প্রশ্নঃ হযরত আলী (রা)-এর চরিত্র ও কৃতিত্ব বর্ণনা কর।

অথবা, হযরত আলী (রা)-এর কৃতিত্ব ও চারিত্রিক গুণাবলি ব্যাখ্যা কর।

ভূমিকাঃ হযরত আলী (রা) ছিলেন সরলতা ও আত্মত্যাগের মূর্ত প্রতীক। হযরত ওসমান (রা)-এর শাহাদাতের পর অত্যন্ত গােলযােগপূর্ণ পরিস্থিতিতে তিনি খেলাফতের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। চার বছর নয় মাস খেলাফতের দায়িত্ব নির্বাহের পর ৬৩ বছর বয়সে তিনি আবদুর রহমান ইবনে মুলযিম নামক এক খারেজী আততায়ীর হাতে শাহাদতবরণ করেন। তার চারিত্রিক গুণাবলিতে মুগ্ধ হয়ে ঐতিহাসিক মাসুদী বলেন, We shall search in vain to find, either among his predecessors (save one) or among his successors, those virtues with which God had endowed him.

হযরত আলী (রা)-এর চারিত্রিক গুণাবলিঃ নিম্নে হজরত হযরত আলী (রা)-এর চারিত্রিক গুণাবলি ধারাবাহিকভাবে তুলে ধরা হলো-

১. একনিষ্ঠ মুসলমানঃ হযরত আলী (রা) ছিলেন একনিষ্ঠ মুসলমান। শৈশবকাল থেকে জীবনের যে পর্যন্ত তিনি ইসলামের সেবায় জীবন উৎসর্গ করেন। তিনি ছিলেন শান্তশিষ্ট, গম্ভীর প্রকৃতির এবং পরােপকারী।

২. মােত্তাকীঃ হযরত আলী (রা)-এর চরিত্রের অন্যতম ভূষণ ছিল পৃথিবীর প্রতি অনাসক্তি। তার জীবনে দারিদ্র্য ও প্রাচুর্য উভয় অবস্থায়ই অতিবাহিত হয়েছিল, কিন্তু কখনাে তিনি প্রাচুর্যের লােভ লালসা করেননি।

৩. মহানবীর পদাঙ্ক অনুসারীঃ ঐতিহাসিক আমীর আলী বলেন, হযরত আলী (রা) ছিলেন রাসূল (স)-এর সবচেয়ে বেশি ঘনিষ্ঠ। শৈশব থেকে আরম্ভ করে আজীবন তিনি রাসূল (স)-এর মতাদর্শে জীবন পরিচালনা করেন। তিনি সর্বদা ছায়ার মতাে রাসূল (স)-এর অনুসরণ করেছেন।

৪. প্রাজ্ঞ জ্ঞানীঃ কুরআন, হাদীস, তাফসীর, ফিকহ, দর্শন ও আরবি সাহিত্যের ওপর হযরত আলী (রা) যথেষ্ট ব্যুৎপত্তির অধিকারী ছিলেন। তার পাণ্ডিত্যে মুগ্ধ হয়ে মহানবী (স) বলেছিলেন, “আমি জ্ঞানের শহর, আর আলি তার দরজা”।

৫. শ্রেষ্ঠ আমানতদারঃ ঐতিহাসিক মাসুদী বলেন, হযরত আলী (রা) জীবনে কখনাে আমানতের খেয়ানত করেননি। তার এ আমানতদারির কথা ইতিহাসের পাতায় চিরস্মরণীয় হয়ে আছে।

৬. অসাধারণ পাণ্ডিত্যের অধিকারীঃ হযরত আলী (রা) ছিলেন অসাধারণ পাণ্ডিত্যের অধিকারী। তার বিভিন্ন বক্তৃতা, সাহিত্যিক ব্যঞ্জনা ও অলংকার পূর্ণ বাণী আরবি সাহিত্যভাণ্ডারের মহামূল্য সম্পদ। তার লিখিত ‘দীওয়ানে আলী’ আজও আরবি সাহিত্যের এক অমূল্য সম্পদ।

৭. কঠোরতার অভাবঃ হযরত আলী (রা) ছিলেন অতিমাত্রায় দয়ালু ও সহিষ্ণু। তার অসাধারণত গুণাবলি থাকা সত্ত্বেও সহজাত দয়ার্দ্রতা ও সহিষ্ণুতার কারণে তিনি সময়ােপযােগী কঠোর সিদ্ধান্ত নিতে পারেননি। তাই আপাতদৃষ্টিতে তিনি খেলাফত পরিচালনায় ব্যর্থ বলে মনে হলেও মূলত তিনি সফল।

৮. আল্লাহর রাস্তায় ব্যয়ঃ হযরত আলী (রা)-এর শাসনামলে দরিদ্র ও অভাবগ্রস্ত লোকদের জন্য রাষ্ট্রীয় বায়তুল মালের দ্বার ছিল সর্বদা উন্মুক্ত। যতক্ষণ তার নিকট কিছু থাকত ততক্ষণ তিনি গরিবদের দান করতেন।

৯. ইবাদতঃ কঠোর সাধনা ও মহান আল্লাহর ইবাদতে হযরত আলী (রা) ছিলেন একনিষ্ঠ। তিনি দিনে রােযা রাখতেন এবং রাতে ইবাদতে দণ্ডায়মান থাকতেন। তিনি কুরআনের মর্ম থেকে দৈনন্দিন জীবনের কর্মসূচি গ্রহণ করতেন।

১০. মহাসাধকঃ বিশ্বের মহাসাধকদের মধ্যে হযরত আলী (রা) ছিলেন অন্যতম। কঠোর পরিশ্রম করে তিনি রাজ্যে শান্তি শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনেন। আত্মিক সাধনা ছিল তার নিয়মিত কাজ।

১১. দরিদ্রের বন্ধুঃ হযরত আলী (রা) ছিলেন প্রজারঞ্জক ও দরিদ্রের অকৃত্রিম বন্ধু। তিনি দরিদ্র জীবন ভালােবেসে দরিদ্রকে বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করেন। তিনি মনে করতেন, প্রত্যেক মানুষ একই আদমের সন্তান।

১২. শান্তিপ্রিয় শাসকঃ হযরত আলী (রা) ছিলেন একজন শান্তিপ্রিয় শাসক। তাই তিনি অশান্তি সৃষ্টিকারী যে কোনাে কাজ মনে প্রাণে ঘৃণা করতেন। অকারণে রক্তপাত তিনি আদৌ পছন্দ করতেন না। তার আমলে সংঘটিত উষ্ট্রের যুদ্ধ ও সিফফিনের যুদ্ধ এড়াবার জন্য তিনি আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন।

১৩. অনাড়ম্বর জীবনযাপনঃ হযরত আলী (রা)-এর চারিত্রিক সরলতা, সততা, ন্যায়নিষ্ঠা, আত্মত্যাগ ও সাহসিকতার অধিকারী চিরভাস্কর। তার জীবনযাপন ছিল খুবই অনাড়ম্বরপূর্ণ। তিনি জাঁকজমক পছন্দ করতেন না। ধন-সম্পদ বলতে তার কিছুই ছিল না। তিনি খলিফা হয়েও পরিশ্রম করতেন।

আলী (রা)-এর কৃতিত্বঃ নিম্নে হজরত হযরত আলী (রা)-এর কৃতিত্ব ধারাবাহিকভাবে তুলে ধরা হলো-

১. প্রশাসনিক কৃতিত্বঃ হযরত ওসমান (রা)-এর যুগে অসাধু আমলাদের কারণে প্রশাসনে যেসব দুনীতি ঢুকে পড়েছিল সেগুলাে দূর করে তিনি ওমর (রা)-এর যুগের আইন শৃঙ্খলা বহাল রেখে প্রশাসনিক সংস্কার করেন।

২. আরবি ব্যাকরণশাস্ত্রের প্রবর্তকঃ ঐতিহাসিকগণ সকলে এ ব্যাপারে ঐকমত্য পােষণ করেন, হযরত আলী (রা) আরবি ব্যাকরণশাস্ত্রের প্রবর্তক। তিনি আবুল আসওয়াদ আদ দুওয়ালী নামক জনৈক ব্যক্তিকে এ কাজে নিয়ােগ করেন।

৩. বীর যােদ্ধাঃ হযরত আলী (রা) ছিলেন অভিজ্ঞতাসম্পন্ন সুদক্ষ সমরনায়ক। কাফের মুশরিকদের বিরুদ্ধে পরিচালিত প্রায় প্রতিটি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে তিনি অসামান্য রণকৌশলের পরিচয় দেন। খায়বার যুদ্ধে অসাধারণ কৃতিত্বের জন্য মহানবী (স) তাকে আসাদুল্লাহ উপাধিতে ভূষিত করেন।

৪. ন্যায়বিচারকঃ সূক্ষ্ম ন্যায়বিচারে হযরত আলী (রা) ছিলেন অদ্বিতীয়। পূর্ববর্তী খলিফাত্ৰয় তার পরামর্শ ব্যতিরেকে কোনাে বিচারের রায় দিতেন না। হযরত ওমর (রা) বলেন, “হযরত আলী (রা) না থাকলে ওমর নিশ্চয়ই ধ্বংসে পতিত হতাে।”

৫. বায়তুল মালের সংরক্ষণঃ বায়তুল মালের সংরক্ষণে তিনি সর্তক ছিলেন। নিজের এবং নিজ পরিবার বর্গ ও নিকটাত্মীয়দের কাজে সরকারি কোষাগারের সাধারণ কোনাে জিনিসিও তিনি ব্যয় হতে দিতেন না। মহানবী (স)-এর ভৃত্য আবু রাফেকে তিনি বায়তুল মালের তত্ত্বাবধায়ক নিযুক্ত করেছিলেন।

৬. অর্থ বিভাগঃ হযরত আলী (রা) অর্থ বিভাগে এমন কিছু সংস্কার সাধন করেন যার ফলে আমদানি বৃদ্ধি পেয়েছিল। আগে দেশের বন এলাকা থেকে কোনাে অর্থ আসত না। কিন্তু তিনি সেগুলােকে আমদানিযােগ্য করে তােলেন। আবার কিছু কিছু ক্ষেত্রে করও রহিত করেন। ফলে কৃষকগণ তার রাজত্বে শান্তিতে বসবাস করার সুযোেগ লাভ করেন।

৭. বাজার দর পরিদর্শনঃ পণ্যসামগ্রীর বাজার দর তিনি মাঝে মাঝে পরীক্ষা করে দেখতেন। যেন তা সাধারণ মানুষের ক্রয় ক্ষমতার বাইরে চলে না যায়। বিক্রেতাদেরকে সঠিক মাপ ও তার সাথে ভালাে ব্যবহার করার পরামর্শ দিতেন।

৮. গভর্নরদের খবরদারীঃ হযরত ওমর (রা)-এর শাসনামলের ন্যায় তিনি প্রাদেশিক শাসনকর্তাদের চারিত্রিক অবস্থার প্রতি কড়া নজর রাখতেন। আঞ্চলিক শাসকদের কার্যাবলি তদারকী করতেন। তাদের সূক্ষ্মভাবে সমালােচনা ও খবরদারী করতেন। ভ্রান্ত নীতিসমূহ সংশােধন করতেন।

উপসংহারঃ হযরত আলী (রা) খলিফা হিসেবে ব্যর্থ-এ কথা বলার কোনাে যৌক্তিক কারণ নেই। আর মানুষ হিসেবে তিনি পূর্ণ সফল- এ ব্যাপারেও কারাে দ্বিমত নেই। তাই ঐতিহাসিক হিট্টি বলেন- Voliant in bottle, wise in counsel, eloquent in speech, true to his friends, magnanimous fo his foes, he became the paragon of Muslim nobility and chivalry.