অথবা, মুহাম্মদ বিন কাসিম কর্তৃক সিন্ধু বিজয়ের কারণ ও ফলাফল আলােচনা কর।
অথবা, মুহাম্মদ বিন কাসিমের সিন্ধু অভিযানের কারণ ও ফলাফল আলােচনা কর।
অথবা, আরবদের সিন্ধু বিজয়ের বিবরণ দাও। এর গুরুত্ব আলােচনা কর।
উপস্থাপনাঃ উমাইয়া খলিফা ওয়ালিদের রাজত্বকালে আরবদের সিন্ধু বিজয়ের কাহিনী ইসলামের ইতিহাসের একটি চমকপ্রদ ঘটনা। মূলত এ বিজয়ের ধারা সর্বপ্রথম শুরু হয়েছিল মহানবী (স)-এর জীবদ্দশায়। পরবর্তীতে হযরত ওমর (রা)-এর খেলাফতকালে ৬৩৭ খ্রিস্টাব্দে কয়েকবার অভিযান পরিচালনা করে ব্যর্থ হওয়ার পর উমাইয়া শাসনামলে ৭১২ খ্রিস্টাব্দে মুহাম্মদ বিন কাসিমের নেতৃত্বে মুসলমানগণ সিন্ধুদেশ আক্রমণ করে ইসলামের বিজয় পতাকা উড্ডীন করেন। এ বিজয় সম্পর্কে ঐতিহাসিক আর. সি. মজুমদার বলেন- The Mohammedan Conquest of India is one of those epochmaking events which have left a permanent impress on subsequent pages.
আরবদের সিন্ধু বিজয়ের কারণঃ মুসলমানদের সিন্ধু অভিযানের কারণসমূহ নিম্নে আলােচনা করা হলাে-
ক. পরােক্ষ কারণঃ
১. মহানবী (স)-এর অনুপ্রেরণাঃ রাসূল (স) বলেছেন, আমার উম্মতের দুটি দলকে আল্লাহ তায়ালা জাহান্নামের আগুন থেকে রক্ষা করবেন। প্রথম দল যারা হিন্দুস্তানে যুদ্ধ করবে, দ্বিতীয় দল যারা হযরত ঈসা (আ)-এর সঙ্গী হবে। মহানবী (স)-এর এ প্রেরণামূলক বক্তব্যে মুসলমানরা ভারত অভিযানে উৎসাহী হয়ে ওঠে।
২. ভারতবর্ষে ইসলামঃ ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা হযরত ওমর (রা)-এর শাসনামলে ৬৩৭ খ্রিস্টাব্দে ভারত অভিযানের পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়, যা সফলতা লাভ করে উমাইয়া খলিফা ওয়ালিদের আমলে।
৩. হাজ্জাজ বিন ইউসুফের উচ্চাকাঙক্ষাঃ ইরাকের গভর্নর হাজ্জাজ বিন ইউসুফ ইসলামী শাসন পরিধি বৃদ্ধি ও বিস্তৃত করতে উৎসাহী ছিলেন। সে সময় সিন্ধু, মুলতান ও আরব সাম্রাজ্যের মধ্যে সাধারণ সীমান্ত ছিল। ঠিক এমন এক অবস্থায় নানাকারণে হাজ্জাজ বিন ইউসুফ ও সিন্ধু রাজা দাহিরের সঙ্গে মনােমালিন্য হয়, যখন মুসা বিন নুসায়ের ও তারেক বিন যিয়াদের আফ্রিকা ও স্পেন বিজয়ের সাফল্যে হাজ্জাজ অন্য কোনাে প্রাঙ্গণে ঝাঁপিয়ে পড়ার উচ্চাকাঙ্ক্ষী হয়ে উঠেন। ফলশ্রুতিতে জামাতা মুহাম্মদ বিন কাসিমকে সিন্ধু অভিযানে প্রেরণ করেন।
৪. উমাইয়াদের সম্প্রসারণ নীতিঃ উমাইয়া যুগ ছিল মুসলিম সম্প্রসারণের যুগ। উমাইয়া খলিফারা শাসনভার গ্রহণের পর নতুন নতুন দেশ জয়ের স্পৃহায় মেতে ওঠেন। তাদের উৎসাহ উদ্দীপনায় একদিকে তারিক বিন যিয়াদ স্পেনে, অন্যদিকে মুহাম্মদ বিন কাসিম সিন্ধুতে অভিযান পরিচালনা করেন।
৫. ইসলামকে বিজয়ী শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠাঃ সাম্রাজ্যের সম্প্রসারণের অভিযান প্রেরিত হলেও মূলত এর মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল ইসলামকে বিজয়ী শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে এলাকার বঞ্চিত নিপীড়িত মজলুম জনগণকে জালেমের হাত থেকে রক্ষা করা। এমন অনুপ্রেরণা নিয়েই বীর মুজাহিদ তারেক স্পেনে অভিযান পরিচালনা করেন। অপরদিকে মুহাম্মদ বিন কাসিম সিন্ধু জয় করে ভারতবর্ষে ইসলামের আলাে ছড়িয়ে দেন।
৬. পারস্যবাসীদের সাহায্যদানঃ আরব মুসলিমদের পারস্য তথা ইরান অভিযানের সময় ভারতীয় হিন্দু রাজন্যবর্গ এবং সিন্ধুর রাজা মুসলমানদের বিরুদ্ধে পারস্যবাসীদের সাথে একাত্মতা ঘােষণা করে তাদেরকে সামরিক সাহায্য সহযােগিতা প্রদান করে। ফলে একই সাথে পারসিক ও ভারতীয় বাহিনীর মােকাবেলা করতে হয়েছিল মুসলিম সেনাবাহিনীর। এজন্য মুসলমানরা তাদের ওপর চরম অসন্তুষ্ট হয়।
৭. সীমান্ত সংরক্ষণঃ মুসলিম বাহিনী কেরমান ও মাকরান অধিকার করায় মুসলিম সাম্রাজ্যের সীমানা সিন্ধু রাজ্যের সাথে মিশে ছিল। সিন্ধু রাজা দাহিরের শত্রুভাবাপন্ন মনােভাব ও সম্ভাব্য সামরিক আক্রমণ প্রতিহত করা এবং অরক্ষিত সীমান্ত সংরক্ষণ করার উদ্দেশ্যে আরবরা সিন্ধু আক্রমণ করে।
৮. বাণিজ্যিক সম্প্রসারণঃ উপমহাদেশের অফুরন্ত ধন-সম্পদ ও ঐশ্বর্য-বিভবের সাথে পূর্বকাল থেকেই আরব বণিকরা পরিচিত ছিল। কাজেই ব্যবসায় বাণিজ্যিক সম্প্রসারণের লক্ষ্যে মারবরা উর্বর ও সম্পদশালী ভারত জয়ে প্রলুব্ধ হয়ে উঠেছিল।
খ, অর্থনৈতিক কারণঃ আরব শাসকগণ বিপুল বিস্তৃত সাম্রাজ্য পরিচালনার ব্যয়ভার নির্বাহে অর্থ-সম্পদের প্রয়ােজন অনুভব করতেন। আর ভারতবর্ষের ধন-সম্পদের প্রাচুর্যের কথা রূপকথার ন্যায় বিশ্বময় ছড়িয়ে পড়েছিল। তাই ভারতের অফুরন্ত ধন সম্পদের ওপর নিজের অধিকার প্রতিষ্ঠার মনােবৃত্তি আরবদের সিন্ধু আক্রমণের অন্যতম কারণ বলে মনে করা হয়।
গ, রাজনৈতিক কারণঃ সিন্ধু রাজা দাহির ছিলেন অত্যাচারী শাসক। সেখানে বাহ্মণদের আধিপত্য ছিল। নিম্নশ্রেণির লােকেরা ছিল অত্যাচারিত। বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের কোনাে রাজনৈতিক অধিকার ছিল না। সর্বোপরি সিন্ধুতে চলছিল বিশঙখলা। এছাড়া রাজা দাহির অনেক আরব অপরাধীকে আইনের শাসন এড়িয়ে তার রাজ্যে আশ্রয় দিয়েছিলেন। সুতরাং হাজ্জাজ ভেবেছিলেন, দাহির জনপ্রিয় রাজা নন এবং সিন্ধু জয় করা তার পক্ষে তেমন কঠিন হবে না। তাই তিনি সিন্ধু জয় করে সাম্রাজ্যের বিস্তার ঘটাতে চেয়েছিলেন।
ঘ. প্রত্যক্ষ কারণঃ
১. জলদস্যু কর্তৃক জাহাজ লুণ্ঠনঃ আরবদের সিন্ধু আক্রমণের প্রত্যক্ষ কারণ ছিল সিন্ধু জলদস্যুদের আরব জাহাজ লুণ্ঠন। সিংহলের রাজা নানা উপটৌকনপূর্ণ আটটি জাহাজ খলিফা ওয়ালিদ ও হাজ্জাজ বিন ইউসুফের জন্য প্রেরণ করেন। জাহাজগুলাে দেবল বন্দরের উপকূলে পৌছলে জলদস্যুরা সব ধনরত্ন লুণ্ঠন করে। হাজ্জাজ দাহিরের নিকট এর ক্ষতিপূরণ দাবি করলে রাজা দাহির সে দাবি প্রত্যাখ্যান এবং ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ প্রদর্শন করে। ফলে দাহিরকে উপযুক্ত জবাব দেয়ার জন্য হাজ্জাজ সিন্ধুতে অভিযান প্রেরণ করেন।
২. আর বিদ্রোহীদের আশ্রয়দানঃ খলিফা ওয়ালিদের শাসনামলে ইরাকের বিদ্রোহী শিয়ারা রাজা দাহিরের আশ্রয় গ্রহণ করে। খলিফা ওয়ালিদের পূর্বাঞ্চলীয় শাসক হাজ্জাজ বিন ইউসুফ বিদ্রোহীদের ফেরত দেয়ার দাবি জানালে সিন্ধুরাজা দাহির এ দাবি প্রত্যাখ্যান করে। ফলে যুদ্ধের পরিবেশ সৃষ্টি হয়।
৩. নৌবাণিজ্যে বিঘ্ন দূরীকরণঃ আরবদের সামুদ্রিক বাণিজ্যের বিঘ্ন সৃষ্টিকারী জলদস্যুরা এবং সিন্ধুর জনগণের ওপর দাহিরের জুলুম নিপীড়ন ও কঠোরতা সিন্ধুর ওপর আরব অভিযানের নিমিত্ত ছিল।
সিন্ধু বিজয়ের ঘটনাঃ
১. ওবায়দুল্লাহ ও বুদাইলের পরাজয়ঃ উপরােল্লিখিত কারণগুলাের প্রেক্ষিতে উমাইয়া খলিফা ওয়ালিদের অনুমতিক্রমে হাজ্জাজ বিন ইউসুফ প্রথমে ওবায়দুল্লাহ ও পরে বুদাইলের নেতৃত্বে সিন্ধু রাজা দাহিরের বিরুদ্ধে পর পর দুটি অভিযান প্রেরণ করেন। কোনাে সেনাপতি অভিযানে সফল হয়নি; বরং উভয় সেনাপতিই তাদের হাতে শহীদ হলেন।
২. মুহাম্মদ বিন কাসিমের অভিযানঃ ওবায়দুল্লাহ ও বুদাইলের ব্যর্থতার পর হাজ্জাজ ১৭ বছর বয়সী মুহাম্মদ বিন কাসিমকে সিন্ধুতে তৃতীয় অভিযানে পাঠান। ৭১২ খ্রিস্টাব্দে ৬০০০ পদাতিক, ৬০০০ উষ্ট্রারােহী, ৩০০০ তীরন্দাজ সৈন্য এবং ৩০০০ ভারবাহী পশু নিয়ে কাসিম সিন্ধু আক্রমণ করেন। তিনি প্রথমেই দাইবুল দখল করেন। পরে খুব সহজে নিরুন, সিওয়ান দখল করেন। পরবর্তীতে তিনি রাজা দাহিরকে হত্যা করে রাওয়ার দুর্গ অধিকার করেন। রাওয়ার যুদ্ধে দাহির নিহত হলে দুর্গের পতন আসন্ন হয়ে পড়লে রাণীবাই অন্তঃপুরে অন্য মহিলাদের নিয়ে অগ্নিকুণ্ডে ঝাপিয়ে পড়ে ‘জওহর ব্রত’ পালন করেন। রাওয়ার দখলের পর মুহাম্মদ ব্রাহ্মণবাদ দখল করেন। এরপর সিন্ধুর রাজধানী আলাের দুর্গ জয় করে সমগ্র সিন্ধু অঞ্চলে সুশাসনের ব্যবস্থা করেন। এরপর আরাে উত্তরে অগ্রসর হয়ে মুলতান ও উচ দখল করে দাহিরের সমগ্র রাজ্যই মুসলমানদের দখলে নিয়ে আসেন।
৫. সিন্ধু বিজয়ের ফলাফলঃ ঐতিহাসিক মােহর আলী বলেন, আরবগণ, কর্তৃক সিন্ধু বিজয়ের ফলাফল সম্পর্কে যথেষ্ট মতভেদ থাকলেও ভারতবর্ষের ইতিহাসে সিন্ধু বিজয় নিঃসন্দেহে একটি তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা। এর ফলাফল ছিল সুদূরপ্রসারী। আমরা সিন্ধু বিজয়ের ফলাফলকে কয়েকভাবে সাজাতে পারি। যেমন-
ক. রাজনৈতিক ফলাফলঃ
১. মুসলিম শাসন অব্যাহতঃ সিন্ধু বিজয়ের ফলে আরবরা সিন্ধু অঞ্চলে এক উন্নত প্রশাসনিক ব্যবস্থা গড়ে তুলতে সক্ষম হয়। আল ওয়ালীদের পরবর্তী উমাইয়া শাসকদের আমলে এবং আব্বাসীয় আমলে সিন্ধুতে মুসলমানদের শাসন অব্যাহত ছিল।
২. মুসলিম বসতিস্থাপনঃ এ বিজয়ের ফলে আরব সৈন্য ও সাধারণ তীরব জনগণের কেউ কেউ এখানকার স্থানীয় রমণীদের বিয়ে করে সিন্ধুতেই স্থায়ীভাবে বসবাস করায় কালক্রমে মুসলিম বসতি ব্যাপকভাবে গড়ে উঠে।
৩. পরবর্তী বিজয়ের পথ উন্মুক্তঃ ঐতিহাসিক S. K. Benarje বলেন, মুহাম্মদ বিন কাসিমের সিন্ধু বিজয়ের ফলে সমগ্র হিমালয়ান উপমহাদেশে ইসলামী আদর্শের ভিত্তিতে রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার ভবিষ্যৎ সম্ভাবনার এক নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয়। কেননা সিন্ধু বিজয়ের পথ ধরেই পরবর্তীকালে গজনীর সুলতান মাহমুদ ও ঘুরী শাসক মুইজ্জুদ্দিন মুহাম্মদ বিন সাম উপমহাদেশে কর্তৃত্ব বিস্তারে সক্ষম হন।
খ. সামাজিক ফলাফলঃ
১. আরব ও ভারতীয়দের যােগসূত্রঃ এ বিজয়ের ফলে আরব ও ভারতীয়দের মধ্যে একটি নিবিড় যােগসূত্র স্থাপিত হয়। একে অপরের সংস্পর্শে এসে। উভয়ে উভয়ের দ্বারা প্রভাবিত হয়। সামাজিক অবিচার থেকে মুক্তি পাওয়ায় নিম্নশ্রেণির হিন্দুরা দলে দলে ইসলাম গ্রহণ করে। তারা মুসলমানদের সংস্পর্শে আসার ফলে ভারতীয় সমাজের বর্ণভেদ ও জাতিভেদ প্রথার কঠোরতা বহুলাংশে হ্রাস পায়।
২. মুসলমানদের ভারতীয় জ্ঞান-বিজ্ঞানের সংস্পর্শ লাভঃ সিন্ধু বিজয়ের ফলে মুসলমানরা প্রাচীন ভারতীয় জ্ঞান-বিজ্ঞানের সংস্পর্শে আসে। তারা উপমহাদেশে জ্যোতিষ, গণিত, চিকিৎসাশাস্ত্র, রসায়ন, সাহিত্য ও দর্শনশাস্ত্র চর্চার সুযােগ পায়। ভারতীয় সভ্যতা ও ইসলামী সভ্যতার মধ্যে যােগাযােগের ফলে দু’পক্ষই লাভবান হলাে।
গ. সাংস্কৃতিক ফলাফলঃ সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে আরবদের সিন্ধু বিজয়ের ফলাফল ছিল সর্বাপেক্ষা সুদূরপ্রসারী। সিন্ধু বিজয়ের ফলে গ্রিক, মিসরীয় এবং পারসিক সংস্কৃতিতে অভ্যস্থ আরবগণ ভারতীয় সংস্কৃতির সাথে সমন্বয় সাধনের সুযােগ লাভ করে। ফলে এ অঞ্চলে মুসলমানগণ ছিল এ সমন্বিত সংস্কৃতি ও সভ্যতার অধিবাসী। ভারতীয়দের জীবনধারা, নিয়মনীতি, পােশাক-পরিচ্ছদ, আচার-আচরণ পদ্ধতিতে মােট কথা জীবনের সকল ক্ষেত্রে আরবরা সাংস্কৃতিক পরিবর্তন এনেছিলেন।
ঘ. অর্থনৈতিক ফলাফলঃ
১. বাণিজ্যিক অগ্রগতিঃ ভারত উপমহাদেশে মুসলমানদের আগমনের ফলে এখানকার ব্যবসায় বাণিজ্যের উন্নতি অগ্রগতির এক অপরিসীম সম্ভাবনার দ্বার খুলে যায়।
২. সামুদ্রিক বাণিজ্যে একচেটিয়া কর্তৃত্বঃ ড. হাবিবুল্লাহ বলেন, “সিন্ধু বিজয়ের ফলে আরব সাগর ও ভারত মহাসাগরের উপকূলভাগের ওপর তথা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার উপকূলে আরব মুসলমানরা সামুদ্রিক বাণিজ্যের ওপর একচেটিয়া কর্তৃত্ব লাভ করে।”
৩. সমৃদ্ধশালী নগর গড়ে ওঠেঃ সিন্ধু বিজয়ের ফলে সিন্ধু ও মুলতানের বিভিন্ন স্থানে যেসব মুসলমান বসতি গড়ে ওঠে, সেসব স্থানে পরবর্তীকালে বহু সমৃদ্ধিশালী নগর গড়ে ওঠে। যেগুলাে পরবর্তীতে শিক্ষা, জ্ঞানচর্চা ও ব্যবসায়-বাণিজ্য কেন্দ্রে পরিণত হয়।
৪. বহির্বিশ্বের সাথে বাণিজ্যের দ্বার উন্মােচিতঃ এ বিজয়ের ফলে একদিকে ভারতবর্ষের সাথে বহির্বিশ্বের সামুদ্রিক বাণিজ্যদ্বার উন্মােচিত হয়, অপরদিকে সিন্ধ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বেশ কিছু সংখ্যক বাণিজ্য কেন্দ্র গড়ে ওঠে।
ঙ. ধর্মীয় ফলাফলঃ
১. ইসলামের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের সুযােগ সৃষ্টিঃ সিন্ধু বিজয়ের ফলে উপমহাদেশে দ্বীন ইসলামকে শ্রেষ্ঠ মতাদর্শ হিসেবে উপস্থাপন করার ব্যাপক সুযােগ সৃষ্টি হয়। ফলে স্থানীয় জনগণ ইসলামী আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে দলে দলে ইসলামের সুশীতল ছায়াতলে আশ্রয় গ্রহণ করে।
২. মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠতা সৃষ্টিঃ এ বিজয়ের ফলে সিন্ধু ও মুলতানের ব্যাপক জনগােষ্ঠী দলে দলে ইসলাম গ্রহণ করায় সে এলাকা কালক্রমে এ উপমহাদেশের অন্যতম সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চলে পরিণত হয়।
৩. আউলিয়া দরবেশদের আগমনঃ এ বিজয়ের ফলে অসংখ্য পীর, আউলিয়া, দরবেশ ভারত উপমহাদেশে ইসলাম প্রচারের উদ্দেশ্যে আগমন করে। তাদের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোেগ্য ছিলেন নিজামুদ্দিন, খাজা মঈনুদ্দিন চিশতী, শাহজালাল প্রমুখ ধর্মবেত্তাগণ।
৪. ভারতে নতুন জাতির উদ্ভবঃ সিন্ধু বিজয়ের ফলে মুসলিম ওলামা মাশায়েখ সুধীগণ সারাদেশে অবাধে ইসলাম প্রচারের সুযােগ পান। এতে স্থানীয় জনগণের সঙ্গে তাদের মেলামেশা বৃদ্ধি পায়। ফলে আরবি ও ভারতীয় সংমিশ্রণে অর্থাৎ আর্য ও সেমিটিক জাতির সংমিশ্রণে উপমহাদেশে একটি নতুন জাতির উদ্ভব ঘটে।
৫. মুসলমানদের বৈষয়িক জ্ঞান আহরণঃ আরব মুসলমানরা ভারতীয় হিন্দু পণ্ডিতগণের জ্ঞান বিজ্ঞান দ্বারা নিজেদের বৈষয়িক জ্ঞান সম্পর্কে অবগতি লাভে বেশ সাহায্য লাভ করে। এ কারণেই দেখা যায়, আব্বাসীয় শাসনামলে উপমহাদেশীয় প্রথম ইসলামী হুকুমত সিন্ধু রাজ্যের মাধ্যমে এ উপমহাদেশীয় বৈষয়িক জ্ঞান প্রজ্ঞার বিষয়সমূহের দ্বারা নিজেদের বৈষয়িক জ্ঞান ভাণ্ডারকে সমৃদ্ধ করতে চেষ্টা করেছিলেন।
৬. অনুবাদকর্মে সাফল্যঃ আব্বাসীয় শাসনামলে হিন্দু পণ্ডিতরা বাগদাদে আমন্ত্রিত হন। তারা সেখানে গিয়ে সংস্কৃত ভাষায় লিখিত জ্ঞানগর্ভমূলক বিভিন্ন গ্রন্থ আরবি ভাষায় অনুবাদকর্মে সাহায্য করেন। এ ব্যাপারে কতিপয় ঐতিহাসিক মনে করেন, অনুবাদের মাধ্যমে বিজাতীয় জ্ঞানের স্পর্শে আসায় একদিকে যেমন মুসলমানদের কিছুটা উপকার হয়েছে। অন্যদিকে তেমনি অসতর্কতাহেতু এমন অনেক বিষয়ও অনূদিত হয়েছে, যা আকিদা বিশ্বাসেও কিছুটা বিরূপ প্রভাব ফেলেছে।
উপসংহারঃ সিন্ধু বিজয়ের মধ্য দিয়ে আরবীয় মুসলমান ও ভারতীয় হিন্দুদের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক সৃষ্টি হয়েছিল, যার ফলে উভয়ের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবনে অগ্রগতির পথ প্রশস্ত হয়। সুতরাং আরবদের সিন্ধু বিজয় একটি নিষ্ফল বিজয় বলে মনে করলে সত্যের অপলাপ হবে। কারণ কালক্রমে এর স্থায়ী ফল ও প্রভাব সুপ্রতিষ্ঠিত হয়।
Leave a comment