামীকে স্ত্রীর যৌতুক এবং কনে পক্ষের সমান টাকা ফেরত দিতে হতাে। তবে স্ত্রীকে এগুলি পেতে প্রমাণ করতে হতাে যে, সে স্ত্রী হিসেবে তার দায়িত্ব যথাযথ পালন করেছে। অন্যথায় তাকে কোনাে ক্ষতিপূরণ দেয়া হতাে না। বরং তাকে তার সন্তানের ওপর দাবি হারাতে হতাে। স্ত্রীর পক্ষ থেকে স্বামীর অত্যাচার অথবা নির্যাতনের অভিযােগ এনে বিচ্ছেদ নেয়া সম্ভব ছিল।
(৭) উপ-পত্নীর বিধানঃ স্ত্রী অসুস্থ বা চিররুগ্না হলে স্বামী একজন উপপত্নী নিতে পারতাে। কিন্তু রুগ্ন স্ত্রী যতদিন জীবিত থাকত ততােদিন তার রক্ষণাবেক্ষণের ভার স্বামীর দায়িত্বে ছিল। একজন উপপত্নীকে স্ত্রীর সমান পূর্ণ মর্যাদা দেয়া হলেও তালাকের সময় বৈধ কারণে শুধু তালাক দেয়া চলতাে। স্ত্রীর মৃত্যুর পর যৌতুক তার সন্তানেরা পেত। উপপত্নী যদি ক্রীতদাসীও হতাে তার সন্তানেরা মুক্ত বলে ঘােষণা করা হতাে। তখন সন্তানের মাকে আর বিক্রি করা যেত না।
(৮) দত্তক নেয়ার বিধানঃ দত্তক নেয়াটা কতকগুলাে আইন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত ছিল। তবে পরিবারে চিরস্থায়ী অথবা ব্যবসার স্থায়িত্বের জন্য দত্তক নেয়ার প্রচলন ছিল। দত্তকপুত্র সাবালক হলেও তার আপন বাপ-মা তাকে ফেরত নিতে পারতাে না। দত্তক গ্রহণকারীর সন্তান হলেও সে আর দত্তকপুত্রকে ত্যাগ করতে পারতাে না। এ রকম অবস্থায় দত্তকপুত্র তার পালক পিতার সম্পত্তির একটা নির্দিষ্ট অংশ পেত।
(৯) মৃত্যুদণ্ডের বিধানঃ আইন সংহিতায় মৃত্যুদণ্ডের বিধান অকাতরেই দেয়া হয়েছে। শরীরের কোন অঙ্গ- অপরাধে কি ভূমিকা রেখেছে সেটা বিচার করে অঙ্গ ছেদের দণ্ড দেয়া হতাে। যে হাতে অপরাধ সংঘটিত হতাে সে হাত কেটে ফেলা হতাে। যে চোখ গােপনীয়তা লঙ্ঘন করেছে সে চোখ অন্ধ করার নির্দেশ আইনে ছিল। মিথ্যা অভিযােগকারীকে সর্বোচ্চ শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হতাে।
(১০) অন্যান্য কতিপয় আইনঃ ঘুষখাের বিচারককে চিরদিনের জন্য ক্ষমতাচ্যুত করা হতাে। অপরাধী স্ত্রী এবং কর্তব্য জ্ঞানশূন্য সন্তানকে দাস বানানাে যেত। অনিচ্ছাকৃতভাবে দুর্ঘটনা ঘটলে অথবা আহত করলে সাধারণত অপরাধ বলে বিবেচিত হতাে না। হত্যাকাণ্ডে অভিযুক্ত কোনাে ব্যক্তি যদি তার কাছে অনিচ্ছাকৃত বলে শপথ নিত তবে তাকে জরিমানা করে ছেড়ে দেয়া হতাে। কোনাে দুর্দান্ত ষাঁড় পথচারীকে গুতালে ষাড়ের মালিককে দায়ী করা হতাে।
পরিশেষঃ পরিশেষে বলা যায় যে, সভ্যতায় ব্যাবিলনীয়দের অবদান অনস্বীকার্য। হাম্মুরাবি কর্তৃক আইন সংকলনটি বিশ্ব সভ্যতার ইতিহাসে এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে সক্ষম হয়েছেন। আইন প্রণেতা হিসেবে তিনি বিশ্ব দরবারে খ্যাতি অর্জন করেন। যদিও তিনি প্রকৃতপক্ষে আইনের উদ্ভাবক নন বরং তিনি সুমেরীয় সম্রাট ডুঙ্গীর আইনকে গ্রহণ ও সংস্কার সাধনের মাধ্যমে একটি সুস্পষ্ট আইন কাঠামাে প্রণয়ন করেন।
Leave a comment