প্রশ্নঃ হস্তক্ষেপ কাকে বলে? কোন অবস্থার প্রেক্ষিতে এক রাষ্ট্র অন্য রাষ্ট্রের উপর হস্তক্ষেপ করলে তা ন্যায়সংগত বা সমর্থনযোগ্য হবে অথবা কোন কোন ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপ আন্তর্জাতিক আইনে বৈধ বলে গণ্য হয় অথবা একটি রাষ্ট্র অন্য রাষ্ট্রের উপর হস্তক্ষেপ করতে পারে কি অথবা একটি বৈধ রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপের ক্ষেত্র সমূহ আলোচনা কর? এই প্রসঙ্গে ড্রাগো নীতি ও মনরোনীতি আলোচনা কর।
ভূমিকাঃ সকলেই চায় তার নিজের কর্তৃত্ব বজায় রাখতে। এক রাষ্ট্র যদি অন্য রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীন বিষয় নিয়ে অনধিকার চর্চা করে তাহলে তা হস্তক্ষেপ হিসেবে গণ্য হয়। হস্তক্ষেপ সাধারণত অবৈধ বলে গণ্য হলেও কখনো কখনো তা বৈধ বলে প্রতিয়মান হয়।
হস্তক্ষেপ (Intervention) কাকে বলেঃ হস্তক্ষেপ এর অন্যতম একটি উপাদান হলো প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে হুমকি প্রদান করা। এক রাষ্ট্র কর্তৃক অন্য কোন রাষ্ট্রকে তার অভ্যন্তরীন বিষয়ে অনধিকার চর্চা করাকে হস্তক্ষেপ বলে।
অধ্যাপক ওপেনহাম এর মতে, কোন বিষয় পরিবর্তন করার জন্য বা স্থিতি অবস্থা বজায় রাখার জন্য এক রাষ্ট্র অন্য রাষ্ট্রের কার্যকলাপে প্রভুত্বমূলক মধ্যস্থতা করলে তাকে হস্তক্ষেপ বলে। অধ্যাপক হল এর মতে, কোন রাষ্ট্রের কোন আচরণকে তখনই হস্তক্ষেপ বলা যায়, যখন সংশ্লিষ্ট রাষ্ট্রের উপর বাধ্যতামূলকভাবে শক্তি প্রয়োগ করে তা কার্যকর করা হয়।
কোন অবস্থার প্রেক্ষিতে এক রাষ্ট্র অন্য রাষ্ট্রের উপর হস্তক্ষেপ করলে তা ন্যায়সংগত বা সমর্থনযোগ্য হবেঃ
অথবা কোন কোন ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপ আন্তর্জাতিক আইনে বৈধ বলে গণ্য হয়ঃ
অথবা একটি রাষ্ট্র অন্য রাষ্ট্রের উপর হস্তক্ষেপ করতে পারে কিঃ
অথবা একটি বৈধ রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপের ক্ষেত্র সমূহঃ
হস্তক্ষেপ করলে সংশ্লিষ্ট দেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব লংঘিত হয়। তবে কখনো কখনো কোন দেশের উপর হস্তক্ষেপ করলে তা সমর্থনযোগ্য হয় বা বৈধ বলে গণ্য হয়। নিম্নে তা উল্লেখ করা হলোঃ
(১) মানবতা বিরোধী অপরাধের বিরুদ্ধে হস্তক্ষেপ করলে : যদি কখনো কোন রাষ্ট্র মানবতা বিরোধী অপরাধ করে তাহলে তার বিরুদ্ধে হস্তক্ষেপ করা আইনের দৃষ্টিতে সমর্থনযোগ্য । কোন জাতি, ধর্ম বা বেসামরিক জন্যগণকে অত্যাচার, নিপীড়ন, নির্যাতন, হত্যা, ধর্ষণ বা নির্মুল করার উদ্দেশ্যে অপরাধ সংঘটিত করা হয় তাহলে তার বিরুদ্ধে হস্তক্ষেপ করা যেতে পারে। এটি আন্তর্জাতিক আইনে সমর্থনযোগ্য।
(২) জাতিসংঘের মাধ্যমে হস্তক্ষেপ করলে : যদি কোন রাষ্ট্র ক্রমাগত অপরাধ করে যায় তাহলে সেই রাষ্ট্রর বিরুদ্ধে শান্তির লক্ষ্যে জাতিসংঘের গৃহীত নির্দেশ অনুযায়ী হস্তক্ষেপ করলে তা আইনত বৈধ হবে।
(৩) বেআইন হস্তক্ষেপ প্রতিহত করার ক্ষেত্রে : যদি কোন রাষ্ট্র বে-আইনীভাবে অন্য কোন রাষ্ট্রের উপর হস্তক্ষেপ করে তাহলে সেই অবৈধ হস্তক্ষেপ প্রতিহত করার লক্ষ্যে হস্তক্ষেপকারী রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে হস্তক্ষেপ করা যায়।
(৪) আন্তর্জাতিক আইন লংঘন করলে : যদি কোন রাষ্ট্র আন্তর্জাতিক আইন লংঘন করে বা লংঘন করার চেষ্টা করে তাহলে সেই রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে আইনসম্মতভাবে হস্তক্ষেপ করা যায়।
(৫) বিদেশীদের জীবন ও সম্পত্তি রক্ষার্থে : বিদেশে অবস্থানরত ব্যক্তিদের জীবন ও সম্পদ রক্ষা করা যদি হুমকির সম্মুখীন হয় বা তাদের বিরুদ্ধে অন্যায়ভাবে আক্রমণ করা হয় তাহলে উক্ত রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে হস্তক্ষেপ করা যায়।
(৬) আত্মরক্ষা করার জন্য : কোন রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব হুমকির মুখে পড়লে বা বিপদের আশংকা মনে করলে সেই রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে হস্তক্ষেপ করা যায়।
(৭) সন্ধি বা চুক্তি পালনে অবহেলা করলে : যদি কোন রাষ্ট্র সন্ধি বা চুক্তি পালনে অবহেলা করে অসম্মতি জ্ঞাপন করে তাহলে সেই রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে হস্তক্ষেপ করা যায়৷
এই প্রসঙ্গে ড্রাগো নীতি ও মনরো নীতি আলোচনাঃ
ড্রাগো নীতি : ড্রাগো নীতিটি ঘোষণা করেন আর্জেন্টিনার পররাষ্ট্র সচিব। তিনি এই নীতিটি ঘোষণা করেন ১৯০২ সালে। চক ড্রাগো নীতির মূল কথা হলো- একটি রাষ্ট্র অপর কোন রাষ্ট্রের নিকট থেকে তাদের প্রাপ্য সরকারি ঋণ আদায়ের জন্য হস্তক্ষেপের অধিকার প্রয়োগ করতে পারে না।
এই নীতিটি ঘোষণা করা হয় যখন বৃটেন ও জার্মানি তাদের স্ব স্ব নাগরিকদের পাওনা ঋণ আদায়র করার জন্য ভেনুজুয়েলা অবরোধ করে তখন।
পরবর্তীতে ১৯০৭ সালে হেগ সদন দ্বারা এই নীতি গ্রহণ করা হলেও এর সাথে যোগ করা হয় যে, ঋণগ্রস্ত রাষ্ট্র বিষয়টি সালিমীতে প্রেরণ অথবা রায় মানতে অস্বীকার করলে সামরিক হস্তক্ষেপ করা যাবে।
মনরো নীতি : আমেরিকার সাবেক এক প্রেসিডেন্টের নাম মনরো। তিনি ১৮২৩ সালে হস্তক্ষেপ সম্পর্কিত এক ঘোষণা দেন, যা মনরো নীতি হিসেবে পরিচিত।
আমেরিকা, স্বাধীনতা লাভ করে ১৭৭৬ সালে। এ সময় ইউরোপের কিছু দেশ দক্ষিণ আমেরিকার দেশগুলিতে রাজনৈতিক ব্যাপারে হস্তক্ষেপের চেষ্টা করছিলো। ইউরোপ কর্তৃক উক্ত অঞ্চল দখলের অভিসন্ধির প্রতিবাদে প্রেসিডেন্ট মনরো ৩টি নীতি ঘোষণা দেন। তিনি বলেন-
(১) ইউরোপীয়ানরা আমেরিকা মহাদেশে হস্তক্ষেপ করুক এটা আমরা চাই না।
(২) আমরা ইউরোপে কোন হস্তক্ষেপ করবো না, তারা যেন এখানে হস্তক্ষেপ না করে।
(৩) ইউরোপ কোন হস্তক্ষেপ করলে তা আমেরিকার বিরুদ্ধে হস্তক্ষেপ ধরা হবে।
কিন্তু পরবর্তীতে প্রেসিডেন্ট মনরো নিজেই উক্ত ঘোষণা লংঘন করেন। তিনি ইউরোপে হস্তক্ষেপ করেন।
ইউরোপ এবং আমেরিকা একে অন্য মহাদেশে কোন হস্তক্ষেপ করবে না এটি ছিল মনরো নীতি মূল কথা।
তবে মনরোর ঘোষণাটি একটি রাজনৈতিক দলিলই ছিল। এর কোন কার্যকারিতা ছিল না। এছাড়া অন্য কোন শক্তি আনুষ্ঠানিক ভাবে এই দলিল অনুমোদন করেনি।
উপসংহারঃ আন্তর্জাতিক আইনে হস্তক্ষেপ একটি বিশেষ ঘটনা। সাধারণত হস্তক্ষেপের মাধ্যমে অন্য রাষ্ট্রে অনধিকার চর্চা করা হয়। অযাচিত হস্তক্ষেপ কারো কাম্য নয়। তবে কখনো কখনো এই হস্তক্ষেপ অনিবর্য হয়ে পড়ে। আর সেক্ষেত্রে হস্তক্ষেপ অবৈধ বলে গণ্য হয় না। বরং উক্ত হস্তক্ষেপ আন্তর্জাতিক আইন সমর্থিত বলে গণ্য হয়।
Leave a comment