হস্তান্তরযােগ্য দলিল আইন, ১৮৮১

অধ্যায়-২

অঙ্গীকারপত্র, বিনিময়পত্র ও চেক

ধারা-৪ঃ অঙ্গীকারপত্র (Promissory note)—কোন ব্যক্তি কর্তৃক স্বাক্ষরিত একটি লিখিত দলিল (ব্যাঙ্ক নােট বা কারেন্সী নােট নয়), যা দ্বারা উক্ত ব্যক্তি কোন নির্দিষ্ট ব্যক্তিকে বা তার আদিষ্ট ব্যক্তিকে বা দলিলের বাহককে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ [চাহিবা মাত্র বা নির্ধারিত উপায়ে বা ভবিষ্যতে নির্ধারণযােগ্য সময়ে] পরিশােধের শর্তহীন প্রতিশ্রুতি দেয়, তবে উক্ত দলিলকে বলা হবে “অঙ্গীকারপত্র”।

উদাহরণসমূহ

নিম্নোক্ত শর্তে স্বাক্ষরিত দলিলসমূহঃ

(ক) “আমি ‘খ’-কে বা তার আদিষ্ট ব্যক্তিকে ৫০০/= [টাকা] প্রদানের প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি”।

(খ) “আমি ‘খ’-এর নিকট ১০০০/= [টাকা] ঋণ গ্রহণ করেছি মর্মে এরূপ স্বীকৃতি (acknowledge) দিচ্ছি যে, চাহিবামাত্র তা পরিশােধ করবাে”।

(গ) “আমি ‘খ’-এর নিকট ১০০০/= [টাকা] ঋণী”।

(ঘ) “আমি ‘খ’-কে ৫০০/= [টাকা] সহ অন্যান্য পাওনা পরিশােধের প্রতিশ্রুতি দিলাম।

(ঙ) “আমি ‘খ’-কে ৫০০/= [টাকা] প্রদানের প্রতিশ্রুতি প্রদান করলাম, তবে তা থেকে আমার প্রাপ্য অঙ্ক কর্তন করে রাখা হবে”।

(চ) “গ’-এর সাথে আমার বিবাহের সাত দিন পর ‘খ’-কে ৫০০/= [টাকা] আমি প্রদান করব।

(ছ) “এমর্মে প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি যে, ‘ঘ’-এর মৃত্যুর প্র ‘খ’-কে আমি ৫০০/= টাকা প্রদান করবাে, যদি ‘ঘ’ উক্ত অঙ্কের সমপরিমাণ টাকা আমার কাছে রেখে যায়”।

(জ) “আমি ‘খ’-কে ৫০০/= টাকা পরিশােধের প্রতিশ্রুতি প্রদান করলাম এবং আগামী ১লা জানুয়ারীতে আমার কালাে ঘােড়াটি তাকে প্রদান করব।

এখানে যথাক্রমে ক ও খ-কে নির্দেশিত দলিল দু’টি অঙ্গীকারপত্র বটে। কিন্তু অবশিষ্ট গ, ঘ, ঙ, চ, ছ ও জ-তে বর্ণিত দলিলসমূহ কোন অঙ্গীকারপত্র নয়।

আলােচনা

ধারার পরিধি (Scope): উপরের সংজ্ঞাবােধে বলা যায় যে, অঙ্গীকারপত্র বলতে সাধারণ অর্থে এমন কোন পত্র বা দলিলবিশেষকে বুঝান হয়, যাতে কোন ব্যক্তি অপর কোন ব্যক্তি একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ প্রদানের অঙ্গীকার প্রদান করে থাকে। যে ব্যক্তি এরূপ অঙ্গীকার প্রদান করেন তাকে অঙ্গীকারকারী এবং যার অনুকূলে অঙ্গীকার ঘােষণা করা হয়, তাকে অঙ্গীকারগ্রহীতা বলা হয়, এ প্রসঙ্গে Prof. H.K, Javid-এর বক্তব্য হল, “অঙ্গীকারপত্র হল প্রস্তুতকারক কর্তৃক লিখিত ও স্বাক্ষরিত এমন এক ধরনের দলিল, যাতে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা কোন ব্যক্তিকে বা দলিলের বাহককে প্রদান করার শর্তহীন অঙ্গীকার ব্যক্ত থাকে। আবার, বিলাতী বিনিময় বিলের সংজ্ঞামতে বলা যায় “অঙ্গীকারপত্র হল প্রস্তুতকারী কর্তৃক লিখিত ও স্বাক্ষরিত হস্তান্তরযােগ্য এমন দলিল, যেক্ষেত্রে উক্ত ব্যক্তি অপর কোন ব্যক্তিকে বা তার আদিষ্ট কোন ব্যক্তিকে বা বাহককে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ ভবিষ্যতে নির্ধারণযােগ্য একটি নির্দিষ্ট সময়ান্তে বা নির্দিষ্ট তারিখে প্রদানের শর্তহীন অঙ্গীকার ঘােষণা করে থাকে”।

পরিশেষে বলা যায়, অঙ্গীকারপত্র হল অঙ্গীকারকারী কর্তৃক লিখিত ও স্বাক্ষরযুক্ত এমন ধরনের হস্তান্তরযােগ্য দলিলবিশেষ, যখন উক্ত ব্যক্তি অপর কোন ব্যক্তিকে বা হস্তান্তরগ্রহীতাকে দলিলের বাহককে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ একটি নির্দিষ্ট সময়ান্তে বা চাহিবামাত্র প্রদানের শর্তহীন অঙ্গীকার ব্যক্ত করে থাকে। অঙ্গীকারপত্র তৈরীর নির্দিষ্ট কোন নিয়ম নেই। এটা একক বা যুক্তভাবে হতে পারে। যুক্তভাবে সম্পাদনের ক্ষেত্রে সম্পাদকগণ যুক্তভাবে দায়ী থাকেন। অঙ্গীকারপত্রে আগাম তারিখ দেয়া যাবে, তবে উল্লেখিত তারিখের আগে তা কার্যকরী হবেনা (এআইআর ১৯৫২ নাগ, ৩০৮]। যেক্ষেত্রে ঋণের স্বীকৃতি এবং তা পরিশােধের প্রতিশ্রুতি কোন দলিলে বিধৃত হয় এবং সে দলিলের উদ্দেশ্য যদি প্রতিশ্রুতিমূলক, স্বীকৃতি নয় বলে গণ্য হয়, তবে উক্ত দলিল একটি অঙ্গীকারপত্র হিসেবে স্বীকৃত হবে [এআইআর ১৯৩৭ এলাহা ১০১]। উল্লেখ্য যে, ১৯০৮ সালের তামাদি আইনের আর্টিকেল ৭৩-এর বিধানক্রমে প্রতিটি অঙ্গীকারপত্র প্রস্তুতের ৩ বছরের মধ্যে মােকদ্দমা করতে হবে। এক্ষেত্রে দেওয়ানী কার্যবিধির ৩৭নং আদেশের অধীনে তামাদি আইনের আর্টিকেল ৬৪ অনুযায়ী ঋণ পরিশােধের অব্যবহিত পরপরই ৩ বছরের মধ্যে উহা উদ্ধারের মােকদ্দমা করতে হবে [১৭ ডিএলআর (এসসি) ৫৩১]।

অঙ্গীকারপত্রের নমুনা (Form of Note) নিম্নে এর একটি নমুনা সরবরাহ করা হলঃ


অঙ্গীকারপত্রের বৈশিষ্ট্য (Features of Promissory Note) অঙ্গীকারপত্রের সংজ্ঞা বিশ্লেষণ করল দেখা যায় যে, একটি অঙ্গীকারপত্রের নিম্নলিখিত বৈশিষ্ট্যগুলাে বর্তমান, যেমন—

(১) ইহা অবশ্যই লিখিত হওয়া প্রয়ােজন;

(২) এতে দলিল লেখকের বা প্রতিশ্রুতিদাতার স্বাক্ষর থাকতে হবে;

(৩) ষ্ট্যাম্প আইনের বিধান মােতাবেক উক্ত দলিলে উপযুক্ত মূল্যের ষ্ট্যাম্প থাকতে হবে, ষ্ট্যাম্প লাগানাের পর তা বাতিল করে দিতে হবে। যদি তা বাতিল করা না হয় তাহলে উহা যথাযথভাবে ষ্ট্যাম্পযুক্ত হয়েছে বলে গণ্য হবেনা;

(৪) এতে অর্থ প্রদানের ব্যাক্ত প্রতিশ্রুতি থাকতে হবে, অর্থাৎ উক্ত প্রতিশ্রুতি অনুমেয় হলে চলবে না। শুধুমাত্র দেনা স্বীকার করলেই তা প্রতিশ্রুতি বলে গণ্য হবেনা। যেমন—“আমি মামুনের নিকট ৫,০০০/= টাকা ঋণী”। এটি অঙ্গীকারপত্র নহে, কারণ এক্ষেত্রে শুধুমাত্র দেন। স্বীকার করা হয়েছে।’ 

(৫) এতে অর্থ প্রদানের যে প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়, তা শর্তহীন হতে হবে। শর্তযুক্ত অর্থ প্রদানের প্রতিশ্রুতি কখনই অঙ্গীকারপত্র হতে পারেনা। যেমন-ক খ-কে গ-এর বিবাহের ১০ দিন পরে ৫০০/= টাকা প্রদান করবে মর্মে প্রতিশ্রুতি দিল। এক্ষেত্রে ইহা অঙ্গীকারপত্র হিসেবে বিবেচিত হবেনা, কারণ প্রতিশ্রুতিটি শর্তহীন নয়।

(৬) প্রতিশ্রুত অর্থের পরিমাণ নিশ্চিত ও নির্দিষ্ট হতে হবে। ক খ-কে তার বিবাহের সময় কিছু টাকা দিবে মর্মে প্রতিশ্রুতি দিল। এক্ষেত্রে উহা অঙ্গীকারপত্র হিসেবে গণ্য হবেনা, কারণ: প্রতিশ্রুত অর্থের পরিমাণ নিশ্চিত ও নির্দিষ্ট নহে।

(৭) কোন নির্দিষ্ট ব্যক্তিকে বা তার আদিষ্ট ব্যক্তিকে অর্থ প্রদানের প্রতিশ্রুতি দিতে হবে। প্রাপক কোন নির্দিষ্ট ব্যক্তি না হলে তা অঙ্গীকারপত্র বলে গণ্য হবেনা। অবশ্য প্রাপকের নাম ভুল লেখা হলে বা প্রাপকের নাম না দিয়ে তার পদ পরিচায়ক উপাধি দিলেও চলবে, এর জন্য অঙ্গীকারপত্র অবৈধ হবেনা।

(৮) প্রতিশ্রুত অর্থ দেশী বা চিহ্নিত মুদ্রায় প্রদান করবার প্রতিশ্রুতি থাকতে হবে। পণ্য বা বিদেশী মুদ্রা প্রদান করবার প্রতিশ্রুতি থাকলে উহা অঙ্গীকারপত্র হিসেবে গণ্য হবেনা।

(৯) ইহা চাহিবামাত্র দেয় বা কোন নির্দিষ্ট সময়ে পরিশােধ্য। ‘চাহিবামাত্র বাহককে দেয়’ এরূপ অঙ্গীকারপত্র বৈধ নয়, কারণ শুধু সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্ক এরূপ নােট ইস্যু করতে পারে।

(১০) এতে প্রতিশ্রুতিদাতার প্রদত্ত স্বাক্ষর কালি, পেন্সিল, রাবার ষ্ট্যাম্পের দ্বারাও হতে পারে।

নিম্নোক্তগুলি অঙ্গীকারপত্র নয় (The following are not promissory notes):

(১) “এ দিনে দু’শত একচল্লিশ টাকা আমি পেলাম। সম্মতি বা চুক্তির মাধ্যমে এ টাকার উপর মাসিক সুদ শতকরা ৩/৪ টাকা হারে নির্ধারিত হলাে” [25 Bom.373]।

(২) “মেম সাহেবার কাছ হতে পেলাম কোম্পানীর চল্লিশ টাকা এবং একমাসের জন্য আমি সুদ দিব, দুই টাকা” [23 Sutt. WR403]।

(৩) “এই দলিল—একটি হ্যান্ড নােট (ঋণ স্বীকারের খত) আমার দ্বারা সম্পাদিত হল ঘর কেনার উদ্দেশ্যে। আমি তােমার কাছ হতে সাত টাকা নিচ্ছি এবং ঐ টাকার উপর প্রতি মাসে প্রতি টাকার জন্য অর্ধ আনা হারে সুদ প্রদান করবাে। নগদ সাত টাকা পেয়ে এ হ্যান্ড নোেট সম্পাদিত করা হলাে” [15 Cal. 150]।

(৪) “আল্লাহ আমাদের রক্ষা করুন। এতদ্বারা ৪৩,৯০০/= টাকার এ রশিদ হােতির বাসিন্দা সাজ্জাদ খার দ্বারা সম্পাদিত হলাে।

এই পরিমাণ অর্থে অর্ধেক ২১,৯৫০/= হােতির মালিক জান-এর জন্য এবং করিম বক্স এন্ড সন্স এর পক্ষে ফার্ম-এর কাছ হতে পেলাম। এ টাকা দুই বৎসর পরে প্রদেয় হবে। বাৎসরিক পাঁচ টাকা চার আনা হারে সুদ আদায়যােগ্য হবে।”

“তারিখ এপ্রিল ৯, ১৯৫৭”

“ষ্ট্যাম্প যথাযথভাবে সংযুক্ত করা হয়েছে”

স্বাক্ষরঃ সাজ্জাদ খাঁ

করিম বক্স এন্ড সন্স

এর পক্ষে

অঙ্গীকারপত্রের ষ্ট্যাম্প মাশুল (Stanp duty of Promissry note) অত্র ধারা অনুযায়ী এবং ষ্ট্যাম্প আইনের ২(২২) ধারা অনুযায়ী সংজ্ঞায়িত অঙ্গীকারপত্রের ষ্ট্যাম্প মাশুল নিম্নোক্তরূপে নির্ণীত হবেঃ

(ক) যেক্ষেত্রে দাবীক্রমে, সেক্ষেত্রে-

(১) যখন অর্থের পরিমাণ বা মূল্য বা অনধিক এক হাজার টাকা সেক্ষেত্রে ষ্ট্যাম্প ৫ টাকার হতে হবে।

(২) যখন অর্থের পরিমাণ বা মূল্য এক হাজার টাকা উধ্বে কিন্তু অনুর্ধ পাঁচ হাজার টাকা সেক্ষেত্রে ষ্ট্যাম্প ১০ টাকার হতে হবে।

(৩) অন্যান্য ক্ষেত্রে ষ্ট্যাম্প ২০ টাকার হতে হবে।

(খ) যেক্ষেত্রে দাবীক্রমে ব্যতীত অন্য প্রকারে (প্রকারান্তে) প্রদেয় হয় সেক্ষেত্রে দাবিক্রমে ব্যতীত

প্রকারান্তরে বা অন্য প্রকারে প্রদেয় একই পরিমাণ অর্থের বিনিময় বিল (পরবর্তী ধারার আলােচনা অংশের “বিনিময় বিলের ষ্ট্যাম্প মাশুল” অংশ অনুসারে) বাবদ প্রদেয় একই পরিমাণ মাশুল হতে হবে।

সর্বশেষ নজীর (Latest Rulings) অঙ্গীকারপত্র হল এমনি একটি লিখিত দলিল, যার দ্বারা কোন নির্দিষ্ট ব্যক্তিকে বা কোন নির্দিষ্ট ব্যক্তির আদিষ্টকে বা দলিলের বাহককে নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ বা পরবর্তীতে নির্ধারিতব্য অর্থ চাহিবামাত্র পরিশােধার্থে প্রস্তুতকারী কর্তৃক সম্পাদিত একটি নিঃশর্ত প্রতিশ্রুতি বিশেষ, যা ব্যাঙ্ক নােট বা কারেন্সী নােট হিসেবে গণ্য হবেনা [সােনালী ব্যাঙ্ক বনাম হলে কৃষ্ণ দাস এবং অন্যান্য, ৪৯ ডিএলআর ২৮২]।