হরপ্পা-সভ্যতা আবিষ্কারের পর এই সভ্যতা বিস্তৃতি, প্রাচীনত্ব, বৈশিষ্ট্য ইত্যাদির মতই পৃথিবীর অন্যান্য প্রাচীন সভ্যতাগুলির সাথে এর সম্পর্কের বিষয়টিও বহুভাবে আলোচিত হয়েছে। সমসাময়িক সভ্যতাগুলির সঙ্গে যোগাযোগ প্রসঙ্গে প্রথমেই মেসোপটেমিয়-সভ্যতার সাথে এই সভ্যতার সম্পর্কের বিষয়টি আলোচ্য উভয় সভ্যতার মধ্যে সাদৃশ্য এত বেশি যে একদা হুইলার প্রমুখ এই মত প্রকাশ করেছিলেন যে, মেসোপটেমিয়-সভ্যতা থেকেই হরপ্পা-সভ্যতার উদ্ভব ঘটেছে যা মেসোপটেমিয়-সভ্যতার অধিবাসীরাই হরপ্পা সভ্যতার স্রষ্টা। এই তথ্য ঠিক হোক বা না হোক, অর্থাৎ মেসোপটেমিয়-সভ্যতা থেকে হরপ্পা সভ্যতার সৃষ্টি যদি নাও হয়ে থাকে, তবুও উভয়ের মধ্যের সাদৃশ্যগুলি যথেষ্ট দৃষ্টি আকর্ষণ করে। যেমন প্রথমত, উভয় সভ্যতাই নদীমাতৃক। মেসোপটেমিয়ার সভ্যতা গড়ে উঠেছিল টাইগ্রীস-ইউফ্রেটিসের তীরে আর হরপ্পা-সভ্যতা গড়ে উঠেছিল সিন্ধুনদের অববাহিকায়। দ্বিতীয়ত, উভয় সভ্যতাই বিকাশলাভ করেছিল তাম্রযুগে। তৃতীয়ত, উভয় সভ্যতার মানুষই মাতৃপূজা করত, কুম্ভকারেরা চাকায় মৃৎপাত্র নির্মাণ করত, বাড়ি তৈরিতে পোড়া ইট ব্যবহার করত, উভয় সভ্যতার নগরগুলিতেই উন্নত পয়ঃপ্রণালী ব্যবস্থা দেখা যায় ইত্যাদি। সম্ভবত দুটি সভ্যতাই ছিল বিবর্তনের প্রায় সমস্তরে। তাই পারস্পরিক যোগাযোগের ও গ্রহণ বিনিময়ের মাধ্যমে উভয়ের মধ্যে এরূপ সাদৃশ্য গড়ে উঠেছিল।
মেসোপটেমিয়া ও হরপ্পা সভ্যতার মধ্যে ঘনিষ্ঠ বাণিজ্য সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। সম্ভবত বালুচিস্তানের মধ্য দিয়ে এই বাণিজ্যিক আদান-প্রদান চলত। জলপথে পারস্য উপসাগরের মধ্য দিয়ে বাহরিন বন্দরের মাধ্যমেও বাণিজ্য চলত। হরপ্পা-সভ্যতায় প্রাপ্ত সীলের অনুরূপ মেসোপটেমিয়ায় পাওয়া গেছে। মার্শাল এলামে প্রাপ্ত সীলের সাথে সিন্ধু সীলের সাদৃশ্যের উল্লেখ করেছেন। ম্যাকে টেল আসরামের সারগন যুগীয় স্তরে প্রাপ্ত দুটি নলাকৃতি ও বেলনাকৃতি সীলের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। এই দুটি নিঃসন্দেহে সিন্ধু উপত্যকায় সৃষ্ট। সম্রাট সারগনের সময়ে যে উভয় দেশের মধ্যে বাণিজ্য যোগাযোগ গড়ে উঠেছিল তার আরো প্রমাণ পাওয়া যায়। সারগণের কীর্তিকাহিনী বর্ণিত ফলক থেকে জানা যায় যে, তিনি পারস্য উপসাগরের তীর পর্যন্ত জয় করে দিলমুন, মগন ও মেলুহার সাথে আক্কাদের বাণিজ্যের পথ প্রশস্ত করেছিলেন। এই মেলুহাকে অধিকাংশ প্রত্নতাত্ত্বিকই সিন্ধু উপত্যকার সাথে সনাক্ত করেছেন। এছাড়া উর-এর তৃতীয় রাজবংশ, ইসিন যুগ ও লারসা যুগেও উভয় সংস্কৃতির মধ্যে যোগাযোগ ছিল, সীল থেকে তার প্রমাণ পাওয়া যায়। অন্যদিকে মেসোপটেমিয় সভ্যতার কিছু নিদর্শনও সিন্ধু উপত্যকায় পাওয়া গেছে। লাল পাথর, মাটির পাত্র, পাথরে খোদাই পাত্র ইত্যাদি কিছু দ্রব্য সিন্ধু উপত্যকায় পাওয়া যায়, যা সুমেরীয় সভ্যতার স্মৃতি মনে আনে। হরপ্পা ও চান-হু-দরোতে দুটি সীল পাওয়া গেছে, যাতে ডানা মেলা ঈগলের চিত্র রয়েছে। এই সীলগুলো মেসোপটেমিয়া সীলের অনুরূপ।
সম্ভবত মিশরীয় সভ্যতার সাথেও সিন্ধু সভ্যতার বাণিজ্যিক যোগাযোগ ছিল। কারণ এখানে ষাঁড়ের পায়ের মত পা-ওলা টুল, দীপধার, শিশুসহ মাতৃমূর্তি ইত্যাদি কয়েকটি নিদর্শন পাওয়া গেছে। এগুলি মিশরীয় রীতিতে গঠিত বলেই মনে হয়। আবার ব্যাবিলনীয় মানুষেরা কার্পাস বস্তুকে “সিন্ধম’ নামে অভিহিত করত। সম্ভবত সিন্ধু দেশ থেকেই ঐ বস্ত্র রপ্তানি হত। সুতরাং পশ্চিম এশিয়ার সভ্যতার সাথে হরপ্পা সভ্যতার ঘনিষ্ঠ বাণিজ্যিক ও সাংস্কৃতিক যোগাযোগ গড়ে উঠেছিল তাতে বিশেষ কোন সন্দেহের অবকাশ নেই।
হরপ্পা সভ্যতার সাথে বৈদিক সভ্যতার সম্পর্ক:
হরপ্পা-সভ্যতার ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কৃত হবার আগে পর্যন্ত ধারণা ছিল বৈদিক-সভ্যতাই ভারতের প্রাচীনতম সভ্যতা। এখনও কোন কোন পণ্ডিতের মতে, হরপ্পা-সভ্যতা ও বৈদিক সভ্যতা অভিন্ন। এঁদের মতে হরপ্পা-সভ্যতা বৈদিক-সভ্যতারই অঙ্গ। কারণ এঁরা মনে করেন, বৈদিক আর্যরা বহিরাগত কোন জাতি নয়। ভারতবর্ষই তাদের আদি বাসভূমি। তাই বৈদিক-সভ্যতার অঙ্গ হিসেবেই হরপ্পা-সভ্যতা গড়ে উঠেছিল। এঁরা এঁদের যুক্তির সপক্ষে উভয় সভ্যতার কিছু সাদৃশ্যের উল্লেখ করেছেন। বস্তুত উভয় সভ্যতার মধ্যে বেশ কিছু আপাত সাদৃশ্য পরিলক্ষিতও হয়। যেমন সিন্ধুবাসী ও বৈদিক-আর্যদের খাদ্য ও পোশাক ছিল প্রায় একরকম। গম, যব, ছাতু প্রভৃতি উভয় যুগেই খাদ্যরূপে গৃহীত হত। সিন্ধু-সভ্যতার নারীদের মত বৈদিক যুগের নারীরাও মণিমুক্তাখচিত অলঙ্কার পরিধান করত। উভয় আমলেই কেশবিন্যাসের রীতি ছিল একইরকম। উভয় ক্ষেত্রেই বয়নশিল্পে সাদৃশ্য পরিলক্ষিত হয়। সিন্ধুবাসী ও বৈদিক আর্য উভয় সম্প্রদায়ই তুলার চাষ করত এবং তুলা থেকে সূতা তৈরি করে বস্ত্রবয়ন করত। পরিশেষে বলা যায়, নৃতাত্ত্বিক পরীক্ষার দ্বারা সিন্ধু-উপত্যকায় আর্যদের কঙ্কালও আবিষ্কৃত হয়েছে। তাই ধরে নেওয়া যেতে পারে ঐ অঞ্চলে আর্যরাও ছিল।
এই সাদৃশ্যগুলি থাকলেও অধিকাংশ ঐতিহাসিকই হরপ্পা-সভ্যতা ও বৈদিক সভ্যতাকে অভিন্ন ভাবা যুক্তিযুক্ত নয় বলে মনে করেন। কারণ সময়গত ও সংস্কৃতিগত বহু প্রভেদ এদের মধ্যে বর্তমান। প্রত্নতাত্ত্বিক সাক্ষ্য ও রেডিও কার্বন পরীক্ষার ভিত্তিতে হরপ্পা-সভ্যতার একটি সময়কাল নির্ণয় করা হয়েছে। তার নিম্নতম কালসীমা হল ১৫০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের কিছু পূর্ববর্তী। অন্যদিকে পণ্ডিতদের মতে, ঋগ্বেদের রচনাকাল হল ১৫০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ বা তার কিছু পরবর্তী। ঋগ্বেদকেই যেহেতু আর্য-সভ্যতার সূচনা স্মারক বলে ধরে নেওয়া যায় সেহেতু হরপ্পা-সভ্যতা নিশ্চয়ই আর্য সভ্যতার পূর্ববর্তী ছিল। সুতরাং উভয় সভ্যতার মধ্যে সময়গত পার্থক্য বর্তমান ছিল।
উভয় সংস্কৃতির মধ্যে সময়গত ব্যবধান ছাড়াও আরও বিভিন্ন প্রকার বৈসাদৃশ্য পরিলক্ষিত হয়। যেমন প্রথমত, সিন্ধু-সভ্যতা ছিল নগরকেন্দ্রিক সভ্যতা। হরপ্পা ও মহেঞ্জোদড়োয় আবিষ্কৃত দ্বিতল পাকাবাড়ি, প্রশস্ত রাজপথ, উন্নত পয়ঃপ্রণালী, পরিকল্পিত স্নানাগার ও খাদ্যভাণ্ডার প্রভৃতি উন্নত নাগরিক জীবনের পরিচয় বহন করে। পক্ষান্তরে আর্যরা ছিল যাযাবর জাতি। তাদের নিজেদের রচিত স্তোত্রগুলিতেই তারা নগর ধ্বংসকারী হিসেবে চিত্রিত, নগর নির্মাণকারী হিসেবে নয়। পাকাবাড়ির মাটির দেয়ালযুক্ত বাড়িই ছিল তাদের প্রধান বাসস্থান। আর. এস. শর্মার ভাষায়, “At best Regvedic Aryans lived in fortified places protected by mud walls at the time of floods, and they cannot be regarded as town in Harappan sense.” পশুপালন ছিল আর্যদের প্রধান জীবিকা। পরবর্তীকালে কৃষিকাজে মনোযোগী হলেও তাদের মৌলিক চরিত্র ছিল যাযাবর জাতীয়। স্থানান্তরে ভ্রমণ করে ও পশুপালন করে তারা জীবিকা নির্বাহ করত। এইজন্যই প্রথমদিকে তাদের মধ্যে নাগরিক সভ্যতার উন্মেষ ঘটেনি। কিন্তু সিন্ধুবাসীরা স্থায়ীভাবে বসবাস করত এবং ব্যাপকভাবে কৃষিকাজ ও বাণিজ্য করে নিজেদের আর্থিক সমৃদ্ধি ঘটিয়েছিল।
দ্বিতীয়ত, হরপ্পা-সভ্যতায় লোহার প্রচলন ছিল না। এটি মূলত তাম্র-প্রস্তরযুগীয় সভ্যতা। লোহা তখনো আবিষ্কৃত হয়নি। কিন্তু বৈদিক যুগে লোহার ব্যাপক প্রচলন ছিল। নিত্যপ্রয়োজনীয় বহু জিনিস এরা লোহা দ্বারা নির্মাণ করত।
তৃতীয়ত, লোহার মতই ঘোড়াও হরপ্পাবাসীদের কাছে অজ্ঞাত ছিল বলেই মনে হয়। কারণ হরপ্পা-সভ্যতার একটিমাত্র ক্ষেত্রে ঘোড়ার কঙ্কাল আবিষ্কৃত হয়েছে, তাও একদম উপরের স্তরে। তাই হরপ্পা-সভ্যতার অধিবাসীরা ঘোড়ার সাথে পরিচিত ছিল কিনা বা পরিচিত থাকলেও ঘোড়াকে কাজে লাগাতে জানত কিনা সে সম্পর্কে নিশ্চিতভাবে কিছু বলা যায় না। অন্যদিকে আর্যদের কাছে ঘোড়া ছিল একটি বিশেষ প্রয়োজনীয় জন্তু। তারা ঘোড়ায় চেপে যুদ্ধ করত ও ঘোড়ায় টানা রথে চড়ত। তাদের যাযাবর জীবনকে গতিময় করে তুলেছিল ঘোড়া।
চতুর্থত, উভয় সভ্যতার মধ্যে ধর্ম ভাবনাগত বহু প্রভেদ ছিল। হরপ্পা-সভ্যতার মাতৃপূজার ও লিঙ্গপূজার ব্যাপক প্রচলন ছিল। কিন্তু আর্যদের মধ্যে মাতৃপূজার প্রচলন ছিল না ও তারা লিঙ্গপূজাকে ঘৃণার চোখে দেখত। হরপ্পা-সভ্যতার তুলনায় ঋগ্বেদের যুগে ধর্মাচরণ ছিল অনেক বেশি ব্যয়বহুল। খরচ সর্বস্ব যাগযজ্ঞ ছিল ধর্মাচরণের প্রধান মাধ্যম। কিন্তু হরপ্পার মাতৃপূজা ছিল সহজ ও অনাড়ম্বর। মার্শালের মতে, সিন্ধুবাসীরা ষাঁড়ের পূজা করত, কিন্তু আর্যরা গাভীর পূজা করত। সিন্ধু-সভ্যতায় অগ্নিপূজার কোন প্রমাণ পাওয়া যায় না, কিন্তু আর্যদের মধ্যে অগ্নিপূজার প্রচলন ছিল।
পঞ্চমত, সামাজিক রীতি-নীতি ও জ্ঞানচর্চার ক্ষেত্রেও উভয় সভ্যতার মধ্যে প্রভেদ ছিল। সিন্ধুর সমাজব্যবস্থা ছিল মাতৃকেন্দ্রিক, কিন্তু বৈদিক শাসনব্যবস্থা ছিল পিতৃতান্ত্রিক। হরপ্পা-সভ্যতার কেন্দ্রগুলিতে আবিষ্কৃত সমাধিস্থান থেকে বোঝা যায় ঐ যুগে মৃতদেহকে সমাধিস্থ করা হত। কিন্তু আর্যরা মৃতদেহকে ভস্মীভূত করত। সিন্ধু অধিবাসীরা ছিল মূলত বস্তুতান্ত্রিক। পার্থিব জীবনকে তারা বেশি গুরুত্ব দিত। কিন্তু বৈদিক সভ্যতা ছিল মূলত আধ্যাত্মিক।
ষষ্ঠত, হরপ্পীয়রা লিখন পদ্ধতি আয়ত্ত করেছিল। সিন্ধু-উপত্যকায় প্রাপ্ত অসংখ্য সীলমোহরে ঐ লিপি উৎকীর্ণ রয়েছে। অবশ্য আজ পর্যন্ত তার পাঠোদ্ধার সম্ভব হয়নি। অন্যদিকে আর্যরা জ্ঞানচর্চায় অগ্রণী হলেও তাদের মধ্যে লিখন পদ্ধতির প্রচলন ছিল না।
সপ্তমত, আর্যরা ছিল যুদ্ধপ্রিয় জাতি। তারা ঘোড়ায় চেপে উন্নত অস্ত্রশস্ত্রের সাহায্যে যুদ্ধ করত। কিন্তু হরপ্পাবাসীরা ছিল শান্তিপ্রিয়। তাদের অস্ত্রশস্ত্রও ছিল প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল।
অষ্টমত, উভয় আমলের মানুষদের খাদ্যাভ্যাসের মধ্যেও কিছু বৈসাদৃশ্য পরিলক্ষিত হয়। সিন্ধু-সভ্যতার যুগে মাছ ছিল অন্যতম প্রধান খাদ্য। ঐ যুগে ছোট জীবজন্তু, যেমন—শূকর, ছাগল প্রভৃতির মাংস ভক্ষণ করত। কিন্তু আর্যরা মাছ খেত না ও গোরু ঘোড়া প্রভৃতি মাংস খেত।
নবমত, হরপ্পাবাসী ও আর্যদের নির্মিত মৃৎপাত্রের মধ্যেও পার্থক্য ছিল। সিন্ধু উপত্যকায় আবিষ্কৃত মৃৎপাত্রগুলির রং ছিল কালচে লাল। কিন্তু আর্যদের ব্যবহৃত মৃৎপাত্রগুলির রং ছিল ধূসর। রং ব্যবহারের এই পার্থক্য দুটি সভ্যতার পৃথক অস্তিত্বের প্রমাণ দেয়।
সুতরাং হরপ্পা-সভ্যতা ও বৈদিক সভ্যতা অভিন্ন ছিল না এবং হরপ্পা-সভ্যতার তুলনায় বৈদিক সভ্যতা ছিল অনেক পশ্চাৎপদ।
Leave a comment