প্রশ্নঃ হযরত আবু বকর (রা)-এর খেলাফত লাভ ও তার চারিত্রিক গুণাবলি আলােচনা কর।

অথবা, হযরত আবু বকর (রা)-এর চরিত্র আলােচনা কর।

উপস্থাপনাঃ মহানবী (স) স্বীয় ইন্তেকালের পূর্বে সুস্পষ্টভাবে কাউকে মুসলিম জাহানের পরবর্তী নেতা নির্বাচন করে যাননি। ফলে তার ওফাতের মুসলিম জাহানের নেতা নির্বাচন নিয়ে সংকট দেখা দেয়। এ সংকটময় মুহূর্তে হযরত আবু বকর (রা) মুসলিম জাহানের নেতা নির্বাচিত হন। নির্বাচিত হয়ে তিনি প্রায় আড়াই বছরকাল নিষ্ঠার সাথে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ছিলেন অত্যন্ত আকর্ষণীয় চরিত্রের অধিকারী। অতুলনীয় চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের দিক থেকে ইসলামের ইতিহাসে মহানবী (স)-এর পরেই তার স্থান।

আবু বকর (রা)-এর খেলাফত লাভঃ

মহানবী (স) ওফাতের পূর্বে কার্যত কাউকে খলিফা হিসেবে মনােনয়ন দিয়ে যাননি। ফলে সাহাবীগণ তাদের পরবর্তী নেতা নির্বাচনে ত্বরিত পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। এ সময় কুরাইশরা, আনসার ও মুহাজিরগণ প্রত্যেকেই স্বীয় সম্প্রদায়ের মধ্য থেকে খলিফা দাবি করেন।

তৎক্ষণাৎ এ সংকট নিরসনে হযরত সাদ ও ওমর (রা) খলিফা পদে হযরত আবু বকর (রা)-এর নাম প্রস্তাব করেন। হযরত ওবায়দা (রা) এ প্রস্তাব সমর্থন করেন। এরপর সকলেই ইসলামের প্রথম খলিফা হিসেবে হযরত আবু বকর (রা)-এর প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেন।

আবু বকর (রা)-এর চারিত্রিক গুণাবলিঃ

১. মহানবী (স)-এর পূর্ণাঙ্গ অনুসারীঃ হযরত আবু বকর (রা) পুরুষদের মধ্যে সর্বপ্রথম মহানবী (স)-কে নবী বলে বিশ্বাস স্থাপন করেন এবং তাকে ছায়ার মতাে অনুসরণ করতেন। রাসূল-এর প্রতিটি নির্দেশকে তিনি নিজের মতামতের ওপর প্রাধান্য দিতেন। রাসূলের জন্য তিনি নিজের জীবনেরও কোনাে পরােয়া করেননি।

২. বিশ্বনবীর পরেই তার স্থানঃ তিনি ছিলেন মহানবী (স)-এর চারিত্রিক গুণাবলির বাস্তব প্রতিচ্ছবি। রাসূল (স)-এর সকল গুণে তিনি গুণান্বিত ছিলেন। মহানবী (স)-এর পরেই তার স্থান। উম্মতের মধ্যে সর্বাপেক্ষা মর্যাদাবান ব্যক্তি ছিলেন তিনি।

৩. ইসলামের একনিষ্ঠ সেবকঃ ইসলামের সেবায় হযরত আবু বকর (রা) সর্বস্ব বিলিয়ে দেন। তার প্রচেষ্টায় কুরাইশদের মধ্য থেকে শীর্ষস্থানীয়সহ বহু লােক ইসলাম গ্রহণ করেন। তিনি বিভিন্ন সময় নানা প্রয়ােজনে বিশেষ করে ঋণমুক্তকরণ, মদিনার মসজিদ নির্মাণ ও তাবুকসহ প্রভৃতি যুদ্ধে অকৃপণহস্থে প্রচুর অর্থ দান করেন। হযরত ওমর (রা) বলেন, আবু বকর (রা)-কে ইসলামের খেদমতের ব্যাপারে কেউ অতিক্রম করতে পারবে না।

৪. দুঃসাহসী অভিযাত্রীঃ দ্বীন প্রচার এবং দ্বীনের পতাকা উড্ডীন করার সংগ্রামে হযরত আবু বকর (রা)-এর নৈতিক বল ও অসীম সাহসিকতা ছিল তুলনাহীন। ইসলামী আন্দোলনের বিপদসংকুল পথে তিনি ছিলেন দুঃসাহসীক অভিযাত্রী।

৫. বিশ্বস্ততাঃ ইসলামী আন্দোলন সংক্রান্ত সকল বিষয়ে মহানবী (স) হযরত আবু বকর (রা)-এর সাথে পরামর্শ করতেন। গােপনে সবকিছু তাকে বলতেন। তিনি বিশ্বস্ততার সাথে সবকিছু সম্পাদন করতেন।

৬. আল্লাহ ও রাসূলের ওপর প্রগাঢ় বিশ্বাসঃ ঐতিহাসিক আবুল ফজল বলেন, আল্লাহ ও রাসূলের ওপর তার প্রগাঢ় বিশ্বাস ছিল। শত বিপদেও তিনি এ বিশ্বাস থেকে এক চুল নড়েননি।

৭. মানুষের বন্ধুঃ হযরত আবু বকর (রা) ছিলেন সর্বস্তরের মানুষের বন্ধু। তার অন্তর ছিল অত্যন্ত কোমল প্রকৃতির। গরিবদের তিনি অকাতরে দান করতেন। তিনি অনেক দাস-দাসীকে তাদের মুশরিক মনিবের নির্যাতন থেকে বিপুল অর্থের বিনিময়ে মুক্ত করেন।

৮. আড়ম্বরহীন জীবনঃ খলিফা হওয়ার পরও হযরত আবু বকর (রা) পূর্বের ন্যায় সাদাসিধা পােশাক পরিধান করতেন, উটের চামড়ায় নির্মিত তাবুর গৃহে বসবাস করতেন। ঐতিহাসিক আমীর আলী বলেন- Like his maste. Abu Bakar was extremely simple in his habits gentle but firm. He devoted all his energies to the administration of the new, born state and to the good of people.

অথাৎ, তিনি তার শিক্ষাদাতা মহাপুরুষের ন্যায় আচার ব্যবহারে অত্যন্ত আড়ম্বরহীন ছিলেন। তিনি বিনীত অথচ দৃঢ় ছিলেন এবং নতুন রাষ্ট্রের শাসনকার্যে এবং জন সাধারণের উপকারার্থে সর্বশক্তি নিয়ােজিত করেছিলেন।

৯. দীন-দুঃখীর অভাব মােচনঃ হযরত আবু বকর (রা) দীন-দুঃখীর দুর্দশা দূর করার জন্য সর্বপ্রথম বায়তুল মাল প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি রাতের অন্ধকারে গােপনে খাদ্যসামগ্রী বহন করে নিয়ে গিয়ে গরিব ও অনাথদের দুরবস্থা ও অভাব মােচন করতেন।

১০. দৃঢ়তা ও ধৈর্যঃ আল্লামা শিবলী নােমানী বলেন, দৃঢ়তা ও ধৈর্য ছিল হযরত আবু বকর (রা)-এর চারিত্রিক গুণাবলির অন্যতম প্রধান দিক। মহানবী (স)-এর ওফাতের সংবাদে তিনি যে অপরিসীম ধৈর্য ও দৃঢ়তার পরিচয় দান করেন, ইতিহাসে তার তুলনা বিরল।

১১. শেষ সম্পদ বাইতুল মালে জমাঃ বায়তুল মাল থেকে যে সামান্য ভাতা তিনি গ্রহণ করতেন, মৃত্যুর সময় স্বীয় সম্পদ বিক্রয় করে সে পরিমাণ অর্থ বায়তুল মালে জমা দেয়ার জন্য তার উত্তরাধিকারীদের নির্দেশ প্রদান করেন।

১২. কঠোর কোমলের অপূর্ব সমন্বয়ঃ হযরত আবু বকর (রা)-এর চরিত্রে কঠোরতা ও কোমলতার অপূর্ব সমন্বয় ঘটেছিল। যেখানে কঠোরতা অবলম্বনের প্রয়ােজন হতাে সেখানে তিনি ঠিক প্রয়ােজনীয় মাত্রায় ইস্পাত কঠিন হয়ে দাঁড়াতেন।

১৩. তাকওয়ার মূর্ত প্রতীকঃ আবু বকর (রা) ছিলেন মহানবীর আদর্শ ও চরিত্রের পূর্ণাঙ্গ প্রকাশ এবং ইবাদত ও তাকওয়ার মূর্ত প্রতীক। তিনি একাগ্রচিত্তে নামায় রােযা আদায় করতেন। তাকে নামাযরত অবস্থায় দেখলে প্রাণহীন কাষ্ঠ দণ্ডের মতাে মনে হতাে। কুরআন পাঠের সময় দুই গণ্ড বেয়ে পানি পড়ত। তিনি অস্কুটস্বরে এমনভাবে ফুপিয়ে কাঁদতেন যে, আশেপাশে মানুষ জড়ে হয়ে যেত। এ কারণে তাকে আওয়াহুম মুনীব নামে আখ্যায়িত করা হয়।

১৪. সত্যবাদিতাঃ আল্লামা শিবলী নােমানী বলেন, সত্যবাদিতার জন্য তিনি মহানবী (স) কর্তৃক সিদ্দিক ও আতীক উপাধিতে ভূষিত হন। তার সম্পর্কে রাসূল (সা) ঘােষণা করেন, তুমি আল্লাহর পক্ষ থেকে আগুন হতে মুক্ত। তাই তিনি আতীক উপাধিতে ভূষিত ছিলেন।

১৫. ইসলামের ধারক ও বাহকঃ ইসলামের ধারক ও বাহক হিসেবে আবু বকর (রা) ধর্মীয় অনুশাসন অক্ষরে অক্ষরে পালন করতেন। কোনাে প্রকার ভীতি, বিদ্বেষভাব ও বিরুদ্ধাচরণ তাকে কর্তব্যচ্যুত করতে পারেনি। তিনি ইসলামের পূর্ণ অনুসারী বিধায় মহানবী (স)-এর অন্তিমকালে তাকে ইমামতি করার আদেশ দেন। তিনিই আরব ভূখণ্ড থেকে দুনীতি, প্রতারণা, ভণ্ডামি এবং অনৈসলামিক কার্যকলাপ ধ্বংস করে ইসলামের মর্যাদা বৃদ্ধি করেন।

১৬. অগাধ পাণ্ডিত্যের অধিকারীঃ আবু বকর (রা) ছিলেন মহানবী (স)-এর অন্তরঙ্গ বন্ধু ও সুখ-দুঃখের সাথী। তিনি ছিলেন অত্যন্ত বিচক্ষণ ও প্রজ্ঞাবান। এবং জ্ঞান-বিজ্ঞানে অতুলনীয়। বক্তৃতা-ভাষণে ছিলেন অপ্রতিদ্বন্দী। যে কোনাে সমস্যা অনুধাবনে ও সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে তিনি ছিলেন অনন্য। তিনি স্বপ্ন ব্যাখ্যায় আল্লাহ প্রদত্ত জ্ঞানের অধিকারী ছিলেন।

১৭. বিচক্ষণ সংগঠকঃ মহানবী (স)-এর ওফাতের পর সাহাবায়ে কেরামের মধ্যে যখন হতাশা বিরাজ করছিল।, স্বয়ং ওমর (রা) যেখানে ভেঙে পড়েছিলেন। সে সময় অত্যন্ত বিচক্ষণতার সাথে আবু বকর (রা) সকলকে সংগঠিত করেছিলেন।

১৮. রাজনৈতিক দূরদর্শিতাঃ রাজনৈতিক দূরদৃষ্টি এবং প্রজ্ঞা ছিল তার চরিত্রের অন্যতম প্রধান দিক। মৃত্যুর পূর্বে ওমর (রা)-কে খেলাফতের জন্য নির্বাচিত করে তিনি রাজনৈতিক দূরদর্শিতার পরিচয় দেন। তার দূরদর্শিতাপূর্ণ পদক্ষেপসমূহ জীর্ণ জাতির বুকে নবজীবনের স্পন্দন জাগায়।

১৯. মহানবীর উপযুক্ত প্রতিনিধিঃ মহানবী (স)-এর তিরােধানের পর আবু বকর (রা) তার উপযুক্ত প্রতিনিধি হিসেবে ইসলামী আরব বিশ্বে সৃষ্ট অন্তর্দ্বন্দ্ব, বিশৃঙ্খলা, বিদ্রোহ, অরাজকতার অবসান ঘটিয়ে যাবতীয় কাজ সুষ্ঠুভাবে সম্পাদন করতে সক্ষম হন। হযরত আলী (রা) বলেন, রাসূল (স)-এর পর আবু বকর শ্রেষ্ঠ মুসলমান ছিলেন।

উপসংহারঃ হযরত আবু বকর (রা)-এর চারিত্রিক গুণাবলি বিশ্লেষণ করলে প্রতীয়মান হয়, ইসলামের ইতিহাসে মহানবী (স)-এর পরেই তার স্থান। ইসলামী জীবনব্যবস্থা ও ইসলামী রাষ্ট্রের একনিষ্ঠ সেবা এবং বহুবিধ কৃতিত্বের জন্য তাকে Saviour of islam বলা হয়ে থাকে।