উপন্যাসে পাখির প্রসঙ্গে সুচাদের মুখে তার একটা জন্মবৃত্তান্ত পাওয়া গেছে। সুঁচাদের ফন্যা বসন্তের মেয়ে এই পাখি। মেয়ে কন্ত খুব ফর্সা নয়। কিন্তু পাখি তাে একেবারে হলুদমণি ‘পাখি’, চৌধুরী বাড়ির কর্তার ছেলে অকালে মারা গেল মদ খেয়ে। নইলে যুবতী পাখির এখনকার মুখের সঙ্গে তার মুখের আশ্চর্য মিল দেখা যেত। তেমনই বড়াে বড়াে চোখ, তেমনই সুডৌল নাক, চুলের সামনেটা পর্যন্ত তেমনই ঢেউ খেলানাে এই পাখি-বসন্তের মেয়ে-পাখি বাঁশবাদী গ্রামের হেঁপাে রুগী নয়ানের বিয়ে করা বউ। কিন্তু সে ডাকাবুকো করালীর প্রেমিকা। তার রং-এর (অঙ) মানুষ। পাখির কথা— “যার সঙ্গে মেলে মন, সেই আমার আপনজন। ইয়ের আবার বাসনই বা কি মাতব্বরিই বা কি? ওই হেঁপাে রুগীর ঘরে আমি থাকব না। পালিয়ে এসেছি আজ ছ’মাস। এখন একজনের সথে আমার মনে অঙ্গ ধরল। আমি, তার ঘরে এলাম। একি নতুন নাকি কাহারদের ঘরে?” নসুদিদি যখন বলে “ক্ষ্যামতা থাকলে চুলের মুঠোতে ধরে নিয়ে যাবে মরদের কিলে বাবা ভুলে যায়, তা অঙের নােক।”
পাখি প্রতিবাদ করে- “না হে না। অঙ যার পাকা হয়, অঙের নােকই পৃথিবীর মধ্যে ছেষ্ট”। করালীর প্রতি পাখির প্রেমের এই একনিষ্টতায় কোনাে খাদ নেই। নেই কোনাে কৃত্রিমতা। তাই সমাজ শাসনের ভয় সে না করেই হেঁপােরুগী নায়কের ছেড়ে করালীর সঙ্গে চন্ননপুরে শ্রমিক বস্তিতে অনায়াসে চলে যেতে পারে। অবশ্য কাহার পাড়াতে এ ঘটনা মহা অনিষ্টর ব্যাপারে কিন্তু অঙের কারবারী বনওয়ারীর অবচেতন মনে করালী পাখির এই প্রকৃত প্রেম প্রশ্রয় পায়। সে করালীকে ডেকে বলে— “ছুটি হলে বাড়ি যায় পাখিকে নিয়ে এখানে থাকার মতলব ভালাে নয়। উ-সব ছাড় বাড়ি যাস সাঙার ব্যবস্থা করে দেব”। এরপর ঘটা করে বাঁশবাদী গ্রামে নয়ানকে কাটান দিয়ে করালী পাখির সাঙা হয়। এইভাবেই পাখির প্রেমের এক পরিপূর্ণতা আসে।
পাখির মধ্যে জৈবিক তাড়না যেমন আছে, করালীর প্রতি তেমনই আছে নিবিড় ভালোবাসা, মােহ নয়, গভীর অনুরাগ। এই অনুরাগের সঙ্গে আছে জীবনীশক্তির প্রাবল্য যে প্রাবল্যে সে স্বামী ছাড়তে পারে, করালীকে শাসন করতে পারে চুলের মুঠো ধরে আবার করালীর বিশ্বাসঘাতকতার প্রতিশােধ নিতে ও পিছপা হয় না। কাটারি দিয়ে করালীর মাথায় আঘাত করতে ও সে কুষ্ঠিত হয়নি। শেষে আত্মহত্যায় অভিমানিনী জীবন বিসর্জন দিয়েছে। হাঁসুলী বাঁকের উপকথায় পাখি একেবারেই ব্যতিক্রমী চরিত্র। “কাহার কন্যা ক্ষেপে উঠলে দুকূল ভাঙা কোপাই-এর মতাে ভয়ঙ্করী” হয়ে যায়। কিংবা “কাহার পাড়ায় স্বামী যদি স্ত্রী থাকতে বিয়ে করে তবে স্ত্রী সঙ্গে সঙ্গে শাঁখা আর নােয়া খুলে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে স্বামীকে গাল দিতে দিতে চলে যায়—অন্য কোনাে কাহার মরদের ঘরে গিয়ে ওঠে। সতীনের সঙ্গ ঘর কাহার মেয়ে করে না।”
পাখি কিন্তু কাহার কন্যাদের মরদের ঘরে ওঠেনি। প্রবৃত্তির উর্ধ্বে ছিল তার স্বামী প্রেম। তাই সুবাসীকে করবার পর গােপালীবালা বনওয়ারীর ঘর কিছুদিন করেছিল, কিন্তু সুবাসীকে বনওয়ারীর ঘর থেকে করালী তুলে আনায় পাখির আত্মসম্বিতে ঘা লেগেছিল। নিজের মাথায় কাটারির ঘা না দিয়ে করালীর মান বসিয়ে দিল কাটারির ঘা। যদিও প্রাণে বেঁচে গিয়েছিল করালী। কিন্তু ‘বিধির বিধানে’ বনওয়ারের বাহনকে পুড়িয়ে মারার অভিশাপে করালী পাখির উম্মত্ত প্রণয় লীলার পরিণাম নয়ানের মার অভিশাপে এই রকমই অবধারিত সভ্য হয়ে যায়। তাই পাখির মৃত্যু বিধি নির্দিষ্ট বলেই তাে ট্রজিকরস বহন করে আনেনা। ড. শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভাষায় “এই অবৈধ প্রেমের অনিবার্য বিস্ফোরক শক্তির মাধ্যমে মানবের দৈব নিরপেক্ষ স্বাধীন ইচ্ছার স্ফুরণ হইয়াছে।” কিন্তু পাঠকের মনে “দৈব বিধানের প্রতি এরূপ ভীতিমিশ্র অথচ ন্যায়নুমােদিত স্বীকৃতি জাগায় নাই।” করালী ও পাখির প্রণয় সঞ্চার ও উহার ভয়াবহ পরিসমাপ্তি ওই একই সত্যের পরিপােষর্ক।
শরৎচত্র বঞ্চিত প্রেমের সান্ত্বনা খুঁজতে, বলেছিলেন, “বড়াে প্রেম শুধু কাছেই টানে না ইহা দূরেও ঠেলিয়া ফেলে।” তারাশংকর এ সান্ত্বনায় ব্যথা পাননি। বঞ্চনা ও নিষ্ঠুরতা তার শিল্পী মনকে ক্ষত বিক্ষত করেছিল। অথচ তিনি একই সঙ্গে দেখলেন নরনারীর রােমান্টিক সম্পর্কের গভীরতা আর বিপরীত দিক থেকে তারই বিকৃতরূপ। নারী সৃদয়ের আত্মােৎসর্গ যেমন দেখলেন তেমনি দেখলেন প্রবৃত্তিপরায়ণ মানুষের আদিম জৈবিক পিপাসা। পাখি এর সার্থক উদাহরণ। দুটি সত্তাই তার জীবন যৌবনে মুখ্য বিষয়। এমন চরিত্র তারাশংকরের অধিকাংশ উপন্যাসেই সুদুর্লভ। ঔপন্যাসিকের তাই সদর্থক মন্তব্য- “পাখিকে ভুলবার পথ রাখে নাই পাখি।”
Leave a comment