উত্তরঃ বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসের সাথে মহামহােপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর (১৮৫৩-১৯৩১) নাম চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। কেননা বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের ইতিহাসে যে চর্যাপদ বা চর্যাগীতিকা মাইলস্টোন, সেই চর্যাপদের আবিষ্কারক, সংগ্রাহক ও সম্পাদক পণ্ডিতপ্রবর হরপ্রসাদ শাস্ত্রী।
পাঞ্জাবের মহারাজা রণজিৎসিংহের পুত্র রাধাকিষণ ১৮৬৮ খ্রিস্টাব্দে ভারতের সকল ভাষার পুঁথি সংরক্ষণের জন্য লর্ড লরেন্সকে অনুরােধ জানান। লরেন্স প্রাদেশিক গভর্নরদের সাথে পরামর্শ করে পুঁথি সংগ্রহের ব্যবস্থা করেন। বঙ্গীয় এশিয়াটিক সােসাইটি ড. রাজেন্দ্রলাল মিত্রের সাহায্যে পুঁথি সংগ্রহের কাজ শুরু করে। তার মৃত্যুতে ১৮৯১-এ মহামহােপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর উপর এ কাজের ভার পড়ে। দায়িত্বপ্রাপ্ত হয়ে তিনি ধর্মমঙ্গল ও শূন্যপুরাণের মত কিছু পুঁথি সংগ্রহ করেন। বৌদ্ধধর্ম ও বাংলার বৌদ্ধ সাহিত্য সম্পর্কে হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর জানার আগ্রহের কারণে তিনি ১৮৯৭ ও ১৮৯৮ খ্রিস্টাব্দে নেপাল যান। এ সময় তিনি ডাকার্ণব, সুভাষিত সংগ্রহ, দোহাকোষ, পঞ্জিকা ইত্যাদির নকল নেপাল থেকে সংগ্রহ করেন। ১৯০৭ সালে আবার তিনি নেপাল যান। সেখান থেকে ‘চর্যাচর্যবিনিশ্চয়’, ‘দোহাকোষ’ ইত্যাদির নকল নিয়ে আসেন। তাতে সাড়ে ছেচল্লিশটি পদ এবং সরহপাদের দোহা ছিল। প্রায় দশ বছর এর উপর গবেষণা ও নানা পাঠোদ্ধার করে ১৯১৬ খ্রিস্টাব্দে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ থেকে তার সম্পাদনায় চারটি গ্রন্থ একত্রে প্রকাশিত হয়। তিনি এই গ্রন্থের নাম দেন-“হাজার বছরের পুরানাে বাংলা ভাষায় বৌদ্ধ গান ও দোহা”। তার সম্পাদিত গ্রন্থে চর্যাপদ বা চর্যাগীতি কোষ, ডাকার্ণব, সরহপাদের দোহা ও কৃষ্ণ পাদের দোহা মােট চারটি গ্রন্থ ছিল। তার সম্পাদিত গ্রন্থে দুই ধরনের বিষয় ছিল একটি ধর্ম সম্বন্ধীয় বিধিনিষেধ বিষয়ক কিছু গান, অন্যগুলাে দোহা। ধর্ম সম্বন্ধীয় বিধিনিষেধগুলির নাম চর্যাচর্যবিনিশ্চয়। অর্থাৎ ধর্ম সাধনার ব্যাপারে কোনগুলাে আচরণীয় এবং সক বর্জনীয় তারই নির্দেশ। এগুলাের রচয়িতা ২৩ জন পদকর্তা। আর দোহাগুলাের স সরােজ বজ্র এবং কৃষ্ণাচার্য। চর্যাচর্যবিনিশ্চয়-এর তিনি নাম দেন চর্যাপদ। চর্যাপদ বৌদ্ধ ধর্মাচার্য সরােজবন্দ্র এবং কৃষ্ণাচার্য রচিত দোহাগুলাে একসঙ্গে একই গ্রন্থের অন্তর্গত বলে আচার্য হরপ্রসাদ শাস্ত্রী তার নাম দিয়েছিলেন “হাজার বছরের পুরানাে বাংলা ভাষা বৌদ্ধ গান ও দোহা”। চর্যাপদই এর মধ্যে কেবল প্রাচীন বাংলা ভাষায় রচিত বাংলা ভাষাভাষী মানুষের প্রথম কাব্য সংকলন (গীত সংকলন)।
প্রাচীন সাহিত্যের সংগ্রাহক, সম্পাদক ও গবেষক হিসেবে হরপ্রসাদ শাস্ত্রী আমাদের। চিরস্মরণীয় এবং তার সংগৃহীত ও সম্পাদিত “হাজার বছরের পুরানাে বাংলা ভাষায় বৌদ্ধ গান ও দোহা” গ্রন্থ বাংলা সাহিত্যের ভিত্তিভূমি হিসেবে নন্দনীয়।
Leave a comment