বনওয়ারীর মতাে সরল না হলেও করালীর চরিত্র খুব জটিল নয়। সে-ও এক যৌগিক চরিত্র। বনওয়ারীর বিপরীত ও বিরােধী। আধুনিক যুগ ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অভিঘাতে কাহারদের সমাজে যে কেন্দ্রাতিগ শক্তির জন্ম হয়েছিল, যা প্রত্যক্ষবাদী ও পরবির্তনকামী আত্মবিস্তারে ও আত্মপ্রতিষ্ঠায় আগ্রহী, সে কারণে পরম্পরার প্রতিস্পর্ধী তার এক সার্থক ব্যক্তিরূপ করালী। কেন্দ্রাতিগ বলে তার গতি তির্যক ও তীব্র, উদ্দাম ও উল্লঙ্খনপ্রবণ। অনিশ্চয়তার, আকদ্মিকতার ও অভাবিতের নিত্য নূতন চমকে পূর্ণ এক চরিত্র করালী। কিন্তু সেই শক্তি যেহেতু আদৌ বিচ্ছেদকামী ছিল না, সেহেতু নিছক কেন্দ্রাতিগ নয়। কেন্দ্রের প্রতি তার টান অনবসিত। সেটা আর কেউ না বুঝুক বনওয়ারী বুঝেছিল। সেইজন্য করালীকে সে নিজের উত্তরাধিকারী করতে চেয়েছিল। বুঝেছিলেন তারাশংকরও। তাই, হাঁসুলী বাঁকে করালীর ফিরে যাবার দুর্মর ইচ্ছার কথা তাঁকে উপসংহারে বলতে হয়েছে। অনেকেরই তা মনঃপূত হয়নি, এমনকি, শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ের ও না। হাঁসুলী বাঁকে করালী ফিরে যাওয়াকে আপাতদৃষ্টিকে আকস্মিক আত্মখণ্ডন মনে হতে পারে, মনে হতে পারে ‘লেখকের পক্ষপাতমূলক ভাববিলাশ’, কিন্তু চরিত্রটির আগাগােড়া যদি মিলিয়ে দেখি, তা আবেগ ওই অভিপ্রায়কে যদি তলিয়ে দেখি, যদি তানুধাবন করি কোন পুরুষার্থের প্রেরণায় তার পিছুটান তাহলে তার প্রতি কনােই অভিযােগ টিকবে না।
করালী ব্যক্তিসত্তার বিকাশ লেখক ধারাবাহিকভাবে বর্ণনা না করলে ও তার স্তরগুলি, পুষ্টি ও প্রভাবের সূত্রাবলী জানিয়ে দিয়েছেন। তার যখন তিন বছর বয়স তখন বাপ মারা, গিয়েছিল। পাঁচ বছর বয়সের ছেলেকে ফেলে পালিয়ে গিয়েছিল মা। তার পিসি তাকে ঠাই দিয়েছিল, কিন্তু তার দিন কাটত বনে-বাঁদাড়ে মায়ের জন্য কেঁদে। বারাে বছর বয়স হতেই বনওয়ারী তাকে জাউলের ঘােষ বাড়িতে রাখালির কাজে লাগিয়ে দিয়েছিল। ভালােই ছিল সেখানে, কিন্তু বিপদ ঘটাল তার ভালােমানুষি। একদিন মিথ্যা চুরির অভিযােগ মেজ ঘােষ তাকে চটিজুতা দিয়ে মেরে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিলেন। বনওয়ারী চুরির অভিযােগ বিশ্বাস করেছিল এবং মেজ ঘােষের হুকুম মেনে মারবার সময় করালীর মাথাটা মাটিতে নুইয়ে ধরেছিল। খবরটা শুনে লজ্জিত হয়েছিলেন চন্দনপুরের স্টেশন মাস্টার। কেননা, তাঁরই শিশুকন্যার আব্দার রাখতে গিয়ে করালী পেয়েছিল অপবাদ ও শাস্তি। তাই তিনি নিজে করালীকে ডেকে স্টেশনের গুদামের কুলীর কাজ দিয়েছিলেন। শেষে লাইন ইন্সপেক্টারকে বলে ঢুকিয়ে দিলেন লাইনের কুলীন দলে। “সেইজন্যই না করালী আজ এই করালী, এবং এই সবের জন্যই সে অন্য দশজনের মতাে বনওয়ারীকে খাতির করতে চায় না এবং ঘােষ বাড়ির ছায়া ও মাড়াতে চায় না।” কেনাে ও কীভাবে সে কথায়—বার্তায় চালে—চলনে কাহার পাড়ার সকলের থেকে স্বতন্ত্র হয়ে উঠল, এই হল তার সংক্ষিপ্ত বৃত্তান্ত।
ইতিহাসের বিজয়ী নায়ককে যদিও তিনি উপন্যাসের নায়ক করেন নি, কেননা উপন্যাসটা তার বিজয়ের কাহিনি নয়, তবু ইতিহাসের প্রতি নিষ্ঠায় তাকে নায়কোচিত চরিত্র থেকে তাকে বঞ্চিত করেননি। রূপ, বুদ্ধি, সাহস, শক্তি, বীরত্ব, ঔদার্য, প্রেম- ইত্যাদি গুনে মণ্ডিত করে তাকে তিনি যােগ্য প্রতিনায়ক করে তুলেছেন। শিল্পীর যে নিরাসন্তির কথা বলা হয়ে থাকে, তার এক চমৎকার নিদর্শন করালী চরিত্র। বনওয়ারীর বেদনা ও বিনাশ আমাদের মর্ম স্পর্শ করে, আমাদের সহানুভূতি তার দিকেই ধেয়ে চলে হয়তাে, কিন্তু করালীর প্রতি আমরা বিরূপ হতে পারি না। আমার মুগ্ধ হই তার আধুনিক জীবনচেতনায়, অপরাজেয় ইচ্ছাশক্তিতে, ব্যক্তিত্বে বৈভবে। তার বুদ্ধি ও সাহস, সামাজিক অঙ্গীকার ও একক সংগ্রাম, মর্যাদাবােধ ও সৃজনশীলতা সমস্তই আমাদের নৈতিক সমর্থনে অভিনন্দিত হয়। যদি দেখি হাঁসুলী বাঁকের কাহারপাড়া ধ্বংস হয়ে গেলেও কাহারেরা ধ্বংস হয় না, তারই প্রদর্শিত পথ অনুসরণ করে নতুন ও নিরাপদ জীবন পায় তারা, তখন তার দুর্বিনীত আচরণ ও একটি দুটি অন্যায় সেই কীর্তিকে ম্লান করে দিতে পারে না। তা ছাড়া আমরা ভুলতে পারি না। যৌবন যেমন সৃজনশীল, তেমনি, হয়তাে সৃজনশীল বলেই কখনাে কখনাে উদ্ধৃত ও উল্লঙনপ্রবণ। পিতৃতুল্য বনওয়ারীর স্ত্রীর সঙ্গে তার প্রেম এবং ভূলুণ্ঠিত বনওয়ারীর মাথায় তার পদাঘাত আমাদের নীতিবােধে ঘােরতর অন্যায় সন্দেহ নেই, কিন্তু এ-কথা ও তার মানতে হবে যে, শিক্ষিত মধ্যবিত্তের নীতিবােধ আর কাহারদের নীতিবােধ এক নয়। যে সামাজিক পরিবেশে সে জন্মেছে ও বেড়ে উঠেছে, যে সামাজিক উত্তরাধিকার তার রক্তে বয়ে চলেছে, তার প্রভাব সে সম্পূর্ণ কাটিয়ে উঠবে—যেহেতু সে রেলে কাজ করে, এমন প্রত্যাশা বােধ হয় কাণ্ডজ্ঞানহীন তারাশংকর তাঁর ব্যক্তিগত নীতিবােধকে শমিত করে। শিল্পের ন্যায়কে শিরােধার্য করেছেন, অর্থাৎ পট ও চরিত্রের সম্পর্ককে মেনেছেন।
অবশেষে প্রায় সকলেই যারা তার ডাকে গিয়েছিল বলে তারা বেঁচে গিয়েছিল। বন্যায় হাঁসুলী বাঁক গেলেও তারা বেঁচেছিল। তারপর তারা চন্দনপুরে রেলের কাজ করে অনেক পাল্টে গিয়েছে। তবু ফিরে যেতে চায় বালিভরা হাঁসুলী বাঁকে। ফিরে যেতে চায় করালীও। আশ্চর্য কিন্তু অবিশ্বাস্য ও অসংগত নয়। শিকড়ের টানে মাটির খোঁজে সে ফিরে যেতে চায়। হাঁসুলী বাঁকের কাহারপাড়া থেকে শিকড় তুলে নিয়ে সে তাে চন্দনপুরে যেতে চায়নি। সে চেয়েছিল কাহারেরা পরম্পরায় আবদ্ধ না থেকে যুগের পরিবর্তনকে জানুক ও পরিবর্তিত হােক, ভােলা যায় কি, চন্দনপুরের রেলের পাকা কোয়ার্টার পেয়েও সে সন্ধ্যায় ফিরে যেত কাহার পাড়ায়, সেখানেই ঘর বেঁধেছিল পাখিকে নিয়ে, কীভাবে কোঠাবাড়ি তুলেছিল, কাহারদের দুর্দশা নিরসনে সে যে নিরন্তন চেষ্টা করেছে তার মধ্যে মৃত্যু হয়নি কি তা শিকড়ের টান, দৃঢ়মূল সামাজিক সত্তা? কাজেই কাহারেরা ছিন্নমূল হয়ে গেলে, বন্যায় কাহার পাড়া নিশ্চিহ্ন হয়ে গেলে, চন্দনপুরের মজুর পাড়ায় বাস করে সে যদি স্বরূপ হারানাের বেদনাকে মর্মে মর্মে অনুভব করে থাকে, ব্যাকুল হয়ে শিকড়ের সন্ধানে হাঁসুলী বাঁকে যায়, তবে তাকে অস্বাভাবিক বলব কোন যুক্তিতে?
উপসংহার শুনি, “করালী হাঁসুলী বাঁকে ফিরছে”। কোন হাঁসুলী বাঁকে সে ফিরছে? সে এক নতুন হাঁসুলী বাঁক। সেখানে বালি ঠেলে বাঁশের ঝোঁড়া বেরিয়েছে, উষর বালির বুকে কচি কচি ঘাস অপরাজের প্রাণের হাসি হাসছে। সেখানে মাটি খুঁজছে করালী। নতুন করে কাহার পাড়া গড়বে সে। নতুন রকমের বাঁধ দেবে। না বাঁশের বেড় দেবে না। এবার বালি মাটি বেইমান করে বাঁধ দেবে। দিয়ে, তার গায়ে শরবণ লাগাবে। বাঁশের বেড়ে আঁধার হয়। ইঙ্গিত দুরধিগম্য নয়। পুরনাে পরম্পরাবদ্ধ জীবন ফিরে চাইছে না সে। ফিরে যেতে চাইছে না উপকথার হাঁসুলী বাঁকে। সে চাইছে উন্মুলিত কাহারদের সামাজিক সত্তার পুনর্বাসন। তা সম্ভব কিনা সে প্রশ্ন অবান্তর, কিন্তু করালীর আকুলতা অসংলগ্ন নয়। তার স্বপ্ন সত্য-উপন্যাসে সত্যের যে অর্থ সে অর্থে। আরও একটা কথা। করালীর স্বপ্ন ও সন্ধ্যান নসুবালাকে উৎফুল্ল করেছে। নসুর কাছ থেকে তা শুনে উৎফুল্ল হয়েছে সুচাঁদ ও পাগল। ওদের কথা আলাদা। ওই স্বপ্নে ও সন্ধান স্বরূপচ্যুত করালীর সাত্ত্বনাহীন শােকের ব্যঞ্জনা পাই, স্বরূপ ফিরে পাবার জন্য তার করুণ চেষ্টাকে দেখি। তা না হলে সে লুকিয়ে গাঁইতি হাতে একা যাবে কেন? তারাশংকর করালীর স্বপ্নকে অলীক বলে উড়িয়ে দেননি। কিংবা নিজের স্বপ্নকে তার ওপর চাপিয়ে দেননি—যেমন দিয়েছেন ‘গণদেবতা’য় দেবনাথের ওপর।
Leave a comment