লােকায়ত জীবনের জীবন্ত দলিল রূপে অন্যান্য স্বীকৃতি, তারাশংকরের হাঁসুলী বাঁকের উপকথা, উপন্যাস খানি। আঞ্চলিকতার মন্ত্রে সুগ্রথিত উপন্যাসটিতে বিশেষরূপে প্রতিফলিত হয়েছে লােকায়ত জীবনের নিত্য ব্যবহার্য নানা উপাদান। সমালােচক বরুণ কুমার চক্রবর্তী তাঁর অনুসন্ধিৎসু দৃষ্টি মেলে এ বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য আহর করেছেন। তিনি জানিয়েছেন হাঁসুলী নদীর বর্ণনা উপন্যাসের একেবারে প্রথমেই প্রদত্ত রয়েছে। লেখক সেই বর্ণনায় বলেছেন- “নদীর চেহারা হয়েছে ঠিক হাঁসুলী গয়নার মতাে।” উপন্যাসের প্রথম পৃষ্ঠাতে একই বক্তব্যের পুনরাবৃত্তি করে বলেছেন— “বর্ষাকালে। সবুজমাটিকে বেড় দিয়ে পাহাড়িয়া কোপায়ের গিরিমাটি গােলা জলভরা, নদীর বাঁকটিকে দেখে মনে হয় শ্যামলা মেয়ের গলায় সােনার হাঁসুলী।” হাঁসুলী লােকায়ত সমাজে বহুল ব্যবহৃত ও পরিচিত এক অলংকার। কৃষিজীবী মানুষের যন্ত্রপাতি নিত্যই ব্যবহার করে তার মধ্যে উল্লেখ কোদাল টামনা ইত্যাদি। প্রখর গ্রীষ্মে হাঁসুলী বাঁকের মাটি শুষ্ক অবস্থায় এমন কাঠিন্য পায় যে, “কোদাল কি টামনায় কাটেনা, কোপ দিয়ে কোদাল টামনারই ধার বেঁকে যায়।” বলে লেখক জানিয়েছেন।

গ্রাম্য লােকায়িত জীবনে যে সব লােকবাদ্য বাজানাে হয় তার মধ্যে উল্লেখযােগ্য বিষম ঢাকি। বজ্রপাতের শব্দের বর্ণনা দিতে গিয়ে লেখক বিষম ঢাকির বাজনার উল্লেখ করেছেন তুলনা দিতে গিয়ে। এরই মধ্যে কখনও ওঠে আকাশে টুকরােখানেক মেঘ দেখতে দেখতে বিদ্যুতের ঝিলিক খেলে যায় তার ওপর যেন কেউ আগুনে পড়া হাতের আঙুলের ঘা মেরে বাজিয়ে দেয় ওই কালো মেঘের বিষম ঢাকির বাজনা। অন্যতম লােকবাদ্য ঢােলের কথাও উল্লিখিত হয়েছে। ঢােল বাজিয়ে বােলান গান গীত হবার কথা জানিয়েছেন লেখক।

হাঁসুলী বাঁকের মানুষ মদ্য পান করে যেমন, তেমনিকাহারেরা পাড়ের ওপর বসে হুঁকো টানাে। ধূমপানের এই লােকায়ত উপাদান হুঁকার উল্লেখ লক্ষণীয়। ধূমপানের উপকরণাদির বর্ণনা দান প্রসঙ্গে লেখক জানিয়েছেন খড়ের খুটি, চকমকি, শােলা এবং বাঁশের চোঙের মধ্যে তামাক রাখার কথা। গােরুর পায়ে বসা মাছি মরার কৌশল ও উপাদানটির ব্যবহার লেখকের দৃষ্টিতে এড়িয়ে যায়নি। লেখক বলেছেন তালপাতা চিরে ঝাঁটার মতাে করে বেঁধে তাই দিয়ে আছড়ে মাছি মারে। তাড়িয়ে দেয়।

বন্য শূকর শিকারের কৌশলটিও বিশেষভাবে স্মরণ রাখতে হয়। হাতখানেক লম্বা বাখারির ফালির মাঝখানে আধহাত লম্বা শক্ত সরু দড়ি বেঁধে প্রান্তভাগে বাধে ধারালাে বড়শি। বড়শিতে টোপ এর মতাে গেঁথে দেয় কলা এবং খুব মদের মতাে। এমনই আট দশটা ছড়িয়ে রেখে দেয় পথে প্রান্তরে। মদের মাতাল গন্ধে আকৃষ্ট হয়ে শূয়াের বেটারা মাটি শুঁকে শুঁকে এসেই পরমানন্দে গপ করে মুখে পুরে দেয়। সঙ্গে সঙ্গে বড়শি গেঁথে যায় জিভে অথবা চোয়ালের মধ্যে। তখন পায়ে খুর দিয়ে টেনে বড়শি ছাড়াতে চেষ্টা করে তাতে ফল হল বিপরীত, চেরা খুরের মধ্যে বড়শীর দড়ি ঢুকে গিয়ে শেষে আটকায় একে বাখারির ফালিতে। একদিকে বড়শী আটকায় জিভে, অন্যদিকে দড়ি পরানাে খুব আটকায় বাখারিতে। বেটা শূয়াের নিতান্তই শূয়োরের মতাে ঠ্যাঙ তুলে তিন পায়ে বাঁড়িয়ে থাকে। কাহার বাড়ির মেয়েরা চুল আঁচড়ায় ‘কাঁকুই দিয়ে’ লেখক তার উল্লেখ করেছেন। শুধু তাই নয় এদের ঘরে যে কেরােসিনের ডিবে জ্বলে তাও বর্ণিত হয়েছে। লােকায়ত সমাজের মানুষকে পাখি শিকারে বাটুলের সাহায্য নেয়, সুচাঁদ করালীকে বাটুল ছুঁড়ে ঘুঘু মারতে দেখেছে বলে জানিয়েছে।

এছাড়া, হাঁসুলী বাঁকের এক পরিচিত যান পাল্কি। পাল্কি বহনকারীর মূলত বেহারা ও কাহার। বনওয়ারী এই চেহারা পাড়ারই মুরুব্বি। লেখক জানিয়েছেন—বনওয়ারীর এক পূর্ব-পুরুষ এক কাঁধে পান্কি নিয়ে এক ক্রোশ পথ অনায়াসে অতিক্রম করে যেত কাঁধ পরিবর্তন না করেই, আর সেই সুবাদেই ওদের বাড়ি পরিচিত হয়—কোষ বেঁধেদের বাড়ি চলে। সাহেবদের আমলে কুঠীতে দুখানি পাল্কির হাজির থাকার কথাও বলা হয়েছে। গ্রামীণ জীবনে মাদুরের তুলনায় তালপাতার চাটাইয়েরই অধিক ব্যবহার প্রচলিত অন্তত এক সময়ে তাে ছিল। পানু নিমতলার পশ্চিম দিকে যেখানে ছায়া পড়ে সেখানে তাল পাতার চাটাই বিছিয়ে মাতব্বরদের অভ্যর্থনা করেছে বলে উল্লিখিত হয়েছে। কাহাররা নিজেদের যে খেজুর পাতা তালপাতার চাটাই বুনে নেয় তা বলা হয়েছে। বসার জন্য ব্যবহৃত হয় কাঠের পিড়ি। বিশেষত সম্মানিত অভিজাত ব্যক্তির ক্ষেত্রে এই কাষ্ঠাসন প্রদত্ত হয়। বনওয়ারীর বউ গােলাপীবালা বড়ােঠাকুরকে উদ্দেশ্যে করে কাঠের পিড়ি দিয়েছে। উপন্যাসে পান্কি মদ ব্যতীত সে লােক খাদ্যটির উল্লেখ রয়েছে তাহল পান্তা ভাত। বমনের স্ত্রী, সুবাসীর মাসি। সে নাকি আবার কালােশশীর বােন, তার লঙ্কা, নুন, পিয়াজ সহযােগে পান্তা ভাত খাওয়ার প্রসঙ্গে বর্ণিত হয়েছে। লােভনীয় খাদ্য দ্রব্যাদির মধ্যে ও আর যা উল্লেখ আছে তা হল বাতাসা, মণ্ডা, মুরকি ইত্যাদি।

সবমিলিয়ে বলতে হয় লােকায়ত জীবনের নিত্য ব্যবহার্য গহনা, যান, বাদ্যযন্ত্র, খাদ্য প্রভৃতি নানা প্রকারের বিষয় সম্পূর্ণ রূপে উদঘাটিত হয়েছে। ‘হাঁসুলী বাঁকের উপকথাতে’ যা মূলত কাহারদের জীবনে কেন্দ্রীভূত।