তারাশংকরের যে কটি উপন্যাসে আঞ্চলিকতার ছাপ আছে তার মধ্যে সর্বাপেক্ষা উল্লেখযােগ্য ‘হাঁসুলী বাঁকের উপকথা’। সার্থক আঞ্চলিক উপন্যাসের সর্বপ্রধান শর্ত হল— একটি বিশেষ অঞ্চলের ভৌগােলিক পরিবেশের বিশ্বস্ত চিত্র। অর্থাৎ আঞ্চলিক উপন্যাসের প্রাথমিক শর্ত ভৌগােলিক সীমা সংহতি। আলােচ্য উপন্যাসে লেখক এই শর্তটি বিশেষ নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করেছেন। যে বীরভূম জেলার কোপাই নদীর তীরবর্তী ‘বাঁশবাদি’ গ্রামের জীবনচিত্র এখানে অঙ্কিত হয়েছে তার ভৌগােলিক রূপ দিতে গিয়ে লেখক ‘হাঁসুলী বাঁক’ নামটির উৎপত্তি, গ্রামের অবস্থান, মূলত কৃষিজীবী কাহারদের জীবনের সঙ্গে জড়িত মাটি, ধান চাষের মাঠ, পাশাপাশি অবস্থিত অন্যান্য গ্রামের পরিচয়। কোপাই নদী কোপাই নদীর দহ, নীলকুঠি, রেলষ্টেশন ‘চন্দনপুর’ গাঁয়ের পূর্বদিক রেল লাইনটির কোপাই নদীর বিজ্রের ওপর দিয়ে চলে যাওয়া ইত্যাদি প্রসঙ্গে বর্ণনা করেছেন। এইসব বর্ণনা হাঁসুলী বাঁক অঞ্চলটির একটি ভৌগােলিক পরিচয় ফুটিয়ে তােলে। ম্যাপে যেমন আমরা রেখাচিত্র পাই, এখানে এই বর্ণনা ও তেমনি একটি রেখাচিত্র গড়ে নিয়ে অঞ্চলটিকে নির্দিষ্টভাবে চিনে নিতে সাহায্য করে।

হাঁসুলীর বাঁকে কোপাই নদীর তীরে কাহারদের যে জনজীবন গড়ে উঠেছে লেখক তাদের কতকগুলি সংস্কার ও বিশ্বাসের কথা বলেছেন, যা ছিল আঞ্চলিক উপন্যাসের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। সংস্কার ও বিশ্বাসের পরিচয় প্রসঙ্গে আমরা দেখি সবকিছুর ওপর একটি দৈবশক্তির প্রভাব কল্পনা করে নেওয়া এদের অভ্যাস। যেমন—করালী সে চন্দ্রবােড়া সাপটিকে পুড়িয়ে মারলাে, সেটিকে বাবা কালারুদ্রের বাহন বলে মনে করে নেওয়া, প্রায়শ্চিত্তের জন্য পূজার আয়ােজন করা, কর্তাবাবা যে বেলগাছটিতে থাকেন সেই গাছটিকে অন্য গাছের তুলনায় আলাদা করে দেখা, কোনাে অপরাধ করলে মনে মনে বাবার কাছে। ক্ষমা প্রার্থনা করা এবং বাবা যে ক্ষমা করলেন, তার প্রমাণ হিসাবে বেলগাছ থেকে বেল খসে পড়ুক—এরকম করা, কালােশশীর দহের জলে ডুবে মরার ব্যাপারটিকে কর্তাবাবার ক্রোধ বলে মনে করা, ‘পিতৃপুরুষের’ নিয়ম লঙ্ঘন করে করালীর কোঠাঘর তৈরি করাকে গর্হিত বলে ভাবা ইত্যাদি। আবার পিঁপড়ের সারি দেখে ঝড়জল হওয়ার সম্ভাবনায় বিশ্বাস। শক্ত মাটি কাটতে গিয়ে মাটির টুকরাে লেগে রক্ত পড়লে তারা ভাবে ধরিত্রী রক্ত যখন নিয়েছেন এখন দেবেন দুহাত ভরে—এই ধরনের বিশ্বাস ও সংস্কারের কাহারদের জীবন একটা ছাঁচ পায়।

স্থানীয় অঞ্চলের ভাষা ব্যবহারও আঞ্চলিক উপন্যাসের অন্যতম বিষয়। তারাশংকর এই উপন্যাসের ভাষায় আঞ্চলিক বৈশিষ্ট্য ফুটিয়ে তুলে অনায়াসে কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছেন। এই উপন্যাসের চরিত্রগুলি তাদের মুখের অকৃত্রিম ভাষার গুণেই জীবন্ত হয়ে উঠেছে। এই অশিক্ষিত মানুষগুলিকে শব্দোচ্চারণে কিছু বিশিষ্টতা আছে। এরা ‘ন’ বলে ‘ল’, ‘ল’ কে বলে ‘ন’, ‘র’কে বলে ‘অ’। যেমন- ‘লতুন’, ‘নেকন’, ‘অং’, ‘আম’। ঔপন্যাসিক জানাচ্ছেন- “শব্দের প্রথমে ‘র’ থাকলে সেখানে ওরা ‘র’ কে ‘অ করে দেয়। নইলে যে বেরােয় না জিভে তা নয়। শব্দের মধ্যপ্থলের ‘র’ দিব্যি উচ্চারণ করে।” যেমন রাতবিরাতস>আতবিরেত। রীতকরণ>ইতিকরণ, উপদ্রব>রােপােদরব, অপমান>রপমান, প্রতিবিধান>পিতিবিধান, ঈশ্বর>এশ্বর, অমৃত>অমরেতাে, প্রলয়>পেলয়, রক্ষে>অক্ষে, পেট>প্যাট, নিশ্চিন্ত>নিশ্চিন্ত, ইত্যাদি ; আবার মেয়েদের গালাগালিজ ভাষার বিশিষ্ঠতগুলাে বেটাখাকী লাে, ওলাে ভাতার খাকীলাে, নিব্বংশের বেটী লাে- তাের মুখে আগুন দিলাে।

মানুষের নামকরণের ব্যাপারেও আলিক বৈশিষ্ট্য লক্ষণীয়। এ ব্যাপারে লেখকের মন্তব্য- “বস্তু বা মানুষের আকৃতি বা প্রকৃতিকে লক্ষ্য করে নিজেদের ভাষাজ্ঞান অনুযায়ী বেশ সুসমঞ্জাস নামকরণ করে।” পাকু মন্ডলের আসল নাম পাকু নয়। এটি লােকের দেওয়া নাম। সে অতি বিচক্ষণ লােক। তার হিসাবের পাক অত্যন্ত জটিল-খুলতে গালে জট পাকায়। রতনের মনিবের স্থূল চেহারার জন্য নাম হয়েছে হেদো মন্ডল। নসুবালার নামটিও হয়েছে তা মেয়েলি স্বভাবের জন্য। গন্ডারের মতাে চেহারা বলে গন্ডার কাহার। পানুর বাড়ির উঠানে এক প্রকাণ্ড নিমগাছ, সেই কারণে তার নাম নিমতেলে পানু। মিনতেলে পানু ভেতরে তেতাে বাইরে মিষ্টি, সে হল ‘বিলাতী নিম। সেইরকম নাকু কর্মকার। সেজো ঘােষকে তারা বলে মাইতে ঘােষ।

সর্বোপরি বলতে হয়, হাঁসুলী বাঁকের উপকথায় একটি বিবর্তন আছে। সেই বিবর্তনে কাহার পাড়ার মাতব্বর বনওয়ারীর মৃত্যু। করালীর নতুন কালের নতুন জীবন প্রবণতায় বিশ্বাস স্থাপন, বাঁশবাদী, গ্রামের বিনষ্টি ইত্যাদি লক্ষিত হয় করালীর আবার বাঁশবাদী গ্রামে ফিরে আসা, বালি সরিয়ে সরিয়ে মাটি খোঁজা, আবার নতুন করে হাঁসুলী বাঁক নির্মাণের স্বপ্ন এই দিয়ে উপন্যাসের পরিসমাপ্তি। এই পরিণতিতে কালের প্রবণতা অস্বীকার করার মানসিকতা বােধ হয় লেখকের নেই। সেই জন্যেই বলেছেন নতুন হাঁসুলী বাঁক, করালী হাঁসুলী বাঁকের মানুষগুলির থেকে যতই আলাদা হােক, একেবারে বিচ্ছিন্ন নয়। একটা মানবতাবােধ গ্রামের প্রতি তার ছিলই, এমনকি বনওয়ারীর প্রতি ও, সেই সূত্রেই তার গ্রামে রা। কাহারেরা যে প্রকৃতি ও মাটির সন্তান তা উপেক্ষা করবে কি করে? তাই মনে হয়, করালীর শেষ কীর্তিটুকু পর্যন্তই হাঁসুলী বাঁকের ধারাবাহিক ইতিকথা। এই উপন্যাসের আঞ্চলিক উপন্যাসের প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলি সবই প্রতিফলিত, এক অসাধারণ বর্ণনা ভঙ্গীতে তারাশংকর উপন্যাসটিকে সার্থক আঞ্চলিক সাহিত্যের অন্তর্ভুক্ত করেও মহৎ শিল্প হিসাবে গড়ে তুলেছেন।