উপন্যাসের আদ্যপর্বে হাঁসুলী বাঁকের নামকরণের ব্যাখ্যা লিখেছেন তারাশংকর তা যেমন বাস্তবসঙ্গত তেমনি একই সঙ্গে সাঙ্কেতিক সঙ্কেত বহ। কোপাই নদীর প্রায় মাঝামাঝি জায়গায় সে বিখ্যাত বাঁধটার নাম হাঁসুলী বাঁক—অর্থাৎ যে বাঁকটায় অত্যল্প পরিসরের মধ্যে নদী মােড় ফিরেছে, যেখানে নদীর চেহারা হয়েছে ঠিক হাঁসুলীর গয়নার মতাে। বর্ষাকালে সবুজ মাটিকে বেড় দিয়ে পাহাড়িয়া কোপায়ের গিরিমাটি গােলা জলভেরা নদীর বাঁকটিকে দেখে মনে হয়, শ্যামলা মেয়ের গলার সােনার হাঁসুলী ; কার্তিকয়-অগ্রহায়ণ মাসে যখন পরিষ্কার সাদা হয়ে আসে—তখন মনে হয় রূপাের হাঁসুলী। এইজন্যে বাঁকটার নাম হাঁসুলী বাঁক। নদীর বেড়ের মধ্যে হাঁসুলী বাঁকে ঘন বাঁশবনে ঘেরা মােটমাট আড়াইশাে বিঘা জমি নিয়ে মৌজা বাঁশবাদি। লাট জঙ্গলের অন্তর্গত। বাঁশবাদির উত্তরেই সামান্য খানিকটা মাঠ পার হয়ে জঙ্গল গ্রাম, বাঁশবাদি ছােটো গ্রাম, দুযি পুকুরের চারি পাড়ে ঘর তিরিশেক কাহারদের বসতি। রূপাের এই হাঁসুলীকে কেন্দ্র করে কোপাই নদী, জঙ্গলগ্রাম, বাঁশবাদি নিয়ে তাই উপকথার সাম্রাজ্য। গ্রন্থটির নামকরণের মধ্যেই ইহার অন্তঃ প্রকৃতির বৈশিষ্ট্য ব্যঞ্জিত হইয়াছে। ইহা ইতিহাস নহে উপকথা। ইহার জীবনযাত্রা অতি প্রাকৃতের ঘন কুহেলিকা মণ্ডিত ; পৌরাণিক কল্পনা, অলৌকিক সংস্কার ও বিশ্বাস, প্রাচীন কিংবদন্তি ও আখ্যান, সদ্য অতীতের ঘটনা প্রতিফলিত জীবনদর্শন—এ সমস্তই প্রাত্যহিক জীবনের রন্ধ্রে রন্ধ্রে গভীরভাবে অনুবিষ্ট। হাঁসুলী বাঁকের কাহারদের জীবনদর্শন অপরিবতনীয়ভাবে স্থিরীকৃত তাহাদের। জীবনে যাহা কিছু আকস্মিক ও অসাধারণ সবই দেবলীলা অদৃশ্য শক্তির দুর্বোধ্য অভিপ্রায় হইতে উৎক্ষিপ্ত।

সমগ্র উপন্যাস জুড়ে হাঁসুলী বাঁকের উপকথার জের চলেছে, কোথাও তার বিচ্ছেদ নেই। কাহিনির অন্য সব অংশ উপকথার প্রয়ােজনে এসেছে। প্রাচীনতম কাল থেকে একমাত্র বিশ্বাসের বস্তু বলে স্থিরীকৃত। তাই সুচাঁদের মুখে এর ইতিবৃত্ত শােনা যায়, বনওয়ারী তারই উত্তরসূরী। আদিমতা অচ্ছেদ্যভাবে বিজড়িত উপন্যাসে, তার সঙ্গে, পুরুষ ও নারী সমাজের সম্পর্ক এরসঙ্গে যােজিত হয়েছে। সাপ-বাঘ, কর্তাবাবা, তার দেহ তার সঙ্গে ‘নেকন’ বা অ-দৃষ্টবাদ সবমিলে মিশে একাকার হয়ে গেছে। মুখ্যত উপন্যাসের নামকরণের সরাসরি দুটি ভাগে ভাগ করা হয়, কেন্দ্রীয় চরিত্র ও কেন্দ্রীয় ঘটনা, নিয়ন্ত্রীশকতি কেন্দ্রীয় চরিত্রের থাকলে তার যথার্থ নিরূপিত হয় অথবা ব্যস্ত কেন্দ্রীয় বিষয়। ‘হাঁসুলী বাঁকের উপকথা’ উপন্যাস চরিত্রকে ঘিরে রয়েছে তার পরিবেশ, সেই পরিবেশের বিরাট অংশ সংস্কার বা বিশ্বাসের রূপ ধরে এসেছে। পরিবেশ বা বিষয়বস্তু প্রাধান্য পেয়েছে এখানে। অলৌকিক কর্তাবাবা বা কালারুদ্রের নির্দেশে বাঁকের জীবন নিয়ন্ত্রণ হচ্ছে, তিনি প্রথম এবং তিনি শেষ। এই বিশ্বাসের মূলে আঘাত এনেছে করালী, তার বাহনকে মেরেছে, তার অবস্থানের বৃক্ষের উপরি শাখায় উঠেছে সংস্কারকে ভেঙে, তবু বনওয়ারীর বিশ্বাসে ফাটল ধরেনি, কাহিনির উপাত্তে যেখানে বাবার থান বা বৃক্ষ বা বাহন কারুর অস্তিত্ব নেই, তখন সে বিস্মিত, লা ফতেন যেমন বলেছিলেন, ‘We believe no evil till the evil’s done’।

উপকথায় যে আদিম বা ‘অঙে’র খেলার লীলা বনওয়ারীকে তা ছুঁয়ে গেছে। কালােশশীকে কেন্দ্র করে যা এই আদিম সমাজে স্বাভাবিক সমস্ত বিপর্যয়ের মূলে। এগুলির ভেতরে অলৌকিকতাকে স্বতঃসিদ্ধ বলে সে মনে করেছে। সুচাদ বলেছে এই বাবার দয়াতেই হাঁসুলী বাঁকের যা কিছু চৌধুরীরা যখন গৃহস্তে নীলকুটির গােমস্তা, কুটির ভাউদ-ভাঙা অবস্থা সেবার এল কোপাই নদীতে প্রলয়, দুপুর থেকে কাপাই ভাসল হদের পুকুরের শাহীপাড় পর্যন্ত ডুবে গেল, দেখতে দেখতে পঞ্চ শব্দের বাদ্য বাজিয়ে নদীর এ আলাের ‘আলােবীন্নী’ করে এক বিয়ে শাদী নৌকোর মতাে নৌকো এল। বাঁকের দহের মাথায় সাহেব দেখছিল, সে মেমের বারণ না শুনে ঝাপ দিল মেমও নামল, সাহেব এককোমর জল ভেঙে চলল নৌকো ধরতে। হঠাৎ ওই বাবার থান থেকে বেরিয়ে এলেন কর্তা। ন্যাড়া মাথা, ধবধব করছে বউ, গলায় রুদ্রাক্ষীর মালা, পরনে কালাে কাপড়, পায়ে খড়ম পরে জলের ওপর খড়ম পায়ে চলে এলেন। এই পুরানাে কথার সূত্রে বহুকাল বাদে বনওয়ারী, চমকে দেখলাে, বাবার থানের আলাে আকাশে বিদ্যুৎ হয়ে ‘ললপাচ্ছে’ অর্থাৎ চমকাচ্ছে। আরও পরে পরমের সঙ্গে লড়াইয়ের পর কালােশশীকে নিয়ে নদীর ধারে এসে ক্ষত ধােয়ার জন্যে জলে নেমেছে, আহত পরম ছুটে আসছে দেখে কালােশশী ছুটতে লাগল। ‘সর্বনাশ!’ সামনে যে ‘সাহেব ডুবিরদহ’ ; কেউ বলে ‘যখের দহ’ ; কাহার পাড়ার লােক বলে কৰ্ত্তার দহ। কর্তা ওই দহে চান করেন। কালারুদ্র ওই দলে জলশায়নে আছেন। বনওয়ারীর কাহিনির সঙ্গে যুক্ত হাঁসুলি বাঁকের সেকালের ভৌতিক লােকের ইতিকথা, কালােশশীর অলৌকিক মৃত্যুর পর স্থির করে মা শ্মশানকালীর রক্ষাকবচ ধারণ করবে, কর্তাবাবার পুষ্পও মাদুলিতে পুরে ধারণ করবে। তাই সে নিশ্চিন্ত। ভূতপ্রেত যত নিষ্ঠুর দেবতা তত ভয়াল। এই সামঞ্জস্যের মধ্যে দিয়েই চলে হাঁসুলী বাঁকের রাত্রি দিন।

‘উপকথা’ জীবন গ্রামীণ আর পাঁচটা সংস্কার বিশ্বাসের মতােই। তবু পার্থক্যটি দুর্নিরীক্ষ্য নয়, উপন্যাসের আদিমাতার লীলার দুটি অংশ। একটি ‘অঙের খেলা’কে কেন্দ্র করে। যৌনশিথিলতা বসন, বসনের কন্যা পাখির। উপকথার তুফান বানে ঝাঁপ খেয়ে যুবতী বউ পালায় যার ওপরে মন পড়েছে তার কাছে, তার পাতা সংসারেই গিয়ে ওঠে। চৌধুরীবাবুদের বাগান বাড়ির সঙ্গে বসনের সম্পর্ক, বসনের কন্যা পাখির সঙ্গে দুর্বিনীত করালীর অ-সামাজিক সম্পর্ক যেখানে তার স্বামী নয়ন উপেক্ষিত, বনওয়ারী কালােশশী উল্লেখ্য ঘটনা, ঘরে গােপালী থাকলেও, কালােশশীর চেহারার সঙ্গে মিলের কারণে সুবাসীকে ঘরে তুলতে বনওয়ারী দ্বিধা করেনি। উৎসবের দিনে মদ্যপানের আধিক্যে গােপালীর মৃত্যুর পর সুবাসী পাখির ঘর ভেঙে করালীর ঘরে এসে ওঠে। পরিণতিতে পাখি গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা করে, কালােশশীর প্রেতযােনিপ্রাপ্ত পাখির মৃত্যু একই রীতি ভিন্ন মাত্র। রং-এর খেলার বাইরে দ্বিতীয় অংশটি আধিভৌতিক ও অলৌকিক দেবতার ওপর নির্ভরতা ও তজ্জনিত ভীতি শ্রদ্ধা।

হাঁসুলী বাঁকের উপকথার যা কিছু হঠাৎ ঘটে, তাই দৈব। দেবতার রােষ বিনা অপরাধে হয় না-এই কথা শাস্ত্রে আছে তারা বিশ্বাস করে। দেবতার রােষ হলে, জানতে হবে অপরাধ হয়েছে। সে তুমি জেনেই করে থাক আর অজানতেই করে থাক। আবার সঙ্গে সঙ্গে একথাও তারা বিশ্বাস করে- ‘কে করলে ব্রহ্মহত্যে কার প্রাণ যায়’ -এই বিশ্বাস ভেঙে তছনছ করে দিয়ে যায় নবীনের অবিবেচনা প্রসূত দুর্দান্তপনা। করালী তারই প্রতীক -এইভাবে যে বৃত্তটি পূর্ণ হয়ে যায় হাঁসুলী বাঁকের উপকথার আদ্য-মধ্য অন্ত্যযুক্ত কাহিনি যা প্রকৃতি ও পরিবেশে সম্পূর্ণ বলে ধরে নিতেই হয়। এখানেই উপন্যাসটির নামকরণের যাথার্থ্য।