এই কাল ও প্রকৃতিকে ঘিরে যে মানুষগুলি—তাদের জীবন কথাই হল উপন্যাসের মুখ্য বিষয়। এইকথা রূপকথা নয়, উপকথা। এই উপকথায় নরনারীদের দুটি দলএকদল প্রবীণ, অন্যদল নবীন। প্রবীণ পুরুষদের মাতব্বর বনওয়ারী, নবীনের নেতা করালী। প্রবীনদের জগদ্দল পাথর সুঁচাদ, নবীনদের মুক্ত বিহঙ্গ পাখি ও সুবাসী। তারাশংকর চরিত্রগুলিকে সুচিন্তিত ভাবে ভাগ করে নিয়েছেন। নাটকীয় পদ্ধতিতে প্রবীণ নবীনের দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করে উপন্যাসের কাহিনিকে টেনে নিয়ে গেছেন। লেখকের অভিজ্ঞতা অকৃত্রিম, চরিত্রগুলিও তাই অকৃত্রিম হয়েছে। চরিত্রগুলির ধাত ও রীতি একটু আলাদা। চরিত্রগুলির টান মাটির দিকে, জমির দিকে, নদীর দিকে নয়। তাই একটা নির্দিষ্ট ভৌগােলিক প্রতিবেশ চরিত্রগুলির চারিদিক ঘিরে আছে। সে ভূগােল রাঢ়ভূমি।

হাঁসুলী বাঁকের দেশ আলাদা। হাঁসুলী বাঁকের দেশ কড়া ধাতের মাটির দেশ। এ দেশের নদীর চেয়ে মাটির সঙ্গেই মানুষের লড়াই বেশি। এই মাটি কেন্দ্রিক মানুষের প্রতিনিধি বনওয়ারী। সে প্রবীণের প্রতীক। সে মাটি আঁকড়ে বাঁচতে চায়। সে মাটির রুক্ষতায়-সজীবতায় জীবন গড়েছে। মাটি তার প্রাণ ও টান। বাঁশবাদি ও বনওয়ারী তাই অচ্ছেদ্য। গ্রামের সুখ-দুঃখের মাঝেই সে সজীব, সতেজ। দারিদ্র্য তাকে মাটি বিমুখ করেনি। তার জোর এই মাটির সম্পর্কে, তাই অর্থনৈতিক উন্নতির হাতছানিতে সে সাড়া দিতে চায় না। তার জীবনবােধের বিচার অর্থনৈতিক কাঠামােয় সম্ভব নয়। সে গোঁড়া গ্রাম্য মানুষ হতে পারে কিন্তু তার জীবন বড়ড়া শক্ত সত্য মূলে বাঁধা। অর্থনৈতিক লােভ এই সত্যকে টলাতে পারেনি। তাই সে বলিষ্ঠভাবে বলতে পেরেছে- ‘চন্ননপুরের লাইনে যে খাটতে যাবে, তার ঠাই কাহার পাড়ায় হবে না। পিতৃ-পুরুষে যা করে নাই, তা করতে নাই। পয়সা বেশির দিকে তাকালে হবে না, সে পয়সা থাকবে না। স্বভাব মন্দ হবে। এত বড়াে হাঁসুলীর মাঠে যার পেট ভরবে না, তার পেট অভর। পৃথিবীর কোথাও সে পটে ভরে না। এই মাঠে বুক দিয়ে খাট। দুহাতে খাও’ এই ডাক নবীনের প্রতি প্রবীণের ডাক। এই ডাক গভীর সত্যমূল থেকে উদ্গত। উদ্বাস্তু জীবনের গভীরে এই সত্য নেই। সে জীবন সুযােগ-সন্ধানী অশান্ত ; দৃঢ় সত্য সাধনায় সংযত নয়। জীবন সম্পর্কে বনওয়ারী মৌলবাদী। এখানেই চরিত্রটির শক্তি ও সৌন্দর্য।

অপর পক্ষে করালী নবীনের প্রতীক। যা কিছু পুরানাে তাকে ভাঙে, জীবন তৈরি করাে নতুন যুগের হাওয়ায়। এই বিশ্বাস করালী চরিত্রের নিহিতার্থ সে ধর্ম মানে না, আচার মানে না, তার মাটির টাকা নেই। সে দুর্দাম, সে অস্থির। সে আনন্দ উচ্ছাসে সর্বদা ঘুরতে চায়। সে চিন্তা করে না, বাধা মানে না। প্রবীনের বিরুদ্ধে তার তীব্র সংগ্রাম। রেলপথ ধরে যে নতুন জীবন আসছে করালী সে জীবনের প্রতি আকৃষ্ট। রেললাইন ধরে যে নতুন অর্থনৈতিক পরিবর্তন আসছে করালী তা উপলব্ধি করে। অর্থনৈতিক উন্নতির মধ্য দিয়ে জীবনের আর একটা অর্থ খুঁজে পায় সে। সে লাইন মাটি নয়। বাঁশবাদি তার কাছে একটা বৃদ্ধস্থাবর জড়বস্তু। মাটির টানের থেকে নারীর দেহের টান তার কাছে বড়াে। করালী ভাগ্যবাদী নয়, জীবনবাদী। সে জীবন পাপ-পুণ্যের বিচারে চলে না। চলে যুক্তির টানে, বাস্তব টানে। করালী অতীতের চেয়ে বর্তমানকে গুরুত্ব দেয়। তার জমির টান নেই। মাটির গন্ধ তাকে আঞ্চত করে না। সে ভিন্ন প্রকৃতির। কাহারপাড়ায় করালী যেন ভিনদেশী মানুষ। জাত এক হলে কি হয়, রীতিকরণ আলাদা। বাকি, যে বাক্যি শিখেছে সে হাঁসুলী বাঁকের কাহার পাড়ায়, সেই মুখের বাক্যি পর্যন্ত আলাদা হয়ে গিয়েছে। করালী নতুন কালের ঈশারা অনুভব করেছে। সে অন্যান্য কাহারদের তুলনায় স্বতন্ত্র জীবন গড়তে চেয়েছে।

কাহারপাড়ার সেই প্রথম তুলল কোঠাঘর। এ ঘর তুলল বসবাসের জন্য নয়। প্রবীণদের ঠোক্কর দেবার জন্যে। ঘর করাটা তাে তার জেদ। কাহারপারায় কোঠাঘর তালা হল, চিরকালের নিয়ম আচারে লাথি মারা হল, হয়ে গেল কাজ। সে বাস করছে চন্ননপুরের সেই পাকা খুপরি কোয়ার্টারে। এই হচ্ছে করালীর জীবন-দর্শন। সে ভাঙতে যত ভালােবাসে, গড়তে তত নয়। আর কিছু গড়লেও স্থিত হতে তার মন চায় না সেখানে। আবেগের মাধুর্য তার কাছে গৌণ। তার লড়াই বনওয়ারীর সঙ্গে। সে মাতব্বরী মানে না। বিনত হাওয়া তার ধর্মে নেই। সে নবীন মাতব্বর। এই প্রবীণ নবীনের দ্বন্দ্বে দুটি চরিত্রই অত্যন্ত সজীব হয়ে উঠেছে। কিন্তু লড়াই বাঁধলেই আমাদের ফলাফল জানার আগ্রহ জন্মায়। কে জয়ী হল? প্রবীণ বনওয়ারী না নবীন করালী?

বাস্তব ঘটনাটুকু আগে দেখা যাক, তারপর মর্মকথা। কয়েক মুহূর্ত দুজনে স্তম্ধ হয়ে রইলে দাঁড়িয়ে দুজনের দিকে চেয়ে। বনওয়ারী যন্ত্রণায় কাতর। করালীরও অসহ্য যন্ত্রণা। যন্ত্রণা সামলে নিচ্ছে দুজন। তারপর পরস্পরের দিকে ছুটে এলাে বুনাে শুয়ােরের মতাে। প্রথমে ছুটল বনওয়ারী, সঙ্গে সঙ্গে করালী দুই বীর হনুমানের মতাে পরস্পরকে নিষ্ঠুর আক্রমণে জড়িয়ে ধরে পড়ল মাটিতে, ডুবে গেল গাছতলার সেই অন্ধকারের মধ্যে হাঁসুলী বাঁকের বাঁশবনের ছায়ায় একদিন যুদ্ধটা শুরু হয়েও শেষ হয় নাই। আজ শেষ না করে ছাড়বে না বনওয়ারী ; যুদ্ধ শেষ হয়েছিল। বনওয়ারী মারা গেল এই যুদ্ধেরই ফলে। জয়ী হল করালী, প্রবীণ গেল, নবীন এল। হাঁসুলী বাঁক তার সত্তা হারাল নবীন সভ্যতার বালুরাশিতে। বাঁশবন নিশ্চিহ্ন হল। মানুষগুলােও হল উৎখাত। করালী কোথায় ? হাঁসুলী বাঁকে করালী ফিরছে। সকল হাতে, গাঁইতি চালাচ্ছে, বালি কাটছে, বালি কাটছে, আর মাটি খুঁজছে। করলীর এই মাটি খোঁজা বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে হয়।

করালীর মাটি খুঁজছে কেন? তার মাটির কী প্রয়ােজন ? সে তাে কোনােদিন মাটির টানে ছিল না। ছিল মাতব্বর বনওয়ারী। সে প্রবীণকে করালী শেষ করেছে। মাটি ও বনওয়ারীকে যদি সমধর্মী ভাবি তাহলে বালি ও করালীকে ভাবা যায়। মাটির গুণ ও বালির গুণ এক নয়। বালি কাটলে বালির ধস নামে মাটি কাটলে নয়। বালি কাটতে কাটতে করালীর জীবনেও যেন ধস নেমেছে। আগের উদ্যত স্বভাব যেন মাটির টানে নত্র হয়েছে। সে মাটি কাটছে না, খুঁজছে। এই একটি ক্রিয়াপদ করালীর চরিত্রের গভীর দিক উদঘাটিত করেছে। করালী হাঁসুলী বাঁকের মাটি ও মানুষ খুঁজছে। তাদের স্মৃতি তাকে আচ্ছন্ন করে ফেলেছে। বালি সরিয়ে করালী বােধ হয় বনওয়ারীকে খুঁজছে- যে মাটিতে মিশে গেছে। প্রবীণের কাছে নবীনেব এ এক আত্মসমর্পণ, কিছুটা অর্পণও বটে।