হরপ্পা সভ্যতায় যে অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক উভয় ধরনের বাণিজ্য চলত তার অনেক প্রমাণ পাওয়া গেছে। জন মার্শাল, মর্টিমার হুইলার, ব্রিজেট অলচিন, রেমন্ড অচিন প্রমুখ হরপ্পা সভ্যতার বাণিজ্যের বিভিন্ন প্রমাণ তুলে ধরেছেন।

[1] প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদান: সিন্ধু সভ্যতার যুগে নগরের চারিদিকের গ্রামগুলিতে উৎপাদিত উদ্বৃত্ত কৃষিপণ্য ও কাঁচামাল নগরগুলিতে আসত। এই পণ্য সিন্ধু সভ্যতার বিভিন্ন কেন্দ্রে ও দেশে-বিদেশে পৌঁছে যেত। সম্ভবত স্থলপথে পশু-টানা গাড়িতে এবং জলপথে নৌকা ও জাহাজের মাধ্যমে মালপত্র এক স্থান থেকে অন্য স্থানে পাঠানাে হত।

[2] লােথাল বন্দরের অস্তিত্ব: গুজরাটের লােথালে একটি বন্দরের ধ্বংসাবশেষ, পাথরের বস্তু নােঙর ও বহু সিলমােহর এবং মহেনজোদারােতে পােড়ামাটির একটি জাহাজের মডেলও পাওয়া গেছে। এসব তথ্যপ্রমাণ থেকে সিন্ধু উপত্যকার সঙ্গে মেসােপটেমিয়ার নিয়মিত সামুদ্রিক বাণিজ্যের অনুমান করা যায়।

[3] সীলমােহর: হরপ্পার বণিকরা বাণিজ্যিক কাজে সীলমােহর ব্যবহার করত। সীলমােহরগুলিতে ব্যবসায়ীর নাম ও ঠিকানার উল্লেখ থাকত বলে অনেক ইতিহাসবিদ মনে করেন। সুমের, মেসােপটেমিয়া ও অন্যান্য স্থানে হরপ্লার সীলমােহর আবিষ্কৃত হয়েছে।

[4] আক্কাদের সঙ্গে বাণিজ্যের প্রমাণ: পশ্চিম এশিয়ায় প্রাপ্ত শিলালিপি থেকে জানা যায় যে, আক্কাদের রাজা সারাগনের আমলে তিলমুন বা দিলমুন, মগন ও মেলুহার সঙ্গে আক্কাদের বাণিজ্য চলত। অনেকে মেলুহাকে নিম্নসিন্ধু অঞ্চল বলে চিহ্নিত করেছেন।

[5] মেসােপটেমিয়ার সঙ্গে বাণিজ্য: সি. জে. গ্যাড মেসােপটেমিয়ার উর নামক স্থানে হরপ্লায় তৈরি সিলের সন্ধান পেয়েছেন। আবার লােথাল, মহেনজোদারাে প্রভৃতি স্থানে মেসােপটেমীয় ধরনের কিছু সিল পাওয়া গেছে। এ থেকে মেসােপটেমিয়া ও নিকটবর্তী সুমেরের সঙ্গে সিন্ধুর বাণিজ্যিক সম্পর্ক ছিল বলে মনে করা হয়।

[6] সুমেরের সঙ্গে বাণিজ্য: সুমেরিয়ার লাগাস, সুসা প্রভৃতি অঞ্চলে হরপ্পা সভ্যতার সীলমােহর আবিষ্কৃত হয়েছে। সম্ভবত বাহরিন (তিলমন) ও ওমান (মাকান)-এর সমুদ্রপথে সুমেরের সঙ্গে হরপ্পার বাণিজ্য চলত।

[7] অন্যান্য স্থানের সঙ্গে বাণিজ্য: উপরিউল্লিখিত স্থানগুলি ছাড়াও মিশর ও ক্রীটের সঙ্গে হরপ্পা সভ্যতার বাণিজ্যিক সম্পর্ক ছিল বলে অনুমান করা হয়।

ভারতে এবং ভারতের বাইরে বিভিন্ন স্থানের সঙ্গে হরপ্পা সভ্যতার অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক বাণিজ্য চলত।

[1] আমদানি: [i] হরপ্পা সভ্যতায় কর্ণাটক থেকে সােনা, রাজস্থান ও বেলুচিস্তান থেকে তামা, পূর্ব ও দক্ষিণ ভারত থেকে সিসা এবং রাজস্থান ও গুজরাট থেকে দামি পাথর আমদানি করা হত। [ii] আফগানিস্তান থেকে রুপাে ও ল্যাপিস লাজুলি, আরব থেকে তামা, ইরান থেকে রূপা ও নীলকান্তমণি, মধ্য এশিয়া থেকে জেড পাথর প্রভৃতি আসত।

[2] রপ্তানি: সােনা, রুপাে, তামা, হাতির দাঁত, কাঠ, ল্যাপিস লাজুলি, দামি পাথর, পশুপাখির মূর্তি প্রভৃতি নিম্ন সিন্ধু অঞ্চল থেকে সুমের ও মেসােপটেমিয়ায় রপ্তানি হত।

উপসংহার: হরপ্পার নগর সভ্যতার পতনের পরবর্তীকালে ভারতে গ্রামীণ বৈদিক সভ্যতা গড়ে ওঠে। পশুপালক ও কৃষিজীবী বৈদিক সমাজে বাণিজ্যকে বহুলাংশে অবহেলা করা হয়। ফলে সিন্ধু সভ্যতার যুগের সমৃদ্ধ বাণিজ্য বৈদিক যুগে অনেকটাই শ্রিয়মাণ হয়ে পড়ে।