‘অন্যদৃষ্টি’ বলতে বস্তুবাদী ও জীবননিষ্ঠ দৃষ্টিভঙ্গির কথা বলা হয়েছে।

বহু শতাব্দী ধরে ভারতীয় চিন্তা সাধারণ মানুষকে জীবনের অকিঙ্খিৎকারিতা সম্পর্কে বুঝিয়ে চলেছে। ভারতীয় দর্শনে ব্যক্তিমুক্তির আদর্শ, ব্যক্তির মোক্ষলাভের আদর্শকে প্রধান করে দেখানো হয়েছে। ব্যক্তিবিশেষের আত্মজ্ঞান লাভের সাধনাই জীবনের মূল ইষ্ট। বৌদ্ধমতে এ-পৃথিবী ‘ভবচক্র’। তাই এই ‘ভবচক্র’ থেকে মুক্তির জন্য জীবনকে নিষ্ঠার সঙ্গে সাধনা করতে হয়। পৃথিবী নশ্বর, মানবজীবনও নশ্বর, এ পৃথিবী দুদিনের পান্থশালা। তাই মানুষের উচিত এই ক্ষণমোহ থেকে মুক্তি নিয়ে পারলৌকিক ইষ্টকে লাভ করা। ইহকাল অপেক্ষা পরকালের বিষয়ের জন্য মানুষ যদি অতন্দ্র মনন, বিজ্ঞান ও নিদিধ্যাসন করে তবে মানুষের আত্মজ্ঞান সার্থক হবে, ব্যক্তির মুক্তি সম্পন্ন হবে। জীবন দুঃখময়, জীবনের দুঃখ-দুর্ভোগ থেকে মুক্তির জন্য, পরমাত্মার সঙ্গে একাত্মতার জন্য জীবাত্মাকে ইহ-মোহ ত্যাগ করতে হয়। এই প্রকারে পার্থিব ব্যাপারে অনাগ্রহ জাগে। তার ফলে জাগতিক ব্যাপারে এদেশের মানুষ আধিপত্য হারিয়ে পরাস্ত ও পর্যুদস্ত হয়ে গেল। বর্বরদের হাতে পরাজিত হয়ে গেল এদেশের অধিবাসীরা।

ব্যক্তিগত সুখ-দুঃখকেই দর্শনের প্রধান বিষয় করা ঠিক নয়। ব্যক্তিসুখ অপেক্ষা সমষ্টিগত সুখ ও প্রগতি মানুষের পক্ষে বেশি মূল্যবান। জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন, দারিদ্র্য, রোগ ও মৃত্যুর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা যায় তবেই দেশের কল্যাণ, ব্যক্তির মঙ্গল। এই সমষ্টিবাদী দৃষ্টিভঙ্গির ফলে মানুষের সামাজিক চিন্তার প্রসার ঘটে। দেশের প্রগতি নির্ণীত হয়। জাতীয় পতাকার মহিমা বৃদ্ধি করা হয়। এই দিক থেকে যে ‘অন্যদৃষ্টিভঙ্গী’-র কথা বলা হয়েছে, তার সার্থকতাই এখানে বিবেচিত হয়েছে। বস্তুবাদী দর্শনের দৃষ্টিভঙ্গিতে এই রহস্যবাদী দর্শন আসলে জড়তার নামান্তর, স্বার্থপরতাও লোভের প্রকৃষ্ট ক্ষেত্র। লেখকের ভাষায় “বস্তুবাদী দার্শনিক এও বলতে পারেন যে এই পারলৌকিকতা আসলে জড়ত্ব, স্বার্থপরতা ও লোভের প্রকৃষ্ট জন্মভূমি।” ‘স্বার্থপরতা’ বলতে বোঝায় মানুষের নিজের পুণ্য, নিজের মুক্তিচিন্তা নিয়ে মগ্ন থেকে সমাজের অন্য মানুষদের দাবি অগ্রাহ্য করা। এই স্বার্থপরতা ও মুক্তির লোভই মানুষকে নিয়ে যায় লোকালয় ছেড়ে গুহাকন্দরে। গুহাকন্দরে তপস্যা করতে গিয়ে মানুষ সমাজ-সংসার সবই ভুলে যায়। এই সব মুক্তিকামী ব্যক্তিস্বার্থবাদী মানুষ যখন অন্ধ কন্দরে ঈশ্বরচিন্তায় মত্ত থেকে দেশের ও দশের স্বার্থকে অবহেলা করে, তখন মনে হয় সমাজের অবশিষ্ট মানুষদের এরা শয়তানের করাল গ্রাসে ছেড়ে দিয়ে চলে গেল। একেই বোধহয় লেখক ‘স্বার্থপরতা’ বলে চিহ্নিত করেছেন। সংসারে অশুভ অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াই করে যাঁরা বেঁচে থাকে, তারাই সংগ্রামী মানুষ। তাদের কাছে জীবনের গুরুত্ব আছে, বাস্তবের মূল্যায়ন আছে। এইসব মানুষ হয়তো ভারতীয় ভাবাদর্শের ফলে জীবনের গুরুত্ব লঘু করে দেখতে সচেষ্ট হননি, তবু তাঁদের প্রচেষ্টাতে দেশের প্রগতি, দেশের সুরক্ষা, জাতীয় পতাকার সংহতি সবই মর্যাদাপূর্ণ অবস্থানে অবস্থিত থাকে। ভারতীয় ভাববাদের প্রভাবে মানুষ জড় ও গতিহীন হয়ে যায়। আধুনিক বিশ্ব ইতিহাসের পটভূমিতে এই মন্তব্য ক্রান্তিকারী। ভারতবর্ষ অদ্বৈতবেদান্ত বা বৌদ্ধবাদ জগৎ সংসারকে যেভাবে মিথ্যা বলে প্রতিপন্ন করেছে, তাকে লেখক যুক্তি ও বাস্তববাদী দৃষ্টিভঙ্গিতে সমালোচনা করেছেন। ব্যক্তিচিন্তায় মগ্ন থাকলে মানুষ গতিশীলতা হারায়। তার ফলে দেশের মানুষ আর জঙ্গম থাকে না। ফলে বিদেশি আক্রমণকারী এদেশের ওপর প্রভুত্ব কায়েম করে বসেছে। এই দুর্ভাগ্য সম্বন্ধেও লেখক পাঠককে সচেতন করে দিয়েছেন।