সূচনা: প্রাপ্ত প্রত্নতাত্ত্বিক সামগ্রীর উপর ভিত্তি করে পণ্ডিতগণ হরপ্পা সভ্যতার অধিবাসীদের ধর্মীয় জীবন সম্পর্কে কিছুটা আভাস পেয়েছেন। তারা টোটেম পূজা অর্থাৎ প্রকৃতি, বিভিন্ন প্রাণী ও জড়পদার্থকে দেবতা জ্ঞানে পূজা করত। তবে হরপ্লাবাসীদের ধর্মবিশ্বাসে মন্দির বা দেবালয়ের কোনো স্থান ছিল না বলেই মনে করা হয়।

[1] ধর্মীয় বিশ্বাস: হরপ্লাবাসী বহুত্ববাদ অর্থাৎ বহু দেবতায় নাকি একেশ্বরবাদ বা এক দেবতার পূজায় বিশ্বাসী ছিল তা নিয়ে মতভেদ রয়েছে। এই সভ্যতার প্রাপ্ত দেবদেবীর মূর্তিগুলি থেকে অনুমান করা হয় যে এসময়ে মাতৃমূর্তির পূজা করা হত। বিভিন্ন সিলে হাতি, বাঘ, মহিষ, ষাঁড়ের ছবি দেখে মনে করা হয় যে সেসময় পশুকেও পূজা করা হত। এ ছাড়াও হরপ্লাবাসীরা লিঙ্গ ও বৃক্ষ উপাসনায় বিশ্বাসী ছিল।

[2] টোটেম পূজা: হরপ্লাবাসীরা টোটেম অর্থাৎ বিভিন্ন প্রাণী, প্রকৃতি ও জড় বস্তুকে দেবতা জ্ঞানে পূজা করত।

  • লিঙ্গ ও যােনি মূর্তির উপাসনা: হরপ্পাবাসীরা লিঙ্গ ও যােনি মূর্তির উপাসনা করত। লিঙ্গ পূজার সঙ্গে পরবর্তীকালে দেবতা শিবের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তুলে ধরা হয়।

  • বৃক্ষ উপাসনা: হরপ্পাবাসীরা বৃক্ষ পূজাও করত। তারা মূলত অশ্বখ বৃক্ষের উপাসনা করত। হরপ্পায় প্রাপ্ত এক সিলমােহরে পা-তােলা ভঙ্গিতে দণ্ডায়মান নারীর উদর থেকে এক চারা গাছ বের হওয়ার দৃশ্য দেখা যায়। ঐতিহাসিকদের অনুমান একটি ছিল ভূ-মাতার মূর্তি।

  • পশুর উপাসনা: হরপ্লাবাসীরা বিভিন্ন পশুর পূজা করত। বিভিন্ন পশুর মধ্যে কুঁজবিশিষ্ট ষাঁড়ের পূজার প্রচলন ছিল সব থেকে বেশি। কালিবঙ্গানে প্রাপ্ত একটি সিলমােহরে ছাগলের প্রতিকৃতি দেখে মনে করা হয় আদি শিবের পূজাতে ছাগ বলি দেওয়া হত।

[3] যােগী মূর্তির উপাসনা: হরপ্পায় একটি সিলমােহরে পশুবেষ্টিত পদ্মাসনে উপবিষ্ট, তিন মুখ ও তিনটি শিং বিশিষ্ট একটি দেবমূর্তি পাওয়া গেছে। জন মার্শাল হিন্দু দেবতা পশুপতি শিবের সঙ্গে এই দেবতার অনেক মিল খুঁজে পেয়েছেন। তবে ব্যাসাম একে সরাসরি শিব না বলে আদি শিব বলেছেন।

[4] মাতৃমূর্তির পূজা: হরপ্পা সভ্যতার কেন্দ্রগুলি থেকে অসংখ্য নারীমূর্তি আবিষ্কৃত হওয়ায় ঐতিহাসিকদের অনুমান সেসময়ে, এখানে মাতৃদেবীর পূজা খুব জনপ্রিয় ছিল। কোনাে কোনাে মূর্তির গায়ে ধোঁয়ার স্পষ্ট চিহ্ন দেখে মনে হয়, দেবীকে প্রসন্ন করতে অধিবাসীরা ধূপ ও প্রদীপ জ্বালাত।

[5] ধর্মীয় প্রতীকসমূহ: হরপ্লাবাসীর ধর্মীয় বিশ্বাসের সঙ্গে পদ্ম, স্বস্তিকা, চক্র, স্তম্ভ ও ত্রিশূল প্রভৃতি প্রতীক বা চিহ্ন জড়িত ছিল। মহেনজোদারাে ও হরপ্পায় প্রাপ্ত বেশ কয়েকটি স্বস্তিকাচিহিত সিলে শিংবিশিষ্ট মাথার ছবি মিলেছে। এ ছাড়াও বেলুচিস্তানে কেজ উপত্যকায় স্বস্তিকাচিহ্ন বা চক্রচিহ্নবিশিষ্ট কিছু মাটির পাত্র মিলেছে।

[6] পারলৌকিক বিশ্বাস

  • অতিপ্রাকৃত ধারণা: সিন্ধু উপত্যকার ধ্বংসাবশেষে মন্ত্রপূত কবচের মতাে দেখতে এক ধরনের বস্তু মিলেছে। এগুলি দেখে মনে করা হয় যে, সিল্ধুবাসী অতিপ্রাকৃত অর্থাৎ অলৌকিক শক্তিতে বিশ্বাস করত। বজ্রপাত, ঝড়, বন্যা প্রভৃতি ঘটনাকে তারা অতিপ্রাকৃত শক্তির রােষের কারণ বলে মনে করত।

  • অন্ত্যেষ্টি ক্রিয়া: হরপ্লাবাসী বিশ্বাস করত মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে মানুষের সমস্ত কিছু শেষ হয়ে যায় না। এসময় তিন ধরনের পদ্ধতিতে মৃতদেহ সমাধির নমুনা মিলেছে-

    • তৃতীয় পদ্ধতি: মৃতদেহ ভস্মীভূত করে সেই ভস্ম একটি আধারে ভরে, আধারটিকে সমাধিস্থ করা হত। মৃতদেহকে সাধারণত সমাধিস্থানের উত্তর থেকে দক্ষিণে শায়িত করার নিয়ম ছিল।