“নদীর ধারে বাস, ভাবনা বারাে মাস,”-
পাহাড়িয়া কোপাইয়ের গিরিমাটি গােলা জলভরা নদীর বাঁকটি যেন শ্যামলা মেয়ের গলায় সােনার হাঁসুলী, যে নদীতে বারাে মাস জোয়ারের জল উছলে উঠে নদীর কিনারা ছাপিয়ে সবুজ মাঠের মধ্যে ছলছলিয়ে ছড়িয়ে পড়ে। সে যেন গঙ্গা যমুনার ধারায় থৈ থৈ করছে এপার থেকে ওপার পারাপার করতে এ দেশের মানুষের বুক কেঁপে ওঠে। এই কোপাই নদীর একটি বিখ্যাত বাঁক হাঁসুলী যেখানে নারকেল সুপারির ছায়ার তলায় টিনতার বাঁশের ছোট বেড়া দিয়ে তৈরি ঘরের ছােট্ট ছােট্ট গ্রাম লুকিয়ে আছে। সেই নদী যেখানে অজগরের মতই ফুসছে, সেই তুফানে বাড়ি, গ্রাম, কন্দর সবকিছু ধুয়ে মুছে যায়। মানুষকে সেখানে বারাে মাস এক চোখ রাখতে হয় আকাশের কোলে কালাে মেঘের টুকরাের সন্ধানে আর এক চোখ রাখতে হয় সবুজ মাঠের ফসলের দিকে, অর্থাৎ ভাবনা তাদের বারােমাস।
“এসব পত্র দক্ষের মত সর্বময় কর্তা দন্ডদাতা।”
উদ্ধৃত অংশটি সাহিত্যিক তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘হাঁসুলী বাঁকের উপকথা উপন্যাসের অন্তর্গত। করালীর কুকুরটির বাঁশবাদির জঙ্গলে সাপে প্রাণ নিয়েছে। সেই ক্রোধে করালী কাহার পাড়ার বাঁশবেড়ের বাঁশ বনের তলায় আগুন ধরিয়ে দিয়েছে। বাঁশবাদির ধারে লােকজন স্তম্ভিত বিস্ময়ে দাঁড়িয়ে আছে। কাহার পাড়ার মাতব্বর প্রবীণ বনওয়ারী হাঁপাতে হাঁপাতে থমকে দাঁড়িয়ে বললাে কত্তার কোপ এবার রুদ্রমূর্তি ধারণ করে হে কত্তা, মাপ কর তুমি, বাঁচাও তুমি বাঁচাও হাঁসুলীর বাঁককে বাঁচাও, কারণ সে কাহার পাড়া বিচারকর্তা। প্রতিটি মানুষ তাঁকে শ্রদ্ধা ও ভক্তি করে। তাই সে কাহার পাড়ার ক্ষতি করতে দেবে না।
“এটি একটি বিশেষত্ব হাঁসুলী বাঁকের কাহার পাড়ার”
উদ্ধৃত উক্তিটি সাহিত্যিক তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘হাঁসুলী বাঁকের উপকথা উপন্যাস থেকে গৃহীত। হাঁসুলী বাঁকের কুসংস্কারাচ্ছন্ন কাহার পাড়ার গ্রামের মানুষগুলির মধ্যে ঝগড়া শুরু হলে সে ঝগড়া একদিনে মেটে না। প্রতিনিয়ত চলতেই থাকে। প্রাতঃকালে গালিগালাজের জেরটি টেনে তারা শুরু করে রাখে। ক্লান্ত হলে জিরিয়ে নিয়ে আবার সময়ে নিজের ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে বিপক্ষের বাড়ীর দিকে মুখ ফিরিয়ে এক এক দফা গালিগালাজ করে। এই রেওয়াজটি পুরুষনুক্রমে চলে আসছে, একে কলহ সংস্কৃতি বলা যায়। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য একদিকে থাকে কুসংস্কারাচ্ছন্ন সর্বশ্রেষ্ঠ প্রবীন বৃদ্ধা সুচাঁদ অন্যদিকে নায়নের মা।
“মন্থর গতিতে পায়ে হাঁটা আলপথে পদাতিকের জীবন তাদের।”
সূর্য উঠে পড়েছে হাঁসুলী বাঁকের গোপগ্রামের গাছপালা মাথা ছাড়িয়ে তার রক্তিম আভা বাঁশবাদির ঘরগুলির চালের উপর পড়েছে। কাহারেরা একে একে চলে যায় যে যার কাজে। হাঁসুলী বাঁকে গরুর গাড়ির পথ পর্যন্ত নেই। জাঙল পর্যন্ত ছিল রাস্তা-গাে-পথ। দুই দিকে শস্য ভূমি মাঝখানে সরু আলপথই ছিল হাঁসুলীবাকের কাহার পাড়ার মানুষদের চলার পথ। বাঁশবাঁদির কাহারদের পায়ে চলা পথের চেয়ে ভাল পথের দরকার ছিল না, সে হিসাবে তারা পদাতিক। মাথায় বােঝা বইতে হয়। এছাড়া হালের বলদ গরুর গাড়ি চালায় তাই সেই গতি আরও মন্থর তাই পায়ে চলা পথ ছাড়া অন্য পথের অভাব তারা অনুভব করে না।
“কাহার পাড়ার মানুষদের প্রকৃতি আছে, চরিত্র নাই।”
উদ্ধৃত উক্তিটি সাহিত্যিক তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘হাঁসুলী বাঁকের উপকথা’ উপন্যাস থেকে গৃহীত। হাঁসুলী বাঁকের কাহার পাড়ার শ্রমজীবী মানুষদের মন খুব সহজ সরল, তার ফলে নিজের এবং অপরের দুঃখে অল্পেই ওরা কেঁদে ফেলে। অথচ কুসংস্কারচ্ছন্ কাহার গােষ্ঠীর এক অশীতিপর বৃদ্ধা যে উপকথার কথক। মহাবনে মহাগজ পতনের সংবাদ পেলে কৌতুহলবশত দেখতে যায় এবং এতবড় দেহটি অসার হয়ে পড়ে থাকতে দেখে ভাবাবেগে অভিভূত হয়ে তার গলা জড়িয়ে ধরে কাঁদে। কাহারদের চোখের জলের স্পর্শে মৃত জীবন্ত হয়ে ওঠে না। ওদের কোনও পূর্ণতা নেই। সাহেবডাঙার গল্প শুনে চোখ মােছে, তবে তাঁর মতাে এত কাঁদতে কেউ পারে না। তাই তাদের প্রকৃতি আছে কিন্তু চরিত্র নেই।
“কিন্তু শক্তিহীন মনের বিস্মিত উদাসীনতার মধ্যে একটা অস্পষ্ট অনুমানের আভাষ ওদের বুকে জেগে ওঠে।”
কুসংস্কারাচ্ছন্ন আদ্যি কালের বুড়ী সকল দেবতার আদি দেবতা বাবা কালারুদ্দর পূজায় কাহার পাড়ার মাতব্বর প্রবীণ ভক্তপ্রাণ বনওয়ারী পাটায় শুয়ে দেবতাকে প্রণাম জানাচ্ছে। তার স্ত্রী গােপালীবালা জোড়হাত করে দাঁড়িয়ে আছে মজলিসের বেদীর সামনে। তার পাশে বসেছে উপকথার কথক অশীতিপর বৃদ্ধা সুচাদ। সে গল্প বলে, না বললে থাকতে পারে না। তার নাতনি পাখী বলে সৃষ্টি ছিল না তখন, চন্দ্র, পৃথিবী, মানুষ পশু পাখি না। চাঁদ তার উত্তরে বলে কিছুই না অন্ধকার, তখন আঁধার থমথম করত। চোখ বিস্ফোরিত করে বলে আঁধারের মধ্যে শুধু কালারুদ্দের চরক ঘুরছিল বব-ব-বন্ বন্ বন্। তার হাতখানি যেন সৃষ্টির আদিকালের দিকে প্রসারিত করেছিল। বাঁশবাদির মানুষদের আদিকাল থেকে আজ পর্যপ্ত কতকাল তার সংখ্যা বা পরিমাণ নির্ণয়ের শক্তি নেই, প্রয়ােজননেই, তাই তাদের সহজসরল মনের মধ্যে একটা অস্পষ্ট অনুমানের আভাষ ওদের বুকে জেগে উঠেছে।
“কালাে বউয়ের চোখ যেন কোপাই নদীর দহ”-
উদ্ধৃত উক্তিটি সাহিত্যিক তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘হাঁসুলী বাঁকের উপকথা উপন্যাস থেকে গৃহীত হয়েছে। কালাে বউ বলতে এখানে বােঝান হয়েছে কাহার পাড়ার মাতব্বর বনওয়ারী কাহারের অঙের মানুষ। হাঁসুলী বাঁকের কাহার রমণীর সাথে কোপাই নদীর রুপের তুলনা করেছেন লেখক। আষাঢ় থেকেই মা মরা ছােট মেয়ের বয়স বেড়ে ওঠে। যৌবনে ভরে যায় তার শরীর তারপর হঠাৎ যেমন এক একদিন বাপ মা ভাই ভাজের সাথে ঝগড়া করে, পাড়া পরশিকে শাপ শাপান্ত করে বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে পড়ে, গাঁয়ের পথে চুল পড়ে এলিয়ে, চোখে ছােটে আগুন। জ্ঞান শূন্য হয়ে ছুটে চলে কুলে কালি ছিটিয়ে দিয়ে তেমনি ভাবেই সেদিন ঐভরা নদী দুর্নিবার হয়ে ওঠে। ঠিক কালাে বউয়ের রূপও তেমন। কালাে বউ যেদিকে চায় বনওয়ারী চোখে মাতন লাগে। মাতব্বর বনওয়ারী নিজেকে রক্ষা করেও বারবার কালাে শশীর অমােঘ আকর্ষণে ক্ষত বিক্ষত হয়েছে, তার পবিত্রতাকে কালাে শশীর উন্মত্ত আবেগে মুহুর্মুহ্ বিচলিত করেছে।
“পৃথিবীতে যা আশ্চর্য, তাই হাঁসুলী বাঁকের ভয়ের বস্তু।”
উদ্ধৃত উক্তিটি সাহিত্যিক তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাঁসুলী বাঁকের উপকথা উপন্যাস থেকে গৃহীত হয়েছে। পৃথিবীর অন্য জায়গায় যা কিছু বস্তু আশ্চর্যের বিষয়, সেইসব আশ্চর্যগুলি হাঁসুলী বাঁকের বাঁশবাদির সহজ সরল শ্রমজীবী কাহার মানুষদের কাছে ভয়ের রূপ নেয়। পৃথিবীতে যে আশ্চর্যকে ঘেঁটে দেখার সময়ও নেই তার স্বরূপ নির্ণয় করার মতাে বুদ্ধির তাগিদও নেই। যদিওবা আদিকালে কখনও ছিল, বারবার সেগুলি ক্রমেই লুপ্ত হয়ে গেছে। সাহেব সদগােপ বাবুদের শাসন ঠেলে কখনও তা কঠিন ও ধারলাে হয়ে আশ্চর্যকে ভেদ করে ছেদ করে দেখাবার মত হয়ে বিক্রম লাভ করতে পারেনি তারা।
“ধর্মপথে অধিক রাতে ভাত”
উদ্ধৃতি উদ্ধৃতাংশটি সাহিত্যিক তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিখ্যাত উপন্যাস হাঁসুলী বাঁকের উপকথা থেকে গৃহীত হয়েছে। হাঁসুলী বাঁকের বাঁশবাঁদির কাহার পাড়ার মানুষগুলাে দুই পুরুষের আগে একসময় রাতের অন্ধকারে গেরস্থ বাড়িতে সিদ দিত ; সােনাদানা চুরি করত। তারপর পুলিশ এসে মা, বােন তুলে গালাগাল দিত থানায় হাজতে পুরে চালাত কিল চড় লাথি। দুই পুরুষে কাহারেরা চুরিচামারি করত কিন্তু আগের মত নয়, কোন জায়গায় চুরি হলে পুলিশ আসত কাহার পাড়ায়, ধরে বেঁধে নিয়ে যেত, বনওয়ারীর বাবা মাত্তব্বর হয়ে অনেক কষ্টে কাহারদের চোর নাম ঘােচাল। এই সব গল্প সুঁচাদ বলে। পাড়ার মাতব্বর বনওয়ারী কিন্তু এখন তা হতে দেবে না। বনওয়ারী চিন্তা করে যে ধর্ম পথে থাকে তার যদি উপবাসে দিন যায় তবে ধর্ম নিজে অর্ধেক রাত্রে তাকে অন্ন জুগিয়ে দেন। তাঁর মতে কাহারেরা কোনও অবস্থায় পাপ না করুক।
“এই কার্যকারণ সব তাে স্পষ্ট প্রত্যক্ষ”
উদ্ধৃত উদ্ধৃতাংশটি সাহিত্যিক তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিখ্যাত উপন্যাস হাঁসুলী বাঁকের উপকথা থেকে গৃহীত। পৃথিবীতে প্রতিটি কার্যের পিছনে একটি কারণ অবশ্যই থাকবে। তেমনি হাঁসুলী বাঁকের উপকথায় বিধাতা পুরুষ কাহার পাড়ার লােকের ললাটে তার ভাগ্যফল লিখে দেন। গত জন্মের যেমন কাজ তমনি ভাগ্যফল দেন। তা না হলে এই হাঁসুলী বাঁকে চন্দ্রবােড়া সাপ এখানে বিরল নয়। তার বিষে অনেকে প্রাণ দিয়েছে। কিন্তু ঠাকুরের গাছ পড়ল যেদিন সেদিনই পানার ছেলের মৃত্যু হল। পানার ঘরের কুকুরে ধরা উচ্ছিষ্ট পাঠা জরিমানা স্বরূপ চৌধুরী বাবুরা বাবার থানে বলি দিয়েছে। এই শাস্তিটা যাবে কোথায় ? কাহারেরা ভাবে এই দণ্ড বাবাঠাকুরের। পান্নার ছেলের মৃত্যুর জন্য পান্নাই দায়ী কারণ বাপের পাপে বেটার মৃত্যু। তাই কাহারের বাপের পাপ বলে এটি।
“পিথিমী ‘ছিষ্টি’ হল, কাহার ছিষ্টি করলেন বিধাতা ; কাহারদের মাতব্বরও ছিষ্টি হয়েছে সেই সলো।”
কাহার পাড়ার উপকথার কি আদি আছে, না আন্ত আছে? এগুলি আলাচনা হচ্ছিল হেঁপাে রােগী নয়ানের মৃত্যুতে শ্মশান যাত্রীদের মধ্যে। নয়ানদের বংশ এক সময় ছিল মাতব্বর বংশ। কাহারদের ভাবনায় পৃথিবী সৃষ্টি হল, পৃথিবীতে কাহার আর্বিভাবেই তাদের দ্বারা সৃষ্টি হল সমাজ-সংসার কাহারদের উপকথায় সৃষ্টি কর্তা। বাবা কালারুদুর তাদের আদি দেবতা। এইসব দেবতার আবিস্কারের সাথে সাথে কাহারদের মধ্যে মাতব্বর সৃষ্টি হয়েছে। আবার কত মাতব্বর নির্বংশ হয়েছে কে জানে তা, কে তার হিসাব রাখে ? এটাই হল হাঁসুলী বাঁকের মিথময় জগৎ; মুখে মুখে চলা চরিত্রহীন স্রষ্টাহীন গল্প যাতে একটা কাল নিজের সঙ্গে নিজে কথা বলে, যার মধ্যে লুকিয়ে থাকে বাস্তবের অজস্র রেনু।
“আউশের ধানে থােড় হয়েছে-
দশ মাসের পােয়াতীর মত থমথম করছে আউশের মাঠ।”
বর্ষাকালে সবুজ মাটিকে বেড়দিয়ে পাহাড়িয়া পাগলী কোপাইয়ের গিরিমটি গােলা জলভরা নদীর বাঁকটি যেন শ্যামালা মেয়ের গলায় সােনার হাঁসুলী।
বর্ষায় কাহারেরা মাঠে বীজ বপন করেছিল সেই বীজ আজ হাঁসুলী বাঁকের চারিদিকের মাঠ যেন সবুজের সমারােহে পরিপূর্ণ সােনালী রঙে রাঙিয়ে দিয়েছে আউশ ধানের মাঠে। কোন রমণীর গর্ভে দশ মাসের শিশু যেমন পরিপূর্ণতা লাভ করে তেমনি আউশ ধানের মাঠে যেন পরিপূর্ণতা লাভ করেছে। আউশ ধান যেন কানায় কানায় পরিপূর্ণ হয়েছে হাঁসুলী বাঁকের জমিগুলিতে।
“হাঁসুলী বাঁকের উপকথার সেই যে আদ্যিকালের বুড়ী”।
সুদীর্ঘ সাহিত্য জীবনের বিভিন্ন পর্বে তারাশঙ্কর নানা নেশার বিভিন্ন পেশার মানুষের অজস্র বর্ণাঢ্য ছবি এঁকেছেন। কিন্তু বিভিন্ন চরিত্র তার নিজস্ব বৃত্তে সমান দ্বীপ্ত ও আকর্ষণীয়। ‘হাঁসুলী বঁকের উপকথায় বিচিত্র এক উপজাতীয় কাহার গােষ্ঠীর এক অশীতিপর বৃদ্ধ সুচাঁদ তাই ‘কালাররুদ্দ ও বিষবৃক্ষ সঞ্চারী কর্তাবাবার অনিঃশ্বেষ মহিমা অনুভব ও প্রচার করে আর এই নিয়িতির অবশ্যম্ভাবিতা মানুষী শক্তিকে অপর্যুদস্ত করে। প্রাচীন সংস্কার আর বিশ্বাসের প্রতীভুরূপে সুচাদ অবিরত যেহাদ ঘােষণা করে যুক্তি আর বিজ্ঞানের বিরুদ্ধে। সময়ের হিসেব তার নেই। তবে মাটির পৃথিবীতে সেই নিয়মই প্রচলিত সেটাই তার ধারণা। যখন সে চুলের উকুন মারতে মারতে বলে “কত বছর হল ক জানে। মাথার চুলের সংখ্যে হয়—তার আর সংখ্যে নেই।” এমনই নিয়তির প্রতীকরূপে সুচঁদ উপন্যাসে রূপায়িত।
“হাঁসুলী বাঁকের কাহারের প্রাণ আহারে, প্রহারে, দুর্ভিক্ষে, মড়কে, ঝড়ে, বন্যায় সহজে যায় না।”
হাঁসুলী বাঁকের কাহার মানুষেরা প্রবল প্রাণশক্তিতে ভরপুর। তাদের সমস্ত জীবনটাই কাটে অর্ধহারে দুর্ভিক্ষে উচ্ছিষ্ট কুখাদ্য অখাদ্য খেয়ে বেঁচে দাঙ্গায় মাঠে ঘাটে কোদালের কোপে পায়ের খানিকটা কেটে পড়ে, গাছের ডাল ভেঙে ঘাড়ে পড়ে। তারা দীর্ঘদিন কষ্ট পায়, গাছের ঔষধ কেটে লাগায়, ধীরে ধীরে আরােগ্য লাভ করে। হয়তাে বা দেহের কোনও একটা অঙ্গ পঙ্গু হয়ে যায়। কিন্তু জীবন সহজে যায় না। তারা প্রচণ্ড কষ্ট সহিষ্মু। এককথায় এই ভদ্রতর কাহারেরা প্রবল প্রাণশক্তিতে উদ্যম, একাগ্রতায় নিমগ্ন।
“উপকথায় ছােট নদীটি ইতিহাসের বড় নদীতে মিশে গেল।”
উদ্ধৃতাংশটি সাহিত্যিক তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘হাঁসুলী বাঁকের উপকথা’ বিখ্যাত উপন্যাস থেকে গৃহীত। উপকথায় ছােট নদী বলতে আমরা বুঝি বিচিত্র এক উপজাতীয় জনগােষ্ঠী যারা প্রবল প্রাণশক্তিতে ভরপুর, অথচ অন্ধকুসংস্কার আর দৈবের মহিমায় প্রশ্নহীন আনুগত্য তাদের আশ্চর্য রকমের নিয়তিবাদী করে তুলেছে। এই উপজাতি কাহার গােষ্ঠীর কুসংস্কারাকীর্ণ বদ্ধ জীবনকে ছােট নদীর সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। অন্যদিকে ইতিহাসের বড় নদী বলতে প্রচলিত ইতিহাস নয় বরং বিজ্ঞানের আলােকে উজ্জ্বল বৃহত্তর জীবনকে ঈঙ্গিত করে। অর্থাৎ কাহারেরা মাটি ধুলা কাদার বদলে মাখে তেলকালি, কাব্যের বদলে কারবার করে হাম্বর, শাবল গাঁইতি নিয়ে। তবে কারখানায় খেটেও তারা মরে, গাড়ি চাপা পড়ে মরে কিন্তু তার জন্যে তারা বাবা ঠাকুরকে ডাকে না। ইতিহাসের নদীতে নৌকাভাসিয়ে তাদের তাকাতে হয় ভবিষ্যতের দিকে।
Leave a comment