সুচাঁদ উপকথার নায়িকা। উপকথার ব্যাখ্যা করে সে। অশীতি পর এই বৃদ্ধা পৌরাণিক কল্পনা, অলৌকিক সংস্কার ও বিশ্বাস প্রাচীন কিংবদন্তী ও আখ্যান, সদ্য অতীতের ঘটনা প্রতিফলিত জীবনদর্শনের প্রতীক হিসেবে যেন এক দৈবশক্তির অনুভবকারিণী শক্তি। অলৌকিক দৈব-শক্তিকে সুচাঁদ অনুভব করে। এর ব্যাখ্যা করে তার পরবর্তী বংশধরদের আশ্চর্য করে দেয় প্রতিনিয়ত। “কাহার পাড়ার কতাে যে আচার, আর কতাে যে বিধানের মালিক সে” (তারাশংকর/হরপ্রসাদ মিত্র)। সূঁচাদ কাহারনী হাঁসুলী বাঁকের বাঁশবাদী গ্রামের সকলেরই পিসি। উপন্যাসের নায়ক বনওয়ারীর বাবার বাবার বাবা আর সুচাঁদের বাবার বাবা এক লােক। মেয়ে বসন, নাতনী পাখি, চারকুড়ি বয়সের অভিজ্ঞতায় সে হাঁসুলী বাঁকের তিন পুরুষের কাহিনি—এককথায় হাঁসুলী বাঁকের গােটা সংস্কৃতির কথক, সে সংস্কৃতি উপন্যাসের Prame of reference.

সুচাঁদের মুখ-নিঃসৃত কাহিনি ধরেই আলােক বর্জিত, আপন জীবন পিপাসায় উদভ্রান্ত এবং প্রকৃতির লীলা বৈচিত্র্যে অসহায় মানুষগুলির বাঁচামরার জীবন ইতিহাস আমরা জানতে পারি। তাদের আচার আচরণে ও ধর্মীয় জীবনাচরণে সুচাঁদের ভূমিকা যেন অলঙ্খ নিয়তির মতাে। বাবা কালারুদুর তার বাহন চন্দ্রবােড়া সাপ-কাহার সমাজের উপাস্য এবং সকল শক্তির নিয়ন্ত্রক সুচাঁদের আধিভৌতিক ও আধিদৈবিক বর্ণনায় সকলের বিশ্বাস হয়ে ওঠে- “ন্যাড়া মাথা ধবধব করছে রং, গলায় রুদ্রাক্ষি, এই পৈতে পরণে লাল কাপড় পায়ে খড়ম।” উপকথার ঢং-এ বৃদ্ধা সুচাঁদের মুখ দিয়ে গ্রামীণ সংস্কৃতির যে মুখ্য উপাদান ধর্মীয় আচার-আচারণ ও ব্রত পালন যার প্রতি ঔপন্যাসিকের গভীর আস্থা, তা বলানাে হয়েছে। সেই অর্থে সুচাঁদ “কাহার সমাজের ঐতিহ্য রক্ষক ও আধিদৈবিক বিপদের সংকেতবাহী” অর্থাৎ কাহার সমাজের অস্তিত্ব রক্ষার সদাজাগ্রত প্রহরী। তারজন্য সে বারবার অতীত রােমন্থন করে ঐতিহাকে বাঁচিয়ে রাখতে চায়। লৌকিক ও অপ্রাকৃত সংস্কার গােটা কাহার সমাজ বদ্ধমূল বিশ্বাস উৎপাদন করে। করালীর কৌশলে করালীর বাড়ির উঠোনে পড়ে থাকা মৃত বিষধর চন্দ্রবােড়া সাপটিকে দেখে সুচাঁদ যখন কেঁদে বলে—“ও যে আমার বাবাঠাকুরের বাহন রে। ওরই মাথায় চড়ে বাবাঠাকুর যে ভােমন করেন। আমি যে নিজের চোখে দেখেছি রে। দহের মাথায় বাবাঠাকুরের শিমূল গাছের কোটরে সুখে নিদ্রা যাচ্ছিলেন রে, আমি যে পরশু দেখেছি রে”। তখন আর অবিশ্বাসের কিছু থাকে না এই অশিক্ষিত, অজ্ঞ, অলৌকিকতায় বিশ্বাসী মানুষগুলাের।

সুচাঁদ কাহার সমাজের যেমন ঐতিহ্যরক্ষক তেমনি ভবিষ্যৎ দৃষ্টান্ত। তার ধারণা পূর্বপুরুষের জীবন পালনে ধর্মের বিরুদ্ধতা করা আর গ্রাম্য দেবতা কর্তা-ঠাকুরের প্রতি অবহেলার পাপ সামগ্রিকভাবে গ্রামে সমাজের ওপর প্রতিফলিত হবে। তাই সে কর্তাঠাকুরকে তুষ্ট করতে দশের মঙ্গল প্রার্থনায় মানসিক করতে জোড়া পাঁঠা দেওয়া না হলে “সব্বোনাশ হবে রে। সৰ্বোনাশ হবে। ও গাঁয়ের পিতুল নাই। আঃ আঃ হায় হায়রে”, বলে কাঁদতে থাকে। ড. শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন, “সে এই কাহার সম্প্রদায়ের Prophet বা অধ্যাত্মলােকের সহিত যােগাযােগ রক্ষার সেতু। তাহার অতীত স্মৃতিপুষ্ট, তীক্ষ্ণ অনুভূতির বেতার যন্ত্রে দেবালােকের নিগূঢ় অভিপ্রায়, আগামী বিপদের ছায়া, বর্তমান ঘটনার তাৎপর্য সমস্তই অভ্রান্তভাবেপ লিপিবদ্ধ ও বােধগম্য হয়।” এ উপন্যাসে সুচাঁদের মৃত্যু নেই। মৃত্যু হয়েছে গােলাপীবালার, বনওয়ারীর ; নয়ানের কালােবউ-এর পাখির, নয়ানের মা’র পড়ে গিয়ে পায়ের হাড় ভেঙে চন্নপুর হাসাপাতালের আধুনিক চিকিৎসায় সে সেরে ওঠে লাঠি ধরে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে ভিক্ষে করে বেড়ায়। আর হাঁসুলী বাঁকের উপকথা শােনায় বাঁশবনে ঘেরা তন্দ্রমাখা স্বপ্নসুলভ ছায়াচ্ছন্ন হাঁসুলী বাকের উপকথা।

বনওয়ারীর মৃত্যুর মধ্য দিয়ে সে ভেবেছিল হাঁসুলী বাঁকের উপকথার শেষ হল বুঝি। কিন্তু না শেষ কি করে হবে ? শেষ হয় না, তারাশংকর দেখান একটা অন্ত্যজ শ্রেণির আমূল বিপর্যয়ের পরও বাঁশবাদী গ্রামের ঐতিহ্য রক্ষয়িত্রী সুচাঁদ- আকাশের দিকে চেয়ে ভাবে ভাবে শেষ কি হয় ? কিছুর শেষ কি কখনও হয়েছে ? চন্দ্র সূর্য যতকাল, তার পরে ও তাে শেষ নাই, তার পরে যে আছেন মহাকাল। বাবা কালারুদ্দের চড়কপাটির ঘােরা। সে ঘােরার শেষ নাই। আলাে নাই, অন্ধকার নাই, তবু পাটা ঘােরার শেষ নাই। সেই ঘােরাতেই তাে কখন ও প্রলয়, কখনও সৃষ্টি। আঁধার সৃষ্টি ডােবে, আবার আলােতে ওঠে। তবে শেষ কবে হবে ? তার সুদৃঢ় বিশ্বাসের জগত বিবিধ বিধান দিয়ে তৈরি তাই নসুবালা যখন বলে- “বাঁশবাঁদির বাঁধে বালি ঠেলে (প্রবল বন্যা হয়ে যাবার পর) বাঁশের কোড়াে বেরিয়েছে। আর কি কচি কচি ঘাস। আর দেখে এলাম সেই ডাকাবুকোকে।” ডাকাবুকো করালী তাকে বলেছে— নতুন কাহার পাড়া হবে। ধন্যা রােধে নতুন বাঁধ দেবে—সেসব কথা শুনে সুঁচাদ দুহাত তুলে আনন্দে বলে ওঠে- আমার নতুন বাঁশের বেড়া উঠবে।

হাঁসুলী বাঁকের উপকথার কাহার সমাজের মাতব্বর বনওয়ারীর বিপর্যয় ও শােচনীয় পরিণাম ঘটার সঙ্গে সঙ্গে উপকথার ছােটো নদীটি ইতিহাসের বড়াে নদীতে মিশে যাবার পর করালীর বাঁশবাদীতে ফিরে আসা সুচাঁদের আধিভৌতিক আধিদৈবিক বিশ্বাসকে সুদৃঢ় করে। তাঁর দুহাতে তুলে আনন্দ প্রকাশের মধ্যে সেই ব্যঞ্জনাই ফুটে ওঠে। অতিপ্রাকৃতির ঘনকুহেলিকা মণ্ডিত জীবনচর্যার উপকথার মধ্যে হাঁসুলী বাঁকের উপকথাকে। তারজন্যই কি বেঁচে থাকে Prophet সুচাঁদ। উপন্যাসের শেষেও তাই সুচাদকে বাঁচিয়ে রাখেন ঔপন্যাসিক। সুচাঁদ হয়ে ওঠে হাঁসুলী বাঁকের উপকথার এক ক্লাসিক চরিত্র।