মূলত তারাশংকরের ‘হাঁসুলী বাঁকের উপকথা’ উপন্যাসে ভাষার ক্ষেত্রে ছবি পূর্ণ স্তর লক্ষিত হয়। একটি স্তর পুরােপুরি চলিত ভাষার, এটি লেখকের নিজের ভাষা, এই ভাষায় তিনি গােটা কাহিনি উপস্থাপিত করেছেন। আর একটি স্তর বীরভূমি বিভাষার, এটি উপনাসের চরিত্রগুলির ভাষা, উপন্যাসের বিভিন্ন চরিত্র এই ভাষায় নিজেদের মধ্যে কথা বলাবলি করেছে। এছাড়া আরও একটি উপস্তর আছে, তার ভাগ একটু মিশ্র ধরনের। এই বাইরের কাঠামাে চলিত ভাষার, কিন্তু ভেতরে ভেতরে আছে বীরভূমি বিভাষার শাব্দিক উপকরণ, লেখক সেগুলিকে চিহ্নিত করেছেন উদ্ধৃতি চিহ্ন দিয়ে। এগুলি আসলে প্রথাগত ব্যাকরণের পরিভাষা অনুসারে অনেকটা পরােক্ষ উক্তির নমুনা। এই বাক্যগুলি চলিত ভাষা লিখিত হলেও এগুলি আসলের লেখকের বাক্য নয়, এগুলি চরিত্রেরই মনােগত বাক্য। তবে এগুলি চরিত্রের বাক্য বলে এদের মধ্যেকার ঔপভাষিক নিজস্বতাটুকু বর্জন করতে পারেননি। বর্জন করলে তাে নিতান্ত কৃত্রিম হয়ে পড়তাে। যাইহােক, সামগ্রিক ভাবে এই বাক্যগুলি চলিত ভাষার শশাষণ শক্তির নমুনা। সেই কারণে এগুলিকে চলতি ভাষার পূর্ণ স্তরটিরই একটি উপস্থর বলে ধরে নেওয়া যেতে পারে।

প্রথমে লেখকের ভাষা তথা পূর্ণ চলিতের স্তর সম্পর্কে বলা যায়, তারাশংকর নিজে রাঢ়ের লােক হয়েও চলিত বাতায় কোনাে বিশেষ প্রান্তে ঝুঁকে পড়েননি, তিনি যথাসম্ভব মধ্যরূপটিরই অনুশীলন করেছেন। এরজন্য একদিকে বীজ-বিভাষার শব্দগুলিকে উদ্ধৃত চিহ্ন দিয়ে আলাদা করতে চেয়েছেন, অন্যদিকে সে অলংকার বাহুল্যের সূত্রে চলিত ভাষা তার মধ্যে রূপ ছেড়ে অনেক দূরে সরে যাবার সুযােগ পায় সেই অলংকার তিনি যথাসম্ভব কম ব্যবহার করেছেন ; যেখানে বর্ণনার প্রয়ােজনে সাদৃশ্যমূলক অলংকারের ব্যবহার নিতান্ত অপরিহার্য হয়ে পড়েছে, সেখানে উপমাটি নির্বাচন করেছেন বর্ণনীয় বিষয়ের পরিচিত পরিবেশ থেকে। যেমন-

  • আউশ ধানে থােড় হয়েছে- দশমাসের পােয়াতির মতাে থমথম করছে আউশ ধানের মাঠ।

  • হাঁসুলী বাঁকের বাঁশবনের তলায় পৃথিবীর আদিম কালের অন্ধকার বাসা বেঁধে থাকে। সুযােগ পেলেই দ্রুত গতিতে ধেয়ে আসে সে অন্ধকার বাঁশবন থেকে বসতির মধ্যে।

  • এক কাপ ছােলা-কলাই যখন ভিজেফুলে ওঠে তখন যেমন সবগুলি ছােলা থেকেই অঙ্কুর বার হলে মাটি ফাটিয়ে ওপরের দিকে একসঙ্গে ওঠে তেমনিভাবে এই খবরে অন্তনিহিত আশার সকল কাহারের অন্তর থেকে একই আকাঙ্ক্ষার অঙ্কুর একসঙ্গে বেরিয়ে আসতে চাইছে।

পাঠকরা মনদিয়ে পাঠ করলে এই ধরনের আরও উদাহরণ খুঁজে পাবে যা লেখকের সম্পূর্ণ রূপে নিজস্ব রীতি।

দ্বিতীয় ক্ষেত্রেই তারাশংকর এই উপন্যাসের ভাষায় আঞ্চলিক বৈশিষ্ট্য ফুটিয়ে তুলে অসাধারণ কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছেন। এই উপন্যাসের চরিত্রগুলি তাদের মুখের অকৃত্রিম ভাষার গুণেই জীবন্ত হয়ে উঠেছে। এই অশিক্ষিত মানুষগুলির শব্দোচ্চারণে কিছু বিশিষ্টতা আছে। “এরা ন’ কে বলে ‘ল’, ‘ল’ কে ‘ন’ ও ‘র’কে বলে ‘অ’।” যেমন- ‘লতুন’, ‘নেকন’, ‘অং’, ‘আম’ ঔপন্যাসিক জানাচ্ছেন— “শব্দের প্রথমে ‘র থাকলে সেখানে ওরা র কে ‘অ’ করে দেয়। নইলে যে বেরােয়না জিভে তা নয়। শব্দের মধ্যস্থলের দিব্যি উচ্চারণ করে।” যেমন- রাত বিরাত>আতবিরেত, রীতকরণ>ইতিকরণ। তাদের মুখে শব্দরূপের বিশিষ্টতার আরও কিছু উদাহরণ- উপদ্রব>রােপােদ্দরব, অপমান>রপমান, প্রতিবিধান>পিতিবিধান, ঈশ্বর>ঐশ্বর, অমৃত>আমরেতাে, প্রলয়>শেলয়, বক্ষে>অক্ষে, পেট>প্যাট, রাতে>এতে, নিশ্চিন্ত>নিশ্চিন্ত, পৃথিবী>‘পিথিমী’।

অন্যদিকে মেয়েদের গালাগালি ভাষার বিশিষ্টিতা হল- “আলাে, বেটাখাকী লাে, ওলাে ভাতারখাকী লাে, নিব্বংশাের বেটী লাে—তাের মুখে আগুন দি লাে।”

প্রত্যুত্তরে নসুবালার গালাগালি- “নোকের জোড়া বেটাকে আমি এমনি করে নেচে নেচে খালে পুতব। নােকের ভাতার মরবে—ওগা নাই, বালাই নাই, ধড়ফড়িয়ে মরবে, আমি ধেই ধেই করে নাচব।”

করালীর প্রতি নয়ানের মায়ের শাপশাপন্ত—“হে কত্তাবাবা হে বাবাঠাকুর, তুমি ক্ষেপে ওঠ বাবা। বাহনের মাথায় উঠে দাঁড়াও এইবার। আকাশের বাজ নিয়ে নষ্ট দুষ্ট বদজাতের মাথায় ফেলাে বাবা। কড়কড় করে ডাক মেরে হাঁক মেরে ফেলে দাও বাজ, পুড়ে ফেটে মরে যাক ছটফটিয়ে। “

বিশিষ্টার্থে নবপ্রয়ােগের নমুনা হল- ‘চাদর’কে এরা বলে ‘দোলাই। কালাে মেঘের গায়ে রাঙা মাটির ধুলােয় লাচছে—’দোলাই’ অর্থাৎ চাদর উড়ছে। বিদ্যুৎ চমকে ওঠাকে বলে ‘ললাপে’, ‘ওইযে বিদ্যুৎ ললপে’ অর্থাৎ চমকে উঠছে। আবার ‘বায়ুকোণ’ কে বলে ‘হেঁড়ে কোন’। বাসি কাপড় বােঝাতে ‘এড়া’ কাপড়। অদৃষ্টকে বলে ‘নেকল’। জমিচাষের উপযুক্ত হওয়াকে ‘বাত’ হওয়া, উত্তরীয়কে ‘উতুরী’, চমকে চমকে উঠল কে ‘চ’কে ‘চ’কে উঠল। মােটামােটা অর্থে- ‘ভাকুম-কুমাে’-জ্যাল থেকে ফির এই ‘ভাকুম-কুমাে’ অর্থাৎ মােটাসােটা হয়ে। বাতাস অর্থে ‘বাত্তর’। জলে ভেজা ফাঁপা মাটি অর্থে ‘বতর’, ইত্যাদি।

পাল্কি বাহনের ভাষা- পাল্কি বহন করে চারজনে, সামনে, দুজন, পিছনে দুজন। সামনে যারা থাকে তারা সুর করে ছাড়া বলে, পিছনের বাহকেরা সেই সুরে সুর মিলিয়ে প্লোহি প্লোহি বলে। যেমন-

‘বরে বাে পান্কি/পড়িল পিছনে 

প্রোহি প্লােহি।। প্লােহি-প্লোহি।’

আবার কাহারদের কথায় বিশেষ লােক ছড়ার প্রয়ােগ দেখা যায়। সেগুলি লােক ভাষার দ্বারা সম্পৃক্ত। যেমন-

যাকে দশে করে ছি, তার জীবনের কাজ কি?

যার যেথা মন, সেথাই বিন্দাবন,

লষ্ট চাঁদের ভয় কিলাে সই, কলংক মাের কালাে ক্যাশে।

সবমিলিয়ে বলতে হয়, ‘হাঁসুলী বাঁকের উপকথা’ যেহেতু শ্রেষ্ঠ আঞ্চলিক উপন্যাস অভিধায় ভূষিত। সেইহেতু এর ভাষা ও সংলাপ যে সাধারণ লােকজীবনের মুখের থেকে সােজা সাহিত্যের পৃষ্ঠায় স্থান গ্রহণ করবে সে বিষয়ে কোনাে সংশয় নেই। আবার তারাশংকর লেখক হিসাবে সেই কাজটি অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছেন।