অথবা, হবস লক এবং রুশোর সামাজিক চুক্তির তুলনামূলক আলোচনা কর।
ভূমিকাঃ রাষ্ট্রের উৎপত্তি সম্পর্কে বেশ কিছু মতবাদ রয়েছে, তার মধ্যে সামাজিক চুক্তি মতবাদই উল্লেখযোগ্য। আর এ মতবাদের মূল প্রবক্তা তিনজন। তারা হলেন হবস, লক ও রুশো। তারা তিনজনই প্রকৃতির রাজ্য সম্পর্কিত ধারণা থেকে শুরু করে সার্বভৌমত্বের ধারণা পর্যন্ত এ সামাজিক চুক্তির ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ প্রদান করেছেন। যদিও এক্ষেত্রে সাদৃশ্য আছে। তবুও কিছু বৈসাদৃশ্য লক্ষণীয়।
সামাজিক চুক্তি মতবাদের ধারণাঃ সামাজিক চুক্তি মতবাদের মূল বক্তব্য হচ্ছে রাষ্ট্র নামক প্রতিষ্ঠানটি জনগণের মধ্যে সম্পাদিত চুক্তির মাধ্যমে উৎপত্তি লাভ করেছে। সামাজিক চুক্তিবাদীদের মতে, আদিম যুগে রাষ্ট্রের কোন অস্তিত্ব ছিল না। শাসক বা আইন-কানুন কিছুই ছিল না। মানুষ তখন প্রকৃতির রাজ্যে বসবাস করতো। তখন সমাজে প্রাকৃতিক আইন নামে এক ধরনের আইনের অস্তিত্ব ছিল। কিন্তু এমন এক সময় এলো যখন প্রকৃতির রাজ্যে মানুষের জীবন অতিষ্ঠ হয়ে উঠল ও মানুষ বিভিন্ন অসুবিধার সম্মুখীন হল। ফলে সেই অবস্থা হতে মুক্তিলাভের উদ্দেশ্যে চুক্তির মাধ্যমে রাষ্ট্র গঠন করতে উদ্যোগী হয়। এই চুক্তিকেই ‘সামাজিক চুক্তি মতবাদ’ বলে।
সামাজিক চুক্তি মতবাদের সমর্থনঃ সামাজিক চুক্তি মতবাদের প্রকৃত সমর্থক হলেন বৃটেনের টমাস হব্স, জন লক এবং ফরাসি দার্শনিক জ্যা জ্যাক রুশো। এ ব্যাপারে তিনজনই একমত যে, প্রকৃতির রাজ্যের অবস্থার হাত হতে মুক্তিলাভের উদ্দেশ্যে মানুষ চুক্তি করে রাষ্ট্র সৃষ্টি করেছে।
হবসের সামাজিক চুক্তি মতবাদঃ ইংরেজ দার্শনিক টমাস হবস তার বিখ্যাত গ্রন্থ ‘লেভিয়াথান’-এ সামাজিক চুক্তি মতবাদের বিশদ ব্যাখ্যা করেছেন। হবস বলেন, প্রকৃতির রাজ্যে মানুষের অবস্থা খুব খারাপ ছিল। একে অন্যের সাথে দ্বন্দ্বে লিপ্ত থাকত। হবসের মতে, প্রকৃতির রাজ্যে মানুষ ছিল স্বার্থপর, আত্মকেন্দ্রিক, কলহপ্রিয়, কেউ কাউকে বিশ্বাস করত না, সবল দুর্বলকে অত্যাচার করত। প্রকৃতির রাজ্যে কোন শাসক ছিল না। এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণ লাভের আশায় মানুষ নিজেদের মধ্যে চুক্তি করে একজন নিরপেক্ষ ব্যক্তিকে ক্ষমতা দিয়ে রাষ্ট্রের সৃষ্টি করল।
জান লকের সামাজিক চুক্তি মতবাদঃ ইংরেজ দার্শনিক লক ১৬৯০ সালে ‘Two Treatise on Civil Government’ নামক গ্রন্থে সামাজিক চুক্তি মতবাদটি ব্যাখ্যা করেন। লকের মতে, প্রকৃতির রাজ্যে সাম্য, স্বাধীনতা ও শান্তি বিরাজ করত। প্রাকৃতিক আইনের অধীনে মানুষ সুখে-শান্তিতে বসবাস করত। কিন্তু সেখানে কতগুলো সমস্যা দেখা দিয়েছিল। সমস্যাগুলো হল-
প্রথমতঃ প্রাকৃতিক আইনের কোন সুস্পষ্ট সংজ্ঞা ছিল না।
দ্বিতীয়তঃ এই আইনের ব্যাখ্যার কোন ব্যবস্থা ছিল না।
তৃতীয়তঃ এই আইন বলবৎ করার কোন কর্তৃত্বসম্পন্ন সংস্থা ছিল না।
এ সমস্যাগুলো দূর করার জন্য মানুষ স্বেচ্ছায় ও সর্বসম্মতিক্রমে চুক্তির মাধ্যমে রাজনৈতিক সমাজ গঠনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। লকের মতে দুটি চুক্তি হয়েছিল-একটি সামাজিক চুক্তি ও আরেকটি সরকারি চুক্তি।
রুশোর সামাজিক চুক্তি মতবাদঃ ফরাসি দার্শনিক রুশো ১৭৬২ সালে ‘The Social Contract’ গ্রন্থে সামাজিক চুক্তি মতবাদের পূর্ণ ব্যাখ্যা দান করেন। তার মতে, প্রকৃতির রাজ্যে মানুষ ছিল সহজ, সরল, উত্তম ও সহানুভূতিশীল। সেখানে কোন হিংসা, দ্বেষ ও প্রতিশোধ স্পৃহা ছিল না। প্রকৃতির রাজ্য ছিল এক আদর্শ রাজ্য। তিনি এ অবস্থাকে ‘পৃথিবীর স্বর্গ’ বলে অভিহিত করেন। কিন্তু ক্রমশ জনসংখ্যা বৃদ্ধি, সম্পত্তির ধারণায় প্রকৃতির রাজ্যে বিশৃঙ্খলা দেখা দিল। এ অবস্থার অবসানের জন্য মানুষ চুক্তি করে রাষ্ট্র সৃষ্টি করে। এ চুক্তির ফলে জনগণ তাদের সকল ক্ষমতা সামগ্রিকভাবে সমাজ তথা একটি সাধারণ ইচ্ছার উপর অর্পণ করে। রুশোর চুক্তিতে সাধারণ ইচ্ছা হল সার্বভৌম।
হবস, লক ও রুশোর চিন্তাধারার তুলনামূলক আলোচনাঃ সামাজিক চুক্তি মতবাদের প্রবক্তা তিনজনের মধ্যে কিছু কিছু সাদৃশ্য রয়েছে। পাশাপাশি বেশ কিছু বৈসাদৃশ্যও বিদ্যমান। নিম্নে তার তুলনামূলক আলোচনা পেশ করা হলো-
সাদৃশ্যঃ হবস্, লক্ ও রুশোর মতবাদের মধ্যে যে সব ক্ষেত্রে সাদৃশ্য পরিদৃষ্ট হয় তা হল-
(১) রাষ্ট্রচুক্তির ফলঃ হবস্, লক্ ও রুশো- তিনজনেরই মত হচ্ছে যে, রাষ্ট্র মানুষের পারস্পরিক চুক্তির ফলে সৃষ্টি হয়েছে। তারা তিনজনই মনে করেন মানুষ পারস্পরিক কলহ বিবাদ করতে করতে অতিষ্ঠ হয়ে এবং একে অপরের পারস্পরিক নির্ভরশীলতার খাতিরে চুক্তিতে উপনীত হয়, ফলে রাষ্ট্রের সৃষ্টি হয়।
(২) প্রকৃতির রাজ্যে অসুবিধাঃ তারা তিনজনই বিশ্বাস করতেন যে, ধীরে ধীরে প্রকৃতির রাজ্যে বিভিন্ন রকমের অসুবিধা দেখা দেয় ও মানুষের জীবন দুর্বিষহ হয়ে ওঠে।
(৩) প্রকৃতির রাজ্যে বিশ্বাসীঃ হবস্, লক্ ও রুশো তিনজন দার্শনিকই প্রকৃতির রাজ্যে বিশ্বাস করতেন। তাদের বিশ্বাস ছিল যে, রাষ্ট্রের উদ্ভবের পূর্বে মানুষ প্রকৃতির রাজ্যে বসবাস করত ও প্রাকৃতিক আইন মেনে চলত।
(৪) সামাজিক চুক্তিই সার্বভৌমের স্রষ্টাঃ তিনজন দার্শনিকই মনে করেন যে, সামাজিক চুক্তির ফলেই সার্বভৌম শক্তির সৃষ্টি হয়েছে।
(৫) সমসাময়িক অবস্থার প্রভাবঃ হবস্, লক ও রুশো তাদের স্ব-স্ব বক্তব্য প্রদানের সময় সমসাময়িক আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক অবস্থা দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন।
বৈসাদৃশ্যঃ সামাজিক চুক্তি মতবাদের ক্ষেত্রে হবস্, লক্ ও রুশোর মধ্যে যেসব বৈসাদৃশ্য পরিলক্ষিত হয় তা নিম্নরূপ-
(১) প্রাকৃতিক রাজ্যঃ প্রাকৃতিক রাজ্যের বর্ণনায় হবস বলেন, “প্রকৃতির রাজ্য ছিল অশান্তির স্থান। এখানে মানুষ ‘জোর যার মুল্লুক তার’ নীতিতে বিশ্বাসী ছিল। ফলে তথায় মানুষের জীবন ছিল দুর্বিষহ, দ্বন্দ্বময়।” লকের মতে, ‘প্রকৃতির রাজ্য ছিল স্বর্গের মত। এখানে মানুষ নিজ বুদ্ধি-বিবেক অনুযায়ী চলত ও শান্তিতে বসবাস করত।’ আবার রুশোর বর্ণনায় দেখা যায়, ‘প্রকৃতির রাজ্যে মানুষের মধ্যে বন্ধন, সহানুভূতি ও সম্প্রীতি বিদ্যমান ছিল।’
(২) চুক্তির প্রকৃতিঃ চুক্তির প্রকৃতি সম্পর্কে হবস্ বলেন, ‘রাষ্ট্র সৃষ্টির জন্য জনগণের মাঝে একটি মাত্র চুক্তি সম্পাদিত হয় ও সব সময়ের জন্য তা অপরিবর্তনীয় ছিল।’ লকের মতে, ‘প্রকৃতির রাজ্যে মানুষ দুটি চুক্তি সম্পাদন করে। প্রথম চুক্তির দ্বারা জনগণ একটি সমাজ বা রাষ্ট্র গঠন করে ও দ্বিতীয় চুক্তির দ্বারা সরকার গঠন করে।’ আবার রুশোর মতে, ‘প্রকৃতির রাজ্যে জনগণ একটি চুক্তির মাধ্যমে ক্ষমতা সম্পূর্ণরূপে সাধারণ ইচ্ছার উপর ন্যস্ত করে।
(৩) প্রকৃতির রাজ্যের জীবনযাত্রাঃ প্রকৃতির রাজ্যে জীবনযাত্রার পথে সৃষ্ট অসুবিধা সম্পর্কেও তারা ভিন্নমত পোষণ করেন। হবসের মতে, ‘প্রকৃতির রাজ্যে জীবনযাত্রা ছিল ভয়াবহ ও জঘন্য।’ লকের মতে, ‘সেখানে প্রাকৃতিক আইনের ব্যাখ্যা দানকারী ও আইন ভঙ্গকারীকে শাস্তি প্রদানের কর্তৃপক্ষের অভাব ছিল।’ আবার রুশোর মতে, ‘জনসংখ্যা বৃদ্ধিজনিত সমস্যার কারণে প্রকৃতির রাজ্যে জীবনযাত্রার পথে বাধা সৃষ্টি হয়েছিল।’
(৪) মানুষের প্রকৃতিঃ হবসের মতে, ‘প্রকৃতির রাজ্যে মানুষ ছিল চরম স্বার্থপর, কলহপ্রিয় এবং নীচ।’ লক মনে করতেন, ‘প্রকৃতির রাজ্যে মানুষ ছিল শান্তিপ্রিয় ও পরস্পরের প্রতি সহানুভূতিশীল।’ আবার রুশোর মতে, ‘প্রকৃতির রাজ্যে মানুষ ছিল মূলত সহজ-সরল ও সহানুভূতিশীল। তাদের মধ্যে হিংসা-বিদ্বেষ ছিল না।’
(৫) রাষ্ট্র ও সরকারের সম্পর্কঃ টমাস হবসের মতে, রাষ্ট্র ও সরকার এক এবং অভিন্ন। কিন্তু লক ও রুশো রাষ্ট্র ও সরকারের মধ্যে পার্থক্য নির্দেশ করেছেন।
পরিশেষঃ পরিশেষে বলা যায় যে, হবসের চুক্তিবাদ ছিল স্বৈরাচার শাসনের নামান্তর। লকের চুক্তিবাদ ছিল নিয়মতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার প্রথম পদক্ষেপ, যার জন্য লককে গণতন্ত্রের জনক বলা হয়। আর রুশো ছিলেন সার্বজনীন সার্বভৌমিকতার প্রচারক ও এ চুক্তিবাদের মাধ্যমেই তিনি জনগণের সার্বভৌমিকতার ভিত্তিপ্রস্তর রচনা করেছেন। অতএব, একথা বলতেই হবে যে, তাদের চিন্তায় সাদৃশ্য-বৈসাদৃশ্য থাকলেও লক্ষ্য ছিল বিভিন্ন।
Leave a comment