প্রশ্নঃ মানবপ্রকৃতি, প্রকৃতির রাজ্য ও সামাজিক চুক্তির ক্ষেত্রে হবস ও রুশোর দর্শনের তুলনামূলক আলোচনা কর।

অথবা, হবস ও রুশোর দর্শনের তুলনামূলক আলোচনা কর

ভূমিকাঃ যে দুজন রাষ্ট্রদার্শনিক আধুনিক রাষ্ট্রচিন্তার জগতকে সমৃদ্ধ করেছেন তারা হচ্ছেন টমাস হবস ও জাঁ জ্যাক রুশো। এই দু’জনকে বাদ দিয়ে আধুনিক রাষ্ট্রচিন্তার ইতিহাস কল্পনা করা যায় না। ইংরেজ দার্শনিক টমাস হবস তার বিখ্যাত Leviathan গ্রন্থে রাষ্ট্রের উৎপত্তি-প্রকৃতি আলোচনা করতে গিয়ে মানবপ্রকৃতি, প্রকৃতির রাজ্য ও সামাজিক চুক্তি সংক্রান্ত মতবাদ দেন। অন্যদিকে সুইজারল্যান্ডের দার্শনিক জাঁ জ্যাক রুশো তার বিখ্যাত “The Social Contract” গ্রন্থে রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব ও জনগণের সাধারণ ইচ্ছা তত্ত্ব আলোচনা করতে গিয়ে প্রকৃতি, প্রকৃতির রাজ্য ও সামাজিক চুক্তি সম্পর্কে মতবাদ দেন।

টমাস হব্স-এর রাষ্ট্রদর্শনঃ টমাস হবসের মানবপ্রকৃতি, প্রকৃতির রাজ্য এবং সামাজিক চুক্তি মতবাদ আলোচনা করা হলো-

মানবপ্রকৃতিঃ হবস তার ‘Leviathan’ গ্রন্থে সামাজিক চুক্তির আলোচনায় মানবপ্রকৃতি সম্পর্কে বলেন, মানুষ স্বভাবতই স্বার্থপর ও আত্মকেন্দ্রিক। মানুষকে তিনি জড়বস্তুর ন্যায় একটি আবেগহীন যন্ত্রবিশেষ বলে বর্ণনা করেছেন। হবসের মতে, মানুষ মূলত একটি জড় পদার্থ এবং অন্যান্য প্রাকৃতিক জড়বস্তুর ন্যায় সে কার্যকারণ সম্পর্কিত রীতির নিয়ন্ত্রণাধীন। তিনি বলেন, মানুষের যাবতীয় কর্মপ্রচেষ্টা ও যাবতীয় আবেগ-অনুভূতি আকর্ষণ ও বিকর্ষণজনিত আকাঙ্ক্ষা ও বিতৃষ্ণার দ্বারা পরিচালিত ও নিয়ন্ত্রিত। হবসের মতে, ক্ষমতালাভের আকাঙ্ক্ষা মানুষের সহজাত ও মজ্জাগত। তিনি বলেন, মানুষ যদিও আকাঙ্ক্ষার দ্বারা পরিচালিত হয় কিন্তু সে তার আকাঙ্ক্ষাকে শুধু বর্তমানের সুখান্বেষণে সীমাবদ্ধ রাখে না বরং ভবিষ্যতের জন্য কাজে লাগায়। হবসের মতে, মানুষ স্বাতন্ত্র্যবাদী। অপরের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত বা প্রভাবিত হওয়াকে মানুষ পছন্দ করে না।

হবসের মতে প্রকৃতির রাজ্যঃ হবসের মতে, রাষ্ট্র সৃষ্টির পূর্বে মানুষ প্রকৃতির রাজ্যে বসবাস করত। প্রকৃতির রাজ্য ছিল ভয়াবহ ও দূর্বিষহ। সেখানে মানুষে মানুষে সর্বদা বিবাদ লেগেই থাকত। কেননা প্রত্যেক মানুষ নিজ নিজ স্বার্থ উদ্ধারে ব্যস্ত থাকত। জোর যার মুল্লুক তার- এই ছিল প্রকৃতির রাজ্যের অবস্থা। সেখানে কোনো সরকার ছিল না বিধায় কোনো আইন ও ছিল না। এরূপ অবস্থায় মানুষ সর্বদাই ভয়ভীতি ও মৃত্যুর ভয়ে দিনাতিপাত করতো। প্রকৃতির রাজ্যের মানুষ ছিল স্বার্থপর, আত্মকেন্দ্রিক ও পরশ্রীকাতর। আর মানুষের জীবন ছিল সঙ্গীহীন, অসহায়, নোংরা, পাশবিক ও ক্ষণস্থায়ী। হবস প্রকৃতির রাজ্যে মানুষে মানুষে বিবাদের তিনটি কারণের কথা বলেছেন। (১) অন্যের সবকিছু আত্মসাৎ করার প্রবণতা, (২) নিজের কোনোকিছু অন্যকে না দেয়ার প্রবণতা এবং (৩) সম্মান ও গৌরব অর্জনের প্রবণতা।

হবসের সামাজিক চুক্তি মতবাদঃ হবসের সামাজিক চুক্তি মতবাদের উৎপত্তি ঘটছে তার মানবপ্রকৃতি ও প্রকৃতির রাজ্যের বর্ণনার মাধ্যমে। তার সামাজিক চুক্তি মতবাদের মূল বক্তব্য ছিল- রাষ্ট্র জনগণের মধ্যে সম্পাদিত চুক্তির মাধ্যমে উৎপত্তি লাভ করেছে। রাষ্ট্রের উৎপত্তির পূর্বে মানুষ প্রকৃতির রাজ্যে বাস করত এবং প্রাকৃতিক নিয়ম দ্বারা পরিচালিত হত। প্রকৃতির রাজ্যে প্রকৃতির নিয়মের আওতাধীনে মানুষ প্রাকৃতিক অধিকার ভোগ করত। কিন্তু কালক্রমে প্রাকৃতিক আইনের কার্যকারিতা ও প্রাকৃতিক অধিকার উপভোগ করা অনিশ্চিত ও অসম্ভব হয়ে পড়ে। এ পরিস্থিতি হতে নিষ্কৃতি পাওয়ার জন্য মানুষ স্বেচ্ছায় ও সুচিন্তিতভাবে পরস্পর চুক্তি সম্পাদনের মাধ্যমে রাষ্ট্র গঠন করে। এ চুক্তির দ্বারা গঠিত রাজনৈতিক সংগঠনের হাতে মানুষ সমস্ত ক্ষমতা ও প্রাকৃতিক অধিকার হস্তান্তর করে, তারা সামাজিক অধিকার ও নিরাপত্তা লাভ করে।

উপর্যুক্ত আলোচনা থেকে হবসের সামাজিক চুক্তি মতবাদের নিম্নোক্ত বৈশিষ্ট্যগুলো লক্ষ্য করা যায়ঃ (১) সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামতের প্রাধান্য (২) শান্তি ও নিরাপত্তা চুক্তির অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ (৩) জনগণের নিজস্ব উদ্যোগে চুক্তি সম্পাদন (৪) সামাজিক চুক্তি অপরিবর্তনীয় ও নিয়ন্ত্রণমুক্ত (৬) চুক্তি সার্বভৌমত্বের ভিত্তি।

জ্যা জ্যাক রুশোর রাষ্ট্রদর্শনঃ ফরাসি রাষ্ট্রবিজ্ঞানী জ্যা জ্যাক রুশোর রাষ্ট্রদর্শন নিম্নোক্ত বিষয়গুলোর মধ্যে প্রতিভাত হয়ে ওঠে। যেমনঃ

মানবপ্রকৃতি সম্পর্কে রুশোঃ রুশো মানবপ্রকৃতি সম্পর্কে যেসকল বৈশিষ্ট্যের কথা বলেছেন তা হলোঃ (১) মানুষ জন্মগতভাবে ভাল (২) মানুষ জন্মগতভাবে স্বাধীন (৩) মানুষ জন্মগতভাবে অনিষ্টকারী নয়। (৪) মানুষ পরস্পরের প্রতি সহানুভূতিশীল (৫) মানুষ সুন্দর এবং সাধু (৬) আদর্শ প্রতিষ্ঠান স্বার্থ সংরক্ষণ করবে (৭) শ্রদ্ধা, বিশ্বাস ও নৈতিকতা বেশি প্রয়োজন (৮) বুদ্ধি, বিজ্ঞান, যুক্তি খারাপ জিনিস (৯) স্বাভাবিক প্রবৃত্তি জীবনকে অর্থবহ করে।

প্রকৃতির রাজ্য সম্পর্কে রুশোঃ রুশোর মতে, প্রকৃতির রাজ্য ছিল সুখ, স্বাধীনতা ও সমতার রাজ্য। এখানে মানুষের জীবন ছিল অনাবিল আনন্দে ভরপুর। প্রকৃতির রাজ্যের মানুষের চরিত্র বিশ্লেষণ করতে গিয়ে রুশো নিম্নোক্ত বৈশিষ্ট্যগুলো উল্লেখ করেছেন। (১) প্রকৃতির রাজ্যের মানুষ স্বার্থপর কলহপ্রিয় ও আত্মকেন্দ্রিক ছিল না। তারা ছিল শান্তিপ্রিয়, পরোপকারী।

(২) প্রকৃতির রাজ্যে মানুষ ছিল মূলত আবেগপ্রবণ প্রাণী, যুক্তিপ্রবণ নয়। (৩) প্রকৃতির রাজ্যে মানুষ সৎ ছিল। (৪) প্রকৃতির রাজ্যের মানুষ স্বাধীনভাবে জন্মগ্রহণ করেও পরাধীনতার শৃঙ্খলে আবদ্ধ হয়।

রুশোর সামাজিক চুক্তি মতবাদঃ রুশোর মতে, একমাত্র সামাজিক চুক্তি সম্পাদনের মাধ্যমে মানুষ সার্থকভাবে এই পরিস্থিতির মোকাবেলা করতে সক্ষম হয়। তিনি বিশ্বাস করেন যে, চুক্তি সম্পাদনের ফলে যে নতুন রাষ্ট্রের জন্ম হয় তার মধ্যে মানুষের সাম্য ও স্বার্থ-স্বাধীনতা অবলুপ্ত না হয়ে তা নতুনভাবে দৃঢ়তর ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত হয়। রুশো বিশ্বাস করতেন, চুক্তির ফলে যে রাষ্ট্রের সৃষ্টি হয় তার মধ্যে মানুষের স্বাভাবিক সাম্য ও স্বাধীনতা কোনো চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয় না।

হবস ও রুশোর দর্শনের তুলনামূলক আলোচনাঃ দর্শনের ক্ষেত্রে টমাস হবস ও রুশোর অবদান খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তাদের দর্শনের ক্ষেত্রে মিল এবং অমিল দুটোই খুঁজে পাওয়া যায়। যথাঃ

মিলঃ টমাস হবসের মানবপ্রকৃতি, প্রকৃতির রাজ্য ও সামাজিক চুক্তি মতবাদের সাথে রুশোর মানবপ্রকৃতি, প্রকৃতির রাজ্য ও সামাজিক চুক্তি মতবাদের সাদৃশ্যগুলো হলো- (১) প্রকৃতির রাজ্যে মানুষ অসহায়, অসংঘবদ্ধ ও অস্থিতিশীল ছিল। প্রকৃতির রাজ্যে যখন অশান্তি ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয় তখন মানুষ সামাজিক চুক্তির মাধ্যমে রাষ্ট্র গঠন করে। (২) প্রকৃতি রাজ্য বর্ণনার প্রধান উদ্দেশ্য রাষ্ট্র গঠন কিংবা সামাজিক চুক্তি মতবাদের ভিত্তি রচনা করা। আর জনগণ স্বেচ্ছায় চুক্তি সম্পাদন করেছে। (৩) শান্তি ও নিরাপত্তা চুক্তির অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ (৪) সামাজিক চুক্তি চিরস্থায়ী ও সার্বভৌম। 

অমিলঃ হবস ও রুশোর সামাজিক চুক্তি মতবাদ কিছুটা সামঞ্জস্যপূর্ণ মনে হলেও প্রকৃতির রাজ্য ও মানবপ্রকৃতি সম্পর্কিত মতবাদের মধ্যে বৈসাদৃশ্য খুব বেশি পরিলক্ষিত হয়। যেমন-

(১) মানবপ্রকৃতি সম্পর্কেঃ মানবপ্রকৃতি সম্পর্কে হবসের দর্শন-মানুষ সাধারণত ক্ষমতালোভী, স্বার্থপর, নির্বোধ, আত্মকেন্দ্রিক, কার্যকারণ নীতির অধীন ও অসীম আকাঙ্ক্ষা প্রবণ। অন্যদিকে রুশো মনে করেন মানুষ জন্মগতভাবে ভাল, স্বাধীন ও পরস্পরের প্রতি সহানুভূতিশীল। কিন্তু স্বাভাবিক প্রবৃত্তি মানুষকে অর্থবহ করে তোলে। ফলে সে প্রতি ক্ষেত্রে শৃঙ্খলিত ও বাধাগ্রস্ত হয়।

(২) প্রকৃতির রাজ্য সম্পর্কেঃ  হবসের মতে, প্রকৃতির রাজ্যে মানুষ ছিল আত্মকেন্দ্রিক, মানুষের জীবন ছিল অসহায় সঙ্গীহীন, নোংরা, পাশবিক ও ক্ষণস্থায়ী। এখানে কোনো আইন-কানুন ছিল না। অন্যদিকে রুশোর মতে, প্রকৃতির রাজ্যে মানুষ ছিল আবেগপ্রবণ। এখানে সুখ, স্বাধীনতা ও সাম্য বিদ্যমান ছিল।

পরিশেষঃ রাষ্ট্রদর্শনের ক্ষেত্রে স্ব স্ব অবস্থানে টমাস হবস ও জাঁ জ্যাক রুশো গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন। মানবপ্রকৃতি, প্রকৃতির রাজ্য মতবাদ সম্পর্কে উভয়ের দৃষ্টিভঙ্গির ব্যাপক পার্থক্য লক্ষ্য করা গেলেও সামাজিক চুক্তি মতবাদ সম্পর্কে তাদের মধ্যে সাদৃশ্য পরিলক্ষিত হয়। সামাজিক চুক্তি সম্পর্কে তারা উভয়েই বলেছেন-মানবপ্রকৃতি ও প্রকৃতির রাজ্যে যখন বিশৃঙ্খলা ও অশান্তি সৃষ্টি হয় তখন মানুষ নিজেরাই সামাজিক চুক্তির মাধ্যমে রাষ্ট্র গঠন করে।