ডি. পি. অগ্রবালের ‘কার্বন-১৪’ পদ্ধতি দ্বারা গবেষণালব্ধ ফলের ভিত্তিতে মোটামুটিভাবে পরিষ্কার যে খ্রিষ্টপূর্ব ১৭৫০ অব্দের পর হরপ্পীয় সভ্যতার অন্তর্ভুক্ত বেশিরভাগ শহর এবং গ্রাম তাদের জীবন-জীবিকার ধারা থেকে বিচ্যুত হয়েছিল। দীর্ঘকাল উন্নত সংস্কৃতির ধারক হরপ্পীয় সভ্যতার হারিয়ে যাওয়া কিছুটা বিস্ময়কর। হরপ্পা সভ্যতার সমৃদ্ধ কেন্দ্রগুলির ভেঙে পড়ার কারণ সম্পর্কে গবেষক প্রত্নবিদরা নানা তথ্য উপস্থাপন করেছেন। একটা বিষয়ে সবাই একমত যে, কোন একটি বিশেষ কারণে কিংবা আকস্মিক এমন একটা উন্নত সংস্কৃতির বিলয় ঘটতে পারে না। সম্ভবত একাধিক কারণ দীর্ঘ সময় ধরে সভ্যতার অবক্ষয় ও অবসানের পটভূমি তৈরী করেছিল। একদিকে তাৎক্ষণিক বৈদেশিক শত্রুর আকস্মিক আক্রমণ, প্রাকৃতিক বিপর্যয় ইত্যাদি এবং অন্যদিকে সুদূরপ্রসারী অভ্যন্তরীণ অবক্ষয় হরপ্পীয় জনতাকে দেশান্তরী হতে বাধ্য করেছিল।
উৎখননের ফলে আবিষ্কৃত এই সভ্যতার শেষ পর্যায়ের নিদর্শনগুলি থেকে বোঝা যায় যে, হরপ্পা তার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য থেকে বিচ্যুত হয়েছিল। নগর কাঠামোয় পরিকল্পনার অভাব প্রকট। বৃহৎ অট্টালিকার স্থান দখল করেছিল ছোট ছোট পুরানো ইটের বাড়ি। শস্যাগারটি অব্যবহৃত অবস্থায় পড়ে আছে। সুপ্রশস্ত রাজপথ নেই। রাজপথের প্রায় ঘাড়ের ওপর গড়ে উঠেছে ছোট ছোট বাড়ি। দূর্গের উত্তরের এলাকার ঝিনুক কাটার এলাকায় গড়ে উঠেছে বসতবাড়ি, একই প্রাচীর নির্মাণে এলোমেলোভাবে ব্যবহার করা হয়েছে দু’টি আকারের ইঁট অর্থাৎ পৌরশাসনের তত্ত্বাবধানে হরপ্পাতে যে পরিকল্পিত নগরকাঠামো গড়া হয়েছিল, শেষ পর্যায়ে তা অতীতের বস্তুতে পরিণত হয়েছিল। সংস্কারের অভাবে ভেঙে পড়েছিল জলসরবরাহ ব্যবস্থা, নদীর গতিপথ পরিবর্তনের ফলে স্তব্ধ হয়েছিল বাণিজ্যিক সক্রিয়তা। এই কারণে হুইলার মন্তব্য করেছেন যে, শেষ পর্বের হরপ্পাসভ্যতা ছিল, পরিণত পর্বের ছায়ামাত্র।
হরপ্পীয় কেন্দ্রগুলি থেকে বিপুল সংখ্যক মানুষের বসতি ছেড়ে চলে যাওয়ার প্রবণতা ও কারণ খুঁজতে গিয়ে কেউ কেউ ভূ-প্রাকৃতিক পরিবর্তন ও বিপর্যয়কে দায়ী করেছেন। বন্যা, ভূমিকম্প, বনাঞল হ্রাস, মরু এলাকার ক্রমবৃদ্ধি ইত্যাদিকে হরপ্পাসংস্কৃতির বিনাশের অন্যতম কারণ হিসেবে এঁরা গুরুত্ব দিয়েছেন। সিন্ধুনদের বিধ্বংসী বন্যা হরপ্পার শহরগুলির ব্যাপক ক্ষতি করেছিল। পলি জমে নদীগর্ভ ভরাট হয়ে যাওয়ার কারণে জলস্ফীতি ও বন্যা ছিল অনিবার্য পরিণতি, যা জনজীবনকে অনিশ্চিত করত। বন্যার ভয়াবহতা প্রসঙ্গে প্রত্নবিদ রাইকস্ বলেছেন যে, সিন্ধুনদের জল অবরুদ্ধ হবার ফলে ক্রমাগত বন্যা ও প্লাবন হচ্ছিল এবং এর ফলেই সিন্ধু সভ্যতার বিলোপ ঘটেছিল। এস. আর. শাহানীর মতেও প্লাবন বা বন্যাই সিন্ধু-সভ্যতার বিলুপ্তি ঘটিয়েছিল। খননকার্যের ফলে অন্তত তিনবার বিধ্বংসী বন্যার প্রমাণ পাওয়া গেছে। বন্যার প্রকোপ থেকে নিজেদের বাঁচাতে সিন্ধুবাসী ৪৩ ফুট চওড়া একটি বাঁধ নির্মাণ করেছিল। পয়ঃপ্রণালীর উচ্চতা করা হয়েছিল ১৪ ফুট। বাড়িগুলির ভিত উঁচু করা হয়েছিল, যাতে বন্যার জল বাড়িতে ঢুকতে না পারে। বাড়ির যেসব স্থানে বন্যার জল লাগতে পারে, সেসব স্থান পোড়া ইঁট দিয়ে তৈরি করা হতে থাকে। বন্যার কারণে শহর পরিত্যক্ত হওয়ার দৃষ্টান্ত ভারতবর্ষে পরবর্তীকালেও ঘটেছে। এই প্রসঙ্গে ফেয়ার সার্ভিস দেখিয়েছেন যে, জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেলেও বসত এলাকা বাড়ানো হয়নি। ফলে মানুষ বন্যা-প্রবণ এলাকাতেও বসতি স্থাপন করেছিল। উপরন্তু কৃষিজীবী মানুষ পশুর স্বাধীন চারণভূমির বন্দোবস্ত করতে গিয়ে স্বাভাবিক উদ্ভিদের বিনাশ ঘটিয়ে খাদ্যাভাবের সম্ভাবনা বৃদ্ধি করেছিল। কিন্তু এক্ষেত্রেও বন্যার কারণে মহেঞ্জোদড়ো বা লোথাল শহর দুটি ধ্বংসপ্রাপ্ত হলেও অন্যান্য শহরগুলি, যথা— হরপ্পা, কালিবঙ্গান প্রভৃতি শহরের ধ্বংসের জন্য বন্যাকে দায়ী করা যায় না।
বন্যার হাত থেকে নিজেদের বাঁচাতে গিয়ে সিন্ধুবাসীরা আরও অনেক বিপদ ডেকে এনেছিল। যেমন—–বন্যার কারণেই হরপ্পা-সভ্যতার শহরগুলির অধিকাংশ বাড়ি ছিল পোড়াইটের তৈরি। ইট পোড়ানোর জন্য হরপ্পাবাসীরা যথেচ্ছভাবে বনজঙ্গল ধ্বংস করেছিল। বনাঞ্চল নষ্ট হবার অবশ্যম্ভাবী পরিণতি স্বরুপ এ অঞ্চলে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ক্রমশ হ্রাস পাচ্ছিল। বৃষ্টিপাতের পরিমাণ কমে যাওয়ার ফলে কৃষিকাজের চরম অবনতি ঘটে। প্রত্নতত্ত্ববিদ প্রজেল-এর মতে, বনাঞ্চল ধ্বংস হবার সাথে সাথে এই অঞ্চলের প্রাণীকূলও ধ্বংস হয়েছিল-একটি সভ্যতার টিকে থাকার পক্ষে যা ছিল অপরিহার্য। বনাঞ্চল ধ্বংস হবার ফলে মরুভূমির সম্প্রসারণ দ্রুত হয়েছিল বলে মনে করা হয়। আবার বন্যার কারণ হিসেবে ভূমিকম্পের প্রসঙ্গটি গুরুত্ব পেয়েছে। এই অঞ্চলটি ভূ-কম্পনের সংবেদী এলাকা হিসেবে চিহ্নিত। জলবিজ্ঞান বিষয়ে গবেষণা করে এঁরা বলেছেন যে, সিন্ধু-উপত্যকার নিকটবর্তী অঞ্চলেই ভূমিকম্পের উৎসস্থল ছিল, ভূমিকম্পেই এই সভ্যতা ধ্বংস হয়েছিল। তারা তাঁদের যুক্তির সপক্ষে মহেঞ্জোদড়োতে প্রাপ্ত ইতস্তত বিক্ষিপ্ত মৃতদেহগুলির কথা বলেন। কঙ্কালগুলিতে যে ক্ষত চিহ্ন দেখা যায়, সেগুলিও ভূমিকম্পের কারণে, হয়তো ঘরবাড়ি ভেঙে পড়ার ফলে সৃষ্টি হয়েছিল বলে তাঁরা মনে করেন। একই কারণে মৃতদেহগুলির সৎকার পর্যন্ত করা হয়নি। কিন্তু এ বিষয়ে বলা যায় যে, এই ভূমিকম্প তত্ত্ব মহেঞ্জোদড়োর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হলেও হরপ্পা-সভ্যতার অন্যান্য নগরগুলির ধ্বংসের ব্যাখ্যা এর থেকে মেলে না। এমনকি ভূমিকম্পের পরেও মহেঞ্জোদড়ো নগরটি পুনরায় নির্মাণ করা হয়নি কেন—সে প্রশ্নও থেকে যায়। এই প্রসঙ্গে হরপ্পীয়দের খাদ্য উৎপাদন ক্রিয়ার বা খাদ্যাভাসের পরিবর্তনের বিষয়টি উল্লেখ্য।
প্রাথমিক পর্যায়ে হরপ্পীয় সভ্যতার সকল অঞ্চল ছিল গম উৎপাদনের উপযোগী। পরবর্তীকালে গুজরাট, আলমগীরপুর, তাপ্তী নদীর উত্তর-পূর্ব এবং দক্ষিণদিকে সম্ভবত চাল উৎপাদনের একটা প্রচেষ্টা শুরু হয়েছিল। লক্ষণীয় যে, প্রথম পর্যায়ে হরপ্পীয় কৃষকেরা গম-উৎপাদক এলাকার বাইরে কোন বসতি গড়ে তোলেনি। কারণ সেখানে তাদের কৃষি-পদ্ধতি কার্যকরী হত না। কিন্তু গম থেকে চাল উৎপাদনে চলে যাওয়ার ফলে গাঙ্গেয় উপত্যকা এবং দাক্ষিণাত্যের উপকূল ও মালভূমি অঞ্চল তাদের কাছে উন্মুক্ত হয়ে গেল। হরপ্পীয় আদি এলাকাগুলি পরিত্যাগ করে কৃষকগণ নতুন এলাকায় বসতি স্থাপনে উৎসাহী হয়ে উঠেছিল। এইভাবে কৃষকসমাজের স্থানান্তরে পরিযান হরপ্পা সভ্যতার কেন্দ্রগুলিকে দুর্বল করে দেয়। যদিও এটি অনুমান, কিন্তু এ-কথা সত্য যে, প্রাক্-আর্যযুগে মধ্যগাঙ্গেয় ও নিম্নগাঙ্গেয় উপত্যকায় ধানচাষের পদ্ধতি জানা ছিল। এই প্রাক্-আর্য জনগণ হরপ্পার কৃষককুল হতেও পারেন।
পরিবেশগত পরিবর্তন বা প্রাকৃতিক বিপর্যয় হরপ্পা সভ্যতার ক্রমিক অবক্ষয়ের জন্য যতটা দায়ী ছিল, হরপ্পীয়দের চিন্তা-চেতনার দৈন্য তার থেকে কম দায়ী ছিল না। মানসিক বন্ধ্যাত্ব বা রক্ষণশীল মানসিকতা যে কোন জাতি বা সভ্যতার বিনাশ ঘটানোর পক্ষে যথেষ্ট। পরিবর্তনের সাথে সামঞ্জস্য বিধান করেই মানুষ অন্যান্য প্রজাতির থেকে অনেকটা এগিয়ে আছে এবং নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে সক্ষম হয়েছে। এই পরিবর্তন বহমান। অকস্মাৎ কেউ থমকে দাঁড়াতে চাইলে তার অস্তিত্ব বিপন্ন হতে বাধ্য। হরপ্পীয়দের ক্ষেত্রেও এই সত্যের ব্যতিক্রম ঘটেনি। হরপ্পীয়রা নতুন শিক্ষা গ্রহণ করে পরিবর্তন ঘটাতে উৎসাহী ছিল না। জনসংখ্যা বৃদ্ধি সত্ত্বেও গাঙ্গেয় উপত্যকায় কৃষি-অর্থনীতি প্রসারিত না হওয়ায় অর্থনৈতিক জীবনে জড়তা ঘনীভূত হয়। কোশাম্বীর মতে, লৌহজাত উপকরণের সাথে পরিচয় না থাকায় গাঙ্গেয় উপত্যকার ঘন জঙ্গল পরিষ্কার করে কৃষি-উৎপাদন বাড়ানো সম্ভব হয়নি। বাণিজ্যের সূত্রে হরপ্পীয়রা ব্যাবিলন এবং সুমারের খালের মাধ্যমে জলসেচ ব্যবস্থার সাথে পরিচিত ছিল। কিন্তু নিজেদের এলাকায় সেই ব্যবস্থা প্রবর্তনের কোন উদ্যোগ তারা নেয় নি। সুমারীয় এলামাইটদের তুলনায় হরপ্পীয়দের ধাতুবিদ্যার জ্ঞান ছিল সীমিত এবং খুবই সাধারণমানের।
ল্যামবার্ড কালোভস্কির মতে, হরপ্পার মানুষেরা সভ্যতার গোটা পর্বটিতেই কারিগরিবিদ্যা, বিশেষ করে ধাতু-বিদ্যার ক্ষেত্রে অনেক পশ্চাদপদ ছিল। প্রতিরক্ষার উপযোগী ধাতব ভারী অস্ত্র তৈরীর কোন উদ্যোগ হরপ্পা অঞ্চলে দেখা যায় না, যদিও সমকালীন ব্যাবিলন, সুমারে তার অস্তিত্ব ছিল। রক্ষণশীল মানসিকতার কারণে হরপ্পীয়দের কৃষি-সরঞ্জামে ব্রোঞ্জের ব্যবহার কম দেখা যায়। কাস্তে, লাঙল, নিড়ানী অধিকাংশক্ষেত্রেই পাথর কিংবা শক্ত কাঠের তৈরী। বিস্ময়ের বিষয় হল যে, প্রস্তরশিল্প, হাতির দাঁতের সৌখিন দ্রব্য নির্মারের জন্য তামা, ব্রোঞ্জের নানারকম যন্ত্রপাতি তখন ব্যবহার করা হত। তাহলে কি অভিজাত প্রশাসক গোষ্ঠী নিজেদের ব্যবহার্য সৌখিন দ্রব্য তৈরীর জন্য আধুনিক ধাতু ও যন্ত্রাদির প্রতি আকৃষ্ট হলেও; কৃষি সরঞ্জামের বিষয়ে উদাসীন থেকে ছিলেন? এই রক্ষণশীলতা নিঃসন্দেহে সভ্যতার অন্তঃসারশূন্যতার পরিচয় দেয়।
নগরাশ্রয়ী সভ্যতায় বাণিজ্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। শিরিন রত্নাগরের মতে, হরপ্পার নাগরিক সভ্যতার দ্রুত বিকাশের ক্ষেত্রেও বাণিজ্যের তাৎপর্য অপরিসীম। মেসোপটেমিয়া, বাহরিন কুয়েতের সাথে ভারতের দীর্ঘকাল বাণিজ্য সম্পর্ক বজায় ছিল। এর ফলেই হরপ্পার রাষ্ট্রকাঠামো, কেন্দ্রীয় কর্তৃত্ব ও উৎপাদনের ওপর নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল। বাণিজ্য-সূত্রে তৈরী হয়েছিল পরিশীলিত নাগরিক সমাজ ও বণিকশ্রেণী। খ্রিষ্টপূর্ব ১৮০০ অব্দ নাগাদ এই সামুদ্রিক বাণিজ্যে ভাটা পড়ে। ইউফ্রেটিস গতিপথ পরিবর্তন করলে দক্ষিণ মেসোপটেমিয়ার কৃষিতে মন্দা দেখা দেয়। তাদের রাজনৈতিক কেন্দ্র উত্তর অভিমুখে সরে যায়। ভারতের পরিবর্তে লেভান্ত ও আনাতোলিয়ার সাথে তাদের নতুন বাণিজ্যসম্পর্ক গড়ে ওঠে। স্বভাবতই বাণিজ্য-নির্ভর হরপ্পীয় নগরাশ্রয়ী সভ্যতার অর্থনীতি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। হরপ্পার উচ্চশ্রেণীর সম্পদের উৎস ক্ষয়ে গেলে জনসমাজের ওপরেও তার প্রভাব পড়ে। কর্মহীন শহরবাসী নগর পরিত্যাগ করে গ্রামমুখী হন। এতে সনাতন গ্রামীণ জীবনধারার ধারাবাহিকতা বিনষ্ট হয়। সামগ্রিকভাবে বাণিজ্যের অবসান হরপ্পা সভ্যতার মৌল কাঠামোটিকে ভেঙে দিয়ে তার পতন ত্বরান্বিত করে।
প্রত্নতাত্ত্বিক অবশেষের প্রেক্ষিতে হুইলার সহ অনেকেই মনে করেন যে, অন্তিমলগ্নে রক্তপাতের মধ্য দিয়ে হরপ্পা সভ্যতার চূড়ান্ত অবসান ঘটেছিল। উপত্যকা অঞ্চলে খননকার্যের ফলে প্রাপ্ত স্তূপীকৃত কঙ্কাল, মাথায় ভারী আঘাতের ফলে মৃত ব্যক্তির কঙ্কাল প্রভৃতি এই মতকে সমর্থন করে। কিন্তু এই রক্তপাত কেন ঘটেছিল সে বিষয়ে যথেষ্ট মতভেদ আছে। ঐতিহাসিক এম. ট্যাডির মতে, গৃহযুদ্ধ বা গোষ্ঠীদ্বন্দ্বই ছিল এই হত্যাকাণ্ডের কারণ। আবার অনেক ঐতিহাসিকদের মতে, বৈদেশিক শত্রুর আক্রমণের ফলেই এই হত্যাকাণ্ড ঘটেছিল। অর্থাৎ বিধ্বংসী গৃহযুদ্ধ বা বহিঃশত্রুর আক্রমণ এই সভ্যতার পতন ঘটিয়েছিল। অন্যদিকে হুইলার দৃঢ়তার সাথে বলেছেন যে, বহিরাগত আর্যজাতির আক্রমণ হরপ্পা-সভ্যতার পতন ঘটিয়েছিল। বহু ঐতিহাসিক এই মত সমর্থন করেন। এই মতের সমর্থনে তাঁরা একাধিক প্রমাণ উপস্থাপিত করেছেন। মহেঞ্জোদাড়োতে খননকার্যের ফলে যত্রতত্র ছড়ানো অবস্থায় বহু কঙ্কাল পাওয়া গেছে। একটি ঘরের মধ্যেই বেশ কতকগুলি কঙ্কাল পাওয়া গেছে। স্তূপের পাশে সিঁড়িতে শায়িত অবস্থায় কোন স্ত্রীলোকের মৃত্যু হয়েছিল বলে বোঝা গেছে। বিভিন্ন প্রত্নতাত্ত্বিক দৃষ্টান্ত থেকে হুইলার অস্বাভাবিক মৃত্যুর সত্যতা প্রমাণের চেষ্টা করেছেন। ‘ডি. কে.’ এলাকাতে চারটি কঙ্কাল বিশ্লেষণ করে বোঝা যায় যে তাদের হত্যা করা হয়েছে। ‘এইচ. আর.’ এলাকার পাঁচ নম্বর বাড়িতে তেরো জন বয়স্ক স্ত্রী ও পুরুষ এবং একজন শিশুর কঙ্কাল দেখা যায়। সম্ভবত আকস্মিক কারণে তাদের একসঙ্গে মৃত্যু হয়েছে। এমনকি বেশ কিছু কঙ্কালের খুলিতে ভারী কোন অস্ত্রাঘাতের চিহ্নও পাওয়া গেছে। সর্বোপরি মৃতদেহগুলিকে সমাধিস্থ করা হয়নি। এগুলি আকস্মিক আক্রমণের পক্ষে সাক্ষ্য দেয় বলে তাঁরা মনে করেন। পণ্ডিতদের মতে, এই আক্রমণকারীরা ছিল বহিরাগত আর্যজাতি। প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণার ফলে প্রাপ্ত সিন্ধু সভ্যতার বিলুপ্তির কাল ও আর্যদের ভারতে আগমনকালের সমসাময়িকতা এই তত্ত্বকে সমর্থন করে। সিন্ধু উপত্যকার ধ্বংসাবশেষ থেকে প্রাপ্ত কিছু মাথার খুলিতে ভারী অস্ত্রাঘাতের চিহ্ন পাওয়া গেছে। আবার ঝুকারে প্রাপ্ত সীলে সোজা ও ঋজু রন্দ্রযুক্ত একটি কুঠারের চিত্র পাওয়া গেছে। এমনকি মহেঞ্জোদড়োতে এই মজবুত তামার কুঠার পাওয়া গেছে। এই ধরনের কুঠারের সাথে ইরানীর কুঠারের সাদৃশ্য দেখা যায়। আর্যরাও যেহেতু ইরানের মধ্যে দিয়েই ভারতে এসেছিল বলে মনে করা হয় সেহেতু ঐ অস্ত্রটিকে আর্যদের অস্ত্র বলেই অনেকে চিহ্নিত করেন। ঋগ্বেদে বর্ণিত হরিগুপির যুদ্ধকে আর্যদের সাথে হরপ্পীয়দের যুদ্ধ বলে মনে করা হয়। এখানে বলা হয়েছে যে, সৃঞ্জয় নামক আর্যগোষ্ঠী দেবরাজ ইন্দ্রের সহায়তায় হরিয়পিয়ার (বাহরিগুপি) পূর্বভাগে অবস্থিত বরশিখ-বংশীয় যজ্ঞপাত্র ধ্বংসকারী বৃচীবৎদের নিধন করেছিলেন। কেউ কেউ মনে করেন, হরিয়পীয়ার ও হরপ্পা অভিন্ন এবং যজ্ঞপাত্র ধ্বংসকারীরা হল সিন্ধু সভ্যতার অধিবাসী। তাছাড়া, ঋগ্বেদে দেবতা ইন্দ্রকে ‘পুরন্দর’ বা ‘নগরের ধ্বংসকারী’ বলে বর্ণনা করা হয়েছে। সাধারণভাবে বলা যায়, আর্যদের আগমনকালে ভারতে হরপ্পা-সভ্যতা ছাড়া আর কোন নগর-সভ্যতা ছিল না। তাই ধরা যেতে পারে, ঋগ্বেদের দেবতা ইন্দ্র (পুরন্দর) সিন্ধুর নগর-সভ্যতাকেই ধ্বংস করেছিলেন। ১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দে হরপ্পার উপরের স্তরে একটি কবরখানা আবিষ্কৃত হয়েছে। ‘সিমেট্রি এইচ’ (C-H) নামক এই কবরখানা থেকে হরপ্পীয় এমন একটি সংস্কৃতির পরিচয় পাওয়া গেছে, যেটি অনেক পরবর্তীকালের। গর্ডন চাইল্ড এটিকে আর্যদের বলে মনে করেছেন। চানহুদরোয় খননকার্যের ফলে এর দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্তরে এমন একটি সংস্কৃতির নিদর্শন পাওয়া গেছে, যেটি হরপ্পীয় নয় বলে হুইলার ও পিগট মতপ্রকাশ করেছেন। এই সংস্কৃতিও অপেক্ষাকৃত পরবর্তীকালের। সমাধিক্ষেত্রে প্রাপ্ত মৃৎপাত্রগুলিকে আর্যদের দ্বারা নির্মিত বলে পিগট প্রমুখ চিহ্নিত করেছেন। কিন্তু সমস্যা হল পাঞ্জাবের আর্য-বসতিপূর্ণ এলাকায় যে সকল মৃৎপাত্র আবিষ্কৃত হয়েছে, তাদের সাথে সমাধিক্ষেত্রের (C-H) মৃৎপাত্রের সামঞ্জস্য তেমন নেই। তাছাড়া চিত্রিত ধূসর মৃৎপাত্রের তারিখ (খ্রিষ্টপূর্ব ২০০০ ১০০০ অব্দ) এবং হরপ্পার পতনের সম্ভাব্য তারিখের (খ্রিষ্টপূর্ব ১৬০০/১৫০০ অব্দ) মধ্যে সমন্বয় সাধন কষ্টকর। তাছড়া হরপ্পা-সভ্যতার শেষ পর্যায়ে যেসব নিদর্শন পাওয়া গেছে, তা থেকে মনে হয় এখানকার মানুষেরা কোন বহিরাগত আক্রমণের সম্ভাবনায় আশঙ্কিত হয়েছিল ও আত্মরক্ষায় তৎপর হয়েছিল। এইসব তথ্য প্রমাণের ভিত্তিতে একদল ঐতিহাসিক আর্যদের হরপ্পা-সভ্যতার ধ্বংসকারী রূপে চিহ্নিত করেন।
আর্য আক্রমণের ফলেই সিন্ধু সভ্যতা ধ্বংস হয়েছিল এই মতের বিপক্ষেও বেশ কিছু যুক্তি উপস্থাপিত করা যায়। মহেঞ্জোদড়োয় প্রাপ্ত ইতস্তত বিক্ষিপ্ত কঙ্কালগুলি কেবলমাত্র আর্য আক্রমণের সপক্ষেই প্রমাণ উপস্থাপিত করে না। ঐ হত্যাকাণ্ডের জন্য গৃহযুদ্ধ, প্রাকৃতিক বিপর্যয় ইত্যাদি একাধিক কারণকেও দায়ী করা যেতে পারে। আর্য আক্রমণে মহেঞ্জোদড়ো ধ্বংসপ্রাপ্ত হলেও সিন্ধুর অন্যান্য শহরগুলিতে এরূপ রক্তক্ষয়ী ঘটনার তেমন কোন প্রমাণ নেই। তাছাড়া বহিরাগত কোন জাতি যদি আক্রমণ করেই থাকে, তারা আর্যই ছিল একথাও নিশ্চিতভাবে বলা যায় না। সর্বোপরি বহিরাগত কোন জাতির পক্ষে সিন্ধু উপত্যকার বিশাল স্থান জুড়ে গড়ে ওঠা বিস্তৃত সভ্যতাকে সম্পূর্ণ ধ্বংস করে দেওয়া যুক্তিগতভাবে সম্ভব ছিল কিনা- সে প্রশ্নও থেকে যায়। তাই সিন্ধু-সভ্যতার অবলুপ্তির কারণ হিসেবে আক্রমণের তত্ত্বকে নিশ্চিত সত্য বলে মেনে নেওয়া যায় না।
এ. ই. কানিংহাম তাঁর ‘আর্কিওলজি অফ আর্লি হিস্টোরিক সাউথ এশিয়া’ শীর্ষক গ্রন্থে এই বিষয়টিকে প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনের নিরিখে ব্যাখ্যা করতে চেয়েছেন। খ্রিস্টপূর্ব ২০০০ থেকে ১৭০০ অব্দ পর্যন্ত হরপ্পা সভ্যতা ‘পরবর্তী নাগরিক সভ্যতার’ পর্যায়ে ছিল। এই পর্যায়ে অতীতের ঐতিহ্য ও গৌরব ম্লান হয়েছিল। শিল্পায়ন ও বর্ণমালা সম্পূর্ণ অনুপস্থিত। একই সময়ে পশ্চিম এশিয়ার জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সেখানকার জনগণের উন্নততর দক্ষিণমুখী সম্প্রসারণের প্রবণতা বেড়েছিল। চানহুদারো, ঝুকার, আমরি প্রভৃতি এলাকায় প্রত্নতাত্ত্বিক উৎখননের ফলে বহিরাগতদের আগমণের তত্ত্ব জোরালো হয়েছে। চানহুদারোতে এই পর্যায়ে যে সব মৃৎপাত্র পাওয়া যায়, তা হরপ্পীয়দের আমলের মৃৎপাত্রের থেকে স্বতন্ত্র। এই পর্যায়ে চানহৃদারোতে কোন হরপ্পীয় সীলমোহরের অস্তিত্ব পাওয়া যায় নি। অন্যদিকে পাথর বা ধাতু নির্মিত যে সকল সীলমোহর পাওয়া গেছে, সেগুলি পশ্চিম থেকে আগত বিদেশীদের উপস্থিতি প্রমাণ করে। কারণ অনুরূপ সীলমোহর পূর্ব ইরান, আফগানিস্তান ও মধ্য এশিয়াতে পাওয়া গেছে। সাম্প্রতিক মেহেরগড়ে খননকার্যের ফলে কোয়েটা ও নিকটবর্তী পিয়ক অঞ্চলে হরপ্পা-সংস্কৃতির থেকে স্বতন্ত্র এক ধারার উপস্থিতি লক্ষ্য করা গেছে। হরপ্পা অঞ্চলে পরবর্তীকালীন সমাধিক্ষেত্র (C-H) গুলিতে এক স্বতন্ত্র ধরনের মৃৎপাত্র পাওয়া যায়। হরপ্পার দূর্গ এলাকার এ. বি. ঢিবিতেও অনুরূপ মৃৎপাত্র পাওয়া গেছে। প্রত্নতত্ত্ববিদ ভাট এইসকল নবাগতদের ‘ইন্দো-আর্য’ বলে সনাক্ত করেছেন। আরো পূর্বদিকে কালিবনগানের ওপরের দিকের স্তরে একধরনের পাত্র পাওয়া গেছে, যা ইন্দো-আর্যরা অগ্নি উপাসনার সময় ব্যবহার করতেন। এ থেকে হরপ্পা সভ্যতার একেবারে শেষ পর্যায়ে ঐ এলাকায় আর্যদের আগমন ঘটেছিল, এমন সম্ভাবনা অগ্রাহ্য করা যায় না।
Leave a comment