[ প্রশ্নের মান ৫ ]

১। “কোপাই নদীর প্রায় মাঝামাঝি জায়গায় যে বিখ্যাত বাঁকটা নাম হাসলীবাক”- ‘হাঁসলী বাঁক’ বলা হয়েছে কেন আলোচনা করো। ‘হাঁসুলী’ কী?

“কোপাই নদীর প্রায় মাঝামাঝি জায়গায় যে বিখ্যাত বাঁকটার নাম হাঁসুলী বাঁক”—এই বাঁকটাকে ‘হাঁসুলী বাঁক’ বলার করণ হল বাঁকটা অত্যন্ত অল্প পরিসরের মধ্যে নদীর মোড় ফিরেছে, সেখান নদীটি ঠিক হাঁসলীগহনার মতো দেখতে হয়েছে। তাই এই বাঁকটাকে হাসলীবাঁক বলা হয়ে থাকে। কোপইয়ের গিরিমাটি গোলা জলভরা নদীর বাঁকটিকে দেখে মনে হয় শ্যামা মেয়ের গলায় সোনার হাঁসুলী, কার্তিক অগ্রহায়ন মাসে জল যখন পরিস্কার সাদা হয়ে আসে তখন মনে হয় রূপোর হাঁসুলী। ‘হাঁসুলী’ হল মেয়েদের গলার এক প্রকারের হার।

২। ‘নদীর ধারে বাস ভাবনা বারো মাস’–এই কথাটা কে বলেছে এবং কেন বলেছে?

‘নদীর ধারে বাস ভাবনা বারো মাস’—এই কথাটা জঙ্গলের ছোটো দারগাবাবু বলেছে। কথাটা বলার কারণ হল—“হাঁসুলী বাঁকের ঘন জঙ্গলের মধ্যে কেউ শিস দিচ্ছে। দেবতা কি যক্ষ কি রক্ষ বোঝা যাচ্ছে না, সকলে সন্ত্রস্ত্র হয়ে উঠেছে। বিশেষ করে কাহারেরা।” কেউই শিধ্বনি রহস্য উদ্ধার করতে পারে না। থানাতে খবর দেওয়া হলে ছোটো দারগা বাবু আসেন রাত্রে কিন্তু তিনিও কোনো হদিস পান না। বলেন নদীর মধ্যে থেকে শব্দটা আসছে। পূর্ববঙ্গের লোক তিনি। পূর্ববঙ্গ নদীর প্রধান দেশ। নদীর ধারে বাস করলে বারো মাসই চিন্তা ভাবনা করতে হয়। এই প্রসঙ্গে তিনি উক্ত প্রবাদটি বলেছিলেন।

৩। ‘কোপাই নদীর সঙ্গে কাহার মেয়েদের তুলনা আলোচনা করো?

আষাঢ় থেকে আশ্বিন মাস কোপাই-এর মরানদী পরিপূর্ণ থাকে জলে। এই সময় যৌবনে ভরে ওঠে তার শরীর। কোন কিছুর বাধা না মেনে দুকুল বইয়ে নিয়ে চলে যায়। ঠিক এরকম ভাবে কাহাদের এক-একটা ঝিউড়ি মেয়ে একদিন বাপ-মা-ভাই-ভাজদের সঙ্গে ঝগড়া করে, পাড়া পড়শীদের সাপ-সাপাত্তর করে ঘর ছেড়ে চলে যায়, কেউ বাধা দিতে এল তাকে মারতে আসে। দিক্‌বিদিকজ্ঞান শূন্য হয়ে ছুটে চলে কুলে কালি ছিটিয়ে, তখন সে ‘একে বারে স্বাক্ষাৎ ডাকিনী। নদীর যেমন চার-পাঁচদিন পর শান্ত হয়ে যায় তেমনি কাহারদের মেয়েরও রাগ পড়লে গ্রামের পথে ফেরে। এইভাবেই লেখক কোপাই নদীকে কাহার কন্যার সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে।

৪। ‘হাঁসুলীর বাঁকে নদীর ভাবনা খুব বেশি নয়, যেটুকু আছে, তার একটু মাত্র ‘মালোয়ারী’র পালাটা– আলোচনা করো। ‘মালোয়ারী’ কথার অর্থ কী?

‘হাঁসলীর লোকেদের বেশি ভাবনা নেই। কারণ নদীর ধারে তারা বাস করে, তাই নদীর কুমির এর সঙ্গে পরিচিত। আবার বন্যার সময় দু-একটা বাঘ-ভাল্লুকের ছানা ভেসে বাঁশ-বাঁদির বাশ বনে এসে আটকে যায়। সেগুলোর সঙ্গে তারা পরিচিত। আবার জঙ্গল হওয়ার জন্য, সাপ, শুকুরের সঙ্গেও পরিচিত। এ গুলোর কোনো কিছুকেই তারা ভয় করে না। ভয় করে শুধু ‘মালোয়ারী নিয়ে। কারণ এটাকে পরাজিত করার মত অস্ত্র তাদের হাতে নেই। তাই তাদের ভাবনা হয়। ‘মালোয়ারী’ কথার অর্থ হল ম্যালেরিয়া জ্বর।

৫। ‘কাহারদের কর্তা বাবার বর্ণদা দাও?

কাহারদের আদি দেবতা হচ্ছে কালারুদ্র বা কৰ্ত্তা বাবা। কত্তা বাবার “ন্যাড়ামাথা, ধরধব করছে রঙ, গলায় রুদ্দাক্ষি, ও পৈতে, পরনে লাল কাপড়, পায়ে খড়ম।”

৬। করালীয় কুকুরের মৃত্যু দৃশ্য বর্ণনা করো।

চন্দ্রবোড়া সাপটা কালুয়াকে কামড়ানোর পর, কালুয়া পাগলের মতো ছটফট করতে লাগলে, মাটি কামড়াতে আরম্ভ করে, মুখ তুলে চেঁচিয়ে যন্ত্রণার অভিব্যক্তি করছে। তারপর মাটির মুখ ঘসছে। মুখও নাক দিয়ে রক্তের ধারা গড়িয়ে পড়তে থাকে। এরপর চোখ দুটো ফুলে উঠে ফেটে রক্তের ধারা গড়িয়ে পড়ে কালোরামের ওপর। তারপর কালুয়া মারা যায়।

৭। ‘জাঙলের দুটো পুকুরের নাম ‘নীলের বাঁধ ও ‘গোরার বাঁধ’ নাম হয়েছে কেন আলোচনা করো।

জাঙলের দুটো পুকুরের নাম ‘নীলের বাঁধ’ ও ‘গোরার বাঁধ’ হওয়ার কারণ হল—বেহারা কাহারদের নিয়ে নীলের জমি সেচ করবার জন্য যে পুকুরটা কাটানো হয়েছে তার নাম ছিল ‘নীলের বাঁধ’। ‘গোরার বাঁধ’ নামটা হয়েছে ‘গোরা’ অর্থাৎ সাহেবদের বাঁধ বলে। পুকুরটার ভালো জল বলে সবার ওই পুকুরে নামবার হুকুম ছিল না। ওটি সাহেবদের ব্যবহারের জন্য। আবার গোরা সাহেবরা কখনো বন্ধু বান্ধবদের সঙ্গে নিয়ে পুকুরে চান করতো। তাই এই নামটা হয়েছে।

৮। “ওই ওই দেখ, তোমার কর্তা পড়েছে বাঁশের ডগা থেকে ! হুই-হুইয়া”—কে বলেছে? কেন বলেছে আলোচনা করো।

আলোচ্য অংশটি কাহার পাড়ার নবীন সদস্য করালী বলেছে। বলার কারণ হল, কাহাররা শিস ধ্বনিটাকে কৰ্ত্তা বাবার রোষ বলে মনে করেছিল। করালী তার কালুয়ার মৃত্যুর পর রহস্য উদ্‌ঘাটনের চেষ্টা করে। বাঁশ বনের বাঁশ পাতার মধ্য আগুন লাগিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। আগুনের তাপ সহ্য করতে না পেরে চন্দ্রবোড়া সাপটা ঘলসে নিচে পড়তে থাকে আগুনের মধ্যে। সাপ পড়তে দেখে করালী কাহাদের মাতব্বর বনওয়ারীকে ব্যঙ্গ করে কথাগুলো বলেছে।

৯। “কত্তা, খাবে তো খাও, না খাবে তো খেয়ো না, যা মনচায় তাই করো।”— কথাগুলো কে বলেছে? কেন বলেছে? উক্ত কথাগুলো থেকে বক্তার কী মনোভাবের পরিচয় পাওয়া যায় আলোচনা করো।

উক্ত কথাগুলো তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় রচিত আঞ্চলিক উপন্যাস ‘হাঁসুলী বাঁকের উপকথা’ নামক উপন্যাসের নবীন প্রতিনিধি করালী বলেছে। কথাগুলো বলার কারণ হল–করালী চন্দ্রবোড়া সাপটা মারলে সুঁচাদ বলে ওটা কর্তার বাহন। কৰ্ত্তা বাবা যাতে রুষ্ট না হয় তাই করালীর অপরাধের জন্য কাহার পাড়ার মাতম্বর পুনরায় কর্ত্তার পূজোর ব্যবস্থা করে, অপরাধ খণ্ডণের জন্য। সেখানে দুটো পাঁঠা, একটা ভেড়া ও বারোটা হাঁস বলি দেওয়া হয়। করালী তিনটে হাঁস আনে বলির জন্য। কিন্তু করালীর হাঁস বলি দিয়ে রাজী হয় না মাতব্বর, কারণ তার অপরাধের জন্যই নতুন করে বারাব পূজো দিতে হয়েছে। করালী তখন রাগ করে তিনটে হাঁসের মুণ্ডু হাত দিয়ে পট পট করে ছিঁড়ে উক্ত কথাগুলো বলে।

১০। কাহারদের সবিনয়ে অপরাধ স্বীকার করার ভঙ্গিটা আলোচনা করো।

কাহারদের সবিনয়ে অপরাধ স্বীকার করার ভঙ্গিটা হল। ঘাড় হেঁট করে কানটানা। “এর সঙ্গে মুখে একটু হাসিও থাকা চাই নিঃশব্দে দন্ত বিকাশ।” এই হাসির অর্থ হল—’মণিবের তিরস্কারের অন্তর্নিহিত সদুপদেশ এবং স্নেহ অনুভব” করতে পারছে।

১১। “পানুর হাসি প্রসঙ্গে ‘বেদের সাপের হাঁচি চেনা’র কথা এসেছে কেন?

আলোচ্য অংশে প্রহ্লাদ কাহার বলে আটপৌড়ে পড়ার পরম ‘তক্কে তক্কেই আছে’ কারার কোথা জমি, কোথা পয়সার কখাশুনে সেখানে হাজির হয়। চন্ননপুরের বড়ো বাবুরা কুঠী-ভাঙা কিনেছে জমি করার জন্য। পরম সেই জমি নিজের জন্য কিছুটা বন্দোবস্তো করার চেষ্টা করেছে। পানু তখন বেশ রশিয়ে বললে—“ঘুরক কাজলো তক্কে তক্কে পরের দুয়ারে, উদিকে শালার ঘরে কুত্তা ঢুকে—” পানুর সেই হাসি কাহারবাসীরা চেনে। অর্থাৎ সেও সে নিজের জন্য চেষ্টা করছে না তা নয়। সেটা কেউ জানে না। বেদে যেমন সাপের হাঁচি শুনতে পায় সেরকম কাহার বাসীরা পানুর হাসির অর্থ বুঝতে পারে।

১২। “যার সঙ্গে মেলে মন, সেই আমার আপন জন।”—পাখি কথাটা কাকে বলেছে এবং কেন বলেছে?

পাখি আলোচ্য কথাগুলো চন্ননপুরের জগমাসীকে বলেছে। এই কথাটার অর্থ হল যার সঙ্গে মন মেনে সেই হয় আপন জন। পাখির সঙ্গে নয়ানের বিয়ে হয়েছিল। কিন্তু পরে নয়ান অসুস্থ হয়ে পড়লে পরে পাখি তাকে ছেড়ে দু মাসের মতো পালিয়ে আসে। করালীর সঙ্গে তার মাখামাখি হয়। কাহার পাড়ার লোকেদের সঙ্গে করালীর দ্বন্দ্ব হলে করালী চন্ননপুরে চলে যায় তার সঙ্গে পাখিও সব ছেড়ে চলে আসে। করালীর সঙ্গে তার অঙের প্রসঙ্গে জগমাসীকে উক্ত কথাটা বলেছে।

১৩। ‘মানুষের দশ দশা, কখনও হাতী কখনও মশা’—কথাটার তাৎপর্য কী? এবং গুপী কেন কথাগুলো বলেছে?

মানুষের দশ রকম দশা আছে। তার মধ্যে কখনও হাতীও কখনো মশা। অর্থাৎ কখনো ভালো অবস্থায় থাকে আবার কখনো খারাপ অবস্থায় থাকে।

গুপী কথাগুলো বলেছে বনওয়ারী মাতব্বর হয়ে করালী ও পাখির সাঙা দিয়ে সুবিচার করে নি এটা গুপীর মনে হয়েছে। নয়ানের বাবার এক সময় খুব প্রতাপ ছিল কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সে প্রতাপ তার শেষ হয়ে যায় শেষ পর্যন্ত তার নামও মিটে যায়। অর্থাৎ মানুষের জীবনে একরকম সময় সব সময় থাকে না। এই প্রসঙ্গে গুপী কথাটা বলেছে। এই প্রবাদটা উপন্যাসে বারে বারে ব্যবহৃত হয়েছে।

১৪৷ ‘গায়ে মানে না আপনি মোড়ল’—এই প্রবাদটি উপন্যাসে কীভাবে ব্যবহৃত হয়েছে আলোচনা করো। প্রবাদটির অর্থ কী?

প্রবাদটির উপন্যাসে ব্যবহৃত হয়েছে বনওয়ারী যখন পাখির সঙ্গে করালীর বিয়ে দেয় তখন। পাখির প্রথম স্বামী নয়ানের মা বলে বনওয়ারী মাতব্বরের মতো কাজ হয়নি, কারণ “একজনের ঘর ভেঙে দিয়ে আর একজনের ঘর গড়ার নাম মাতব্বর বংশের ছিল। অর্থাৎ নয়নের বাবাও একসময় কাহারদের মাতব্বর ছিল। হাল বনওয়ারী ঘোষবাবুদের সঙ্গে মিশে বড়ো লোক হয়ে দেমাক হয়ে গেছে বলে নয়ানের মার মনে হয়েছে। সবাই বড়ো না মানলেও বনওয়ারী নিজেকে বড়ো বলে মনে করেছে। এই প্রসঙ্গে নয়ানের মা উক্ত প্রবাদটি করেছে। প্রবাদটার অর্থ হল কেউ বড়ো মনে না করলেও নিজেকে বড়ো মনে করা।

১৫। ‘কাকের মাংস কাক খায় না’—কথাটা কে বলেছে? কেন বলেছে?

‘কাকের মাংস কাক খায় না’ কথাটা কাহার পাড়ার মাতব্বর বনওয়ারী বলেছে। কথাটা বলার কারণ বনওয়ারী হঠাৎ করে বাঁশবাদির কাহার পাড়া থেকে চিৎকার চেঁচামেচি শুনতে পেয়ে থমকে দাঁড়িয়ে যায়। ব্যাপারটা কি বোঝার চেষ্টা করে। ভাবল কোথাও কি ঝগড়া লেগেছে অথবা চোর এসেছে? চোর আসার প্রসঙ্গটি সে মানতে পারে না। কারণ “কাহারেরা একদিন নিজেরাই চোর ছিল; আজ চুড়ি ছাড়লেও চোর নাম আছে, চুরির হদিসও ভুলে যায় নাই।” আটপৌড়ে পাড়ার লোকেরা এখনও চুরি করে। কিন্তু তাদের পাড়াতে চুরি করতে আসবে না। এই প্রসঙ্গে সে বলেছে ‘কাকের মাংস কাক খায় না। ঠিক যেন ‘চোরে চোরে মাদ্ভুত ভাই’— এর মতো ব্যাপারটা।

১৬। ‘সুঁচাদ সেই উপকথার শেষের যুগের মানুষ যে’— সুঁচাদকে উপকথার শেষের যুগের মানুষ বলা হয়েছে কেন?

সুচাদ বাঁশ বাদীর কাহার পাড়ার সব থেকে প্রবীনতম প্রতিনিধি। তার বয়স প্রায় চার কুড়ি। তার বয়সের কেউ আজ আর বেঁচে নেই। কাহাদের পূর্বপুরুষের উপকথার কথা সে সবাইকে শুনিয়েছে। সে মারা গেলে একটা আদিমযুগের শেষ হয়ে যাবে অর্থাৎ উপকথা বলার মতোন কেউ থাকবে না। তাই সুচাঁদকে হাঁসুলী বাঁকের উপকথার শেষের যুগের মানুষ হিসাবে চিহ্নিত করেছেন লেখক।

১৭। মাটি সম্পর্কে কাহারদের মনে কী মীথ আছে?

বনওয়ারী তার সাহেব ডাঙার জমির মাটি খুঁড়ে পরিষ্কার করতে গেলে একটা পাথরের টুকরো তার মাথায় লেগে কেটে রক্ত বেরোতে থাকে। বনওয়ারী “রক্তমাখা মাটি মুঠো করে জমির এক কোণে পুঁতে দিলে।” এবং আরো বললো “রক্ত যখন নিয়েছেন মা, তখন দেবেন তকে দুহাত ভরে দেবেন।” মাটিতে তারা দেবতা বলে মনে করে। মাটি সম্পর্কে এই মীথ তাদের মনে আছে।

১৮। কাহার অধিবাসীরা কী করে প্রাকৃতিক পরিবেশ থেকে দেখে বুঝতে পারে অতিবৃষ্টি হবে না অনাবৃষ্টি হবে?

কাহার অধিবাসীরা প্রাকৃতিক পরিবেশ দেখে বুঝতে পারে প্রকৃতিশীলা। যখন অনাবৃষ্টির সময় হয় তখন গাছের কোটর থেকে পিঁপড়ে গুলো নিচের দিকে নেমে চলে আসে, আবার যখন অতিবৃষ্টি হবে বলে মনে হয় তখন পিঁপড়েগলা সারে সারে খাবার সংগ্রহ করে গাছের ওপরের দিকের কোটরে নিরাপদ আশ্রয় চলে যায়। এই প্রকৃতির ক্ষুদ্র জীব থেকে তারা প্রকৃতির লীলা বুঝতে পারে।

১৯। ‘যাকে দশে করে ছি, তার জীবনে কাজ কী?’ বনওয়ারী কথাটা কেন বলেছে?

বনওয়ারী ও কালোশশীর সঙ্গে সম্পর্কে নিয়ে নানা কথা উঠেছে আবার সে মাতব্বর হয়ে করালী ও পাখির ‘সাঙা’ কি করে দেয় এই নিয়ে নিন্দুকে নানা কথা বলে। বনওয়ারী ঠিক করে নিন্দুকদের এই কথা বন্ধ করার জন্য গাজনের পাটায় শুতে হবে। ‘কর্তাঠাকুরের দয়ায় বাবা কালারুদ্দুর পেসাদে গাজনে পাটায় শোওয়া সহ্য হলে নিন্দুকের মুখ বন্ধ করে। যদি সহ্য না হয়, সে যদি পাপের তাপে ওই চড়কের পাটার ওপরেই ফেটে মরে যায়। সহ্য হলে “সে আবার দশের মধ্যে গণ্য হয়, সে এ পাড়ার প্রথম এবং প্রধান, সে মাতব্বর।” দশ জনের নিন্দার ফলে সে বাঁচতে চায় না, নিন্দা নিয়ে বাঁচা যায় না সেই কথাই বলেছে। এই প্রসঙ্গে করালী উক্ত প্রবাদটি বলেছে।

২০। “উপকথায় আছে—সবদিক পানে চেয়ে দেখো, মন চায় তো হাঁটতেও পার, কিন্তু দক্ষিণ দিক পানে চেয়ে দেখো না ; ও দিকে, ও পথে হেঁটো না ?”—প্রসঙ্গটি আলোচনা করো।

“চন্ননপুর হাঁসুলী বাঁকের উত্তর দিকে। কিন্তু আসলে ও হইল দক্ষিণপুরী”। কাহারদের কাছে চন্ননপুর হচ্ছে সবচেয়ে ভয়ঙ্কর জায়গা। ওই জায়গায় সে গেছে সেই নষ্ট হয়ে গেছে। করালী কাহার যুবকদের বলেছে “যুদ্ধ লেগেছে চন্ননপুরের কারখানায় অনেক লোক চাই চাই, মজুরী ডবল হয়ে গিয়েছে।” কিন্তু বনওয়ারী কাহার পাড়ার মাতব্বর। সে বেঁচে থাকতে কাহার পাড়াকে নষ্ট হতে দেবে না। তাই কাহার যুবকদের সাবধান করে দিয়ে বলেছে– “খবরদার। খবরদার। হাঁসুলী বাঁকের গণ্ডি পেরিয়ো না বাবারা”। এরপর উপকথার উক্ত কথাগুলো বলে। কারণ ও পথে গেলে কেউ ফিরে আসে না।

২১। “ঘি দিয়ে ভাজা নিমের পাত, নিম না ছাড়েন আপনি জাত।” কথাটার অর্থ কী? কথাটা কে কাদের উদ্দেশ্যে কেন বলেছে?

নিমপাতার ধর্ম তেঁতো। তাকে তেলদিয়ে ভাজলেও যেমন তার তিঁতো ধর্ম ছাড়ে না, তেমন ঘি দিয়েও ভাজলেও নিমপাতা তার তিক্ততা ছাড়তে পারে না।

কথাটা নিমতলে পানা বলে করালী ও বনওয়ারীকে উদ্দেশ্য করে। “করালী হল নিম, আর ঘি হল বনওয়ারীর উদার স্নেহ”। বনওয়ারী তার উদার স্নেহ দিয়ে করালীকে ভালোপথে আনার চেষ্টা করে, কিন্তু করালী নিমপাতার মতো তিন্ত্রতা ছাড়তে পারে না অর্থাৎ সে তার কথামতোই কাজ করে। নিজের আচার ও আচরণ পরিবর্তন করে না।

২২। “এক কাছের ফল বটে? কিন্তু নিজেই বোঁটা ছিঁড়েছে?” কে এক গাছের ফল? কীভাবে নিজের বোঁটা ছিঁড়েছে?

করালী এক গাছের ফল। কারণ সেও কাহার পাড়ার বাসিন্দা। করালী প্রথমে ঘোষ বাড়ির কাজ নিয়েছিল কিন্তু ঘোষ বাড়িতে অপমানিত হয়ে চন্ননপুরে রেললাইনে কুলি গ্যাং-এর কাজ নিয়েছে। কাহার পাড়ার প্রথম পুরুষ সে বাঁশবাঁদিকে উপেক্ষা করে চন্ননপুরে কাজ নিয়েছে। “সে চন্ননপুরে খাটে, কাহার পাড়ার হয়েও কাহার নয়—” এই ভাবেই সে নিজের বোঁটা ছিঁড়েছে।

২৩। “বললে জাত? জাত লেয় কে? তার ঘর কোনখানে? বলি, জাত মারে কে?”–কে বলেছে? প্রসঙ্গটি আলোচনা করো।

উদ্ধৃতাংশটি করালী বলেছে। পাগল কাহার যখন তাকে বলে টাকা দিয়ে কেউ যদি বলে ‘জাতটি দাও, দেবে তুমি?” এই কথা শুনে করালী উক্ত কথাগুলো বলেছে। সে বলে জাত কে মারে জান? “জাত যায় পরের এঁটো খেলে কুড়োলে। ছোঁয়া খেলে যায় না। জাত ওদের গিয়েছে, আমার যায় নাই। বুয়েচ ? আমার জাত মারে কে?” এই প্রসঙ্গে করালী কথাগুলো বলেছে।

২৪। “মনের আগুনে পোড়ো, আমিও পুড়ি, পুড়ে পুড়ে খাঁটি হই, জুলুক”–কে কাকে কথাগুলো বলেছে? কেন বলেছে আলোচনা করো।

উক্ত কথাগুলো কাহার পাড়ার মাতব্বর বনওয়ারী তার প্রথম বয়সের প্রণয়িনী কালো শশীকে বলেছে।

কথাগুলো বলার কারণ হল বনওয়ারীও কালোশশীর অল্পবয়সে থেকেই প্রণয় ছিল। কিন্তু বনওয়ারী ছিল কেঁদে কাহার আর কালোশশী ছিল আট প্রৌঢ়ে। কালোশশীদের থেকে বনওয়ারী ছিল নিচু জাতের এই জন্য তাদের বিয়ে হয়নি। কালশশীকে পরান বিয়ে করে। পরবর্তী কালে দুজনেই বিবাহিত। কিন্তু মনের কোণের কোথাও পূর্ব প্রণয়ের স্মৃতি বয়ে যায়। তাই বনওয়ারী ভাবে সে মাতব্বর না হলে এই বয়সে কালোবউকে নিয়ে চলে যেতো। মনে মনে ভাবে কালো বউকে বুঝিয়ে বুলবে–“এ জনমে হল না ভাই, আসছে জনমে যাতে তুমি পাও আমাকে আমি পাই তোমাকে তার লেগে বাবার থানে দুবেলা পেনাম করো। কাহারদের থানে বটগাছের ডালে ঢেলা বেঁধো। আমিও তাই করবো।” এরপর উক্ত কথাগুলো বলেছে।

২৫। ‘আমার মাতব্বর আমি’—কথাটা কে বলেছে? কেন বলেছে আলোচনা করো।

উক্ত কথাটা করালী বলেছে। করালী কোঠা ঘর করবে বলে ঠিক করে। কিন্তু সবাই তাকে বারণ করে। সুচাঁদ তাকে বলে যা পিত্রি পুরুষে করে না, তাই করতে নাই। সয় না। সহ্য হয় না। মানুষ মরে যায়। বনওয়ারী কাহারদের মাতব্বর। তার একটা অনুমতি নিতে বলে, তখন বিয়ে বাড়ি উপলক্ষে বনওয়ারী গ্রামে ছিল তার ফিরে আসা পর্যন্ত তাকে সবাই অপেক্ষা করতে বলে। তখন করলী উক্ত কথাটা বলে।

২৬। কাহার পুরুষ স্ত্রী থাকতে যদি দ্বিতীয় বিয়ে করে তো প্রথম স্ত্রী কী করে আলোচনা করো।

“কাহার পাড়ায় স্বামী যদি স্ত্রী থাকতে বিয়ে করে, তবে স্ত্রী সঙ্গে সঙ্গে শাঁখা আর নোয়া খুলে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে স্বামীকে গাল দিতে দিতে চলে যায় অন্য কোনো কাহার মরদের ঘরে গিয়ে ওঠে সতীনের সঙ্গে ঘর কাহার মেয়েরা করে না।” স্বামী যদি পয়সাওয়ালা বা মাতব্বর ধরনের হয় তারা বিয়ে না করে অন্য মেয়ে বাড়িতে নিয়ে এলে তারা আপত্তি করে না। বিয়ে করলেই তাদের আপত্তি “কাহার পাড়ার মেয়েরা ফেলনা নয়, স্বামীকে তাদের ভাত দিতে হয় না, নিজেরাই তারা খেটে খায়।” এটা কাহারদের একটা রীতি নীতি।

২৭। লেখক কেন কাহারদের ঝগড়াকে ‘কহল সংস্কৃতি’ বলেছেন আলোচনা করো।

কাহারদের মেয়েরা যার ওপর রেগে যায় তাকে গাল মন্দ করে, শাপ শাপান্ত করে। গালি গালাজ করা কাহার পাড়ায় বিশেষত্ব। এই ঝগড়া একদিনে থামে না। হঠাৎ করে মনে পড়লে আরম্ভ করে। আবার গলায় দরদ আরম্ভ হলে থেমে যায়। এই রীতিটা পুরুষানুক্রমিক ভাবে চলে আসছে। মেয়েদের ক্ষেত্রে ঝগড়া, গালি-গালাজ ও শাপ-শাপান্তরে সীমাবদ্ধ কিন্তু পুরুষের ক্ষেত্রে মারপিট পর্যন্ত গড়ায়। লেখক একেই বলেছেন ‘কলহসংস্কৃতি’।

২৮। “কাহার মেয়েরা সতী হলে ভদ্রজনের পাপ ধরবে কারা” –আলোচনা করো।

কাহার মেয়েদের সতী হতে নেই। তাহলে ভদ্রলোকের পাপ চাপা পড়ে যাবে। তাই তাদের নষ্ট হতে হয়। ভদ্রলোকেদের মনরঞ্জনের জন্য। ভদ্রলোকেদের বাড়িতে স্ত্রী থাকা সত্ত্বেও তারা কাহার মেয়েদের সতীত্ব নষ্ট করে। এই প্রসঙ্গে কথাগুলো বলা হয়েছে।

২৯। ‘কলির শেষ, আমাদের ও শেষ কে কথাটা কাকে বলেছে? কেন বলেছে?

কথাটা পাগল কাহার বনওয়ারীকে বলেছে। বলার কারণ হল যুদ্ধের প্রভাব বাঁশবাঁদি গ্রামেও পড়ে। পাগল বলে “যাবার থানকে কেটে কুটে সমান করে মটর গাড়ির আস্তানা করছে”। তাদের দৈব বিশ্বাসে আঘাত পড়ে। তারা ভেবেছে কলিযুগ শেষ হয়ে গেছে। কলির সঙ্গে সঙ্গে তারাও শেষ হয়ে যাবে। তাদের সব থেকে বিশ্বাসও ভক্তির জায়গা করার থান এর গতি দেখে পাগল কথাগুলো বলে।

৩০। “হাঁসুলী বাঁকের উপকথায় শেষকালে শুধু গাছ কাটার শব্দ”— আলোচনা করো।

বাঁশবাদি ছিল জাঙলের জঙ্গলের মধ্যে অবস্থিত একটা গ্রাম। বাঁশবনের বেড়া চারি ধারে। যুদ্ধের প্রভাবে কাহার জীবনও বিপর্যস্ত। বড়ো বড়ো গাছও বাঁশবনে ভর্তি ছিল জাঙল গ্রাম। যুদ্ধের ফলে টাকায় দুটো করে বাঁশ ঘোষ মশাইরা বিক্রি করছে, বড়ো বড়ো গাছগুলোও বিক্রি হয়ে যায়। “স্থানুস্থাবর বনস্পতি, যারা সর্বপ্রথম গড়েছিল হাঁসুলী বাঁকের উপকথার ছায়াছন্ন শান্ত তন্দ্রালু গ্রামখানি, তারাই যাচ্ছে এবার, তারা হচ্ছে বিগত।” শান্ত বাঁশ বাঁদির শাস্ততা ভঙ্গ হয়েছে গাছ কাটার শব্দে। এই প্রসঙ্গে কথাগুলো বলা হয়েছে।

৩১। “উপকথার ছোটো নদীটি ইতিহাসের বড়ো নদীতে মিশে গেল” – আলোচনা করো।

পুরানো হাঁসুলী বাঁক ভেঙে গেছে বন্যায়। কাহাররা এখন নতুন মানুষ। পোষাকে কথায় বিশ্বাসে তারা অনেকটা পালটে গেছে। মাটি ধুলো কাদার বদলে মাখে তেলকালি, লাঙল কাস্তের বদলে কারবার করে হাম্বল শাবল—গাঁইতি নিয়ে। “তবে চন্ননপুরের কারখানায় খেটেও তারা না খেয়ে মরে, রোগে মরে, সাপের কামড়ের বদলে খালকেটে মরে, গাড়ি চাপা পড়ে মরে। কিন্তু এর জন্য বাবাঠাকুরকে ডাকে না।’ ইতিহাসের নদীতে নৌকা ভাসিয়ে তাদের তাকাতে হচ্ছে কম্পাসের দিকে বাতাস দেখার যন্ত্রটাকে”। এইভাবে ছোটোনদী, বড়োনদীতে মিশেছে।

৩২। “সবল হাতে গাঁইতি চালাচ্ছে, বালি কাটছে, বালি কাটছে আর মাটি খুঁড়ছে” কে? কেন আলোচনা করো।

উক্তিটি করালী করেছে। নতুন করে মাটি খোঁজার উদ্দেশ্যে। কারণ সে বাঁশবাদির শিখর একেবারে উচ্ছেদ করতে পারেনি। নতুন করে কাহার পাড়া তৈরি করার জন্য বন্যার পর বালি কেটে মাটি খোঁড়ার চেষ্টা করে “উপকথার কোপাইকে ইতিহাসের গঙ্গায় মিশিয়ে দেবার পথ কাটছে। নতুন হাঁসুলী বাঁকের” এর জন্য। সে যে কাহার পাড়ার এবং কাহারদেরই একজন এটা উপন্যাসের শেষে প্রমাণ করেছে।