ইবাদতের মধ্যে অন্যতম হলো হজ, যা প্রত্যেক সামর্থ্যবান ব্যক্তিদের
উপর ফরয। এর ফযীলত যেমন অপরিসীম তেমনি গুরুত্ব ও সীমাহীন। পৃথিবীতে যত নেক
আমল রয়েছে তার মধ্যে হজ্জ শ্রেষ্ঠতম ইবাদত। রাসূল (সাঃ) অন্য সকল আমলের উপর
হজ্জের মর্যাদাকে পূর্ব ও পশ্চিম দিগন্তের দূরত্বের সাথে তুলনা করেছেন।
আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে হজ্জ পালনকারীকে গুনাহমুক্ত নবজাতকের সাথে তুলনা
করা হয়েছে। কবুল হজ্জের পুরস্কার হল জান্নাত। হজ্জের প্রতিটি কাজ সম্পাদনের জন্য
রয়েছে পৃথক মর্যাদা ও ফযীলত। এই হজ এমন একটি ইবাদত যার মাধ্যমে বিশ্ব মুসলিম
একত্রিত হওয়ার সুযোগ লাভ করে। নিম্নে হজ্জের গুরুত্ব ও ফযীলত আলোচনা করা হল –
পোস্ট সূচিপত্রঃ হজের ফজিলত ও গুরুত্ব
কুরআনের আলোকে হজ্জের গুরুত্ব
ফরয ইবাদতের মধ্যে অন্যতম হলো হজ, যা প্রত্যেক সামর্থ্যবান
ব্যক্তিদের উপর ফরয। সালাত, সিয়াম ও যাকাতের মত হজ্জ পালন করা সামর্থ্যবান
ব্যক্তিদের উপর ফরয। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, “আর আল্লাহর উদ্দেশ্যে এ গৃহের
হজ্জ করা ঐ ব্যক্তির উপর ফরয করা হল, যার এখানে আসার সামর্থ্য রয়েছে। আর যে
ব্যক্তি তা অস্বীকার করে (সে জেনে রাখুক যে) আল্লাহ জগদ্বাসী থেকে মুখাপেক্ষীহীন”
(সূরা আল ইমরান)।
এটিই হজ্জ ফরয হওয়ার মূল দলীল। তিনি আরো বলেন, “আর তোমরা আল্লাহর উদ্দেশ্যে হজ্জ
ও ওমরাহ পূর্ণ কর। কিন্তু যদি তোমরা বাধাপ্রাপ্ত হও, তাহলে যা সহজলভ্য হয়, তাই
কুরবানী কর” ( সূরা আল বাকারা, ২/১৯৬)। অধিকাংশ সাহাবী ও ওলামায়ে কেরামগন অভিমত
ব্যক্ত করেছেন যে এ আয়াতটি হজ্জ ফরয হওয়ার পাশাপাশি ওমরাহ ফরয হওয়ারও দাবী রাখে
। অন্যত্র তিনি বলেন –
“আর তুমি মানুষের মাঝে হজ্জের ঘোষণা প্রচার করে দাও। তারা তোমার কাছে আসবে পায়ে
হেঁটে এবং সকল প্রকার (পথশ্রান্ত) কৃশকায় উটের উপর সওয়ার হয়ে দূর-দূরান্ত হতে।
যাতে তারা তাদের (দুনিয়া ও আখেরাতের) কল্যাণের জন্য সেখানে উপস্থিত হতে পারে
এবং
আরো পড়ুনঃ হজ কাকে বলে – হজ কত প্রকার ও কি কি জেনে নিন
রিযিক হিসাবে তাদের দেওয়া গবাদিপশুসমূহ যবেহ করার সময় নির্দিষ্ট দিনগুলিতে তাদের
উপর আল্লাহর নাম উচ্চারণ করতে পারে”(সূরা হজ্জ,আয়াত- ২২/২৭-২৮)। অত্র আয়াতসমূহে
হজ্জ ফরয হওয়ার বিষয়টি সুস্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয়েছে।
হাদীছের আলোকে হজ্জের গুরুত্ব
হজ্জের গুরুত্ব সম্পর্কে অনেক হাদীছ বর্ণিত হয়েছে। এর মধ্যে কয়েকটি
হাদীছ সম্পর্কে আলোচনা করা হল-
ইবনু ওমর (রাঃ) হতে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, ” ইসলামের রোকন
পাঁচটি বা ইসলাম পাঁচটি স্তম্ভের উপর প্রতিষ্ঠিত। সেগুলো হল –
(১) ইমান, এ মর্মে তাওহীদ ও রিসালাতের সাক্ষ্য প্রদান করা যে, আল্লাহ ছাড়া
কোন উপাস্য নেই এবং মুহাম্মাদ (সাঃ) তাঁর বান্দা ও রাসূল
(২) নামাজ বা সালাত কায়েম করা
(৩) যাকাত প্রদান করা
(৪) হজ্জ করা ও
(৫) রমজান মাসের রোজা বা সিয়াম পালন করা”।
ইবনু আববাস (রাঃ) হতে বর্ণিত তিনি বলেন, “একদা আকরা বিন হাবেস নবী করীম (সাঃ)-কে
জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর রাসূল! হজ্জ কি প্রতি বছর ফরয না জীবনে একবারই ফরয?
তিনি বললেন, না বরং হজ্জ জীবনে একবার ফরয। যে অধিক করবে তা তার জন্য নফল হবে”।
হজ্জ এমন গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত যে, পৃথিবীর সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতিতেও হজ পালন করতে
হয়। অন্য বর্ণনায় আছে, রাসূল (্সাঃ) বলেন, “বায়তুল্লাহর হজ্জ বন্ধ না হওয়া
পর্যন্ত ক্বিয়ামত সংঘটিত হবে না”।আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন,
“ইয়াজূজ ও মাজূজ বের হওয়ার পরও বায়তুল্লাহর হজ্জ ও ওমরাহ পালিত হবে’।
আরো পড়ুনঃ সালাতের প্রকারভেদ – সালাতের নিয়ম জেনে নিন
অন্য এক বর্ণনায় পাওয়া যায়, রাসূল (সাঃ) বলেছেন, “তোমরা দ্রুত ফরয হজ্জ সম্পাদন
কর। কারণ তোমাদের কেউ জানে না কখন অপরিহার্য প্রয়োজন সামনে এসে যায়”। ইবনে আববাস
(রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, “যে ব্যক্তি হজ্জের
সংকল্প করে সে যেন অবিলম্বে তা আদায় করে। কারণ মানুষ কখনও অসুস্থ হয়ে যায়, কখনও
প্রয়োজনীয় জিনিস বিলুপ্ত হয়ে যায় এবং কখনও অপরিহার্য প্রয়োজন সামনে এসে যায়”।
হজ্জ অধিক গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত হওয়ায় রাসূল (সাঃ) তা দ্রুত পালন করার নির্দেশ
দিয়েছেন। ওমর (রাঃ) বলেন, “যাদের সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও হজ্জ সম্পাদন করবে না,
তারা ইহূদী ও নাছারা অবস্থায় মারা যাবে”।এই কথার মাধ্যমে হজ্জের গুরুত্ব বুঝানো
হয়েছে এবং এই ফরজ ইবাদত ত্যাগকারীদেরকে হুমকী দেওয়া হয়েছে। এর অর্থ এই নয় যে,
তারা অমুসলিম হয়ে যাবে”।
আবূ হুরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণিত তিনি বলেন, একদা রাসুলুল্লাহ (সাঃ) আমাদের
উদ্দেশ্যে ভাষণে বললেন, “হে জনগণ! তোমাদের উপর হজ্জ ফরয করা হয়েছে। অতএব তোমরা
হজ্জ সম্পাদন কর। এক ব্যক্তি জিজ্ঞেস করল, হে আল্লাহর রাসূল! তা কি প্রতি বছর?
তিনি নীরব থাকলেন এবং সে তিনবার কথাটি বলল। এরপর রাসুলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, আমি
হ্যাঁ বললে তা ওয়াজিব হয়ে যাবে (প্রতি বছরের জন্য) অথচ তোমরা তা পালন করতে সক্ষম
হবে না।
তিনি পুনরায় বললেন, তোমরা আমাকে ততটুকু কথার উপর থাকতে দাও যতটুকু আমি তোমাদের
জন্য বলি। কারণ তোমাদের পুর্বেকার লোকেরা তাদের অধিক প্রশ্নের কারণে এবং তাদের
নবীদের সাথে বিরোধিতার কারণে ধ্বংস হয়েছে। অতএব আমি তোমাদের যখন কোন কিছু করার
নির্দেশ দেই, তোমরা তা যথাসাধ্য পালন কর এবং যখন তোমাদের কোন কিছু করতে নিষেধ করি
তখন তা পরিত্যাগ কর”।
এ হাদীছটির মাধ্যমে স্পষ্টভাবে বুঝা যায় যে, জীবনে একবার হজ্জ ফরয হওয়ার প্রমাণ
বহন করে। কেউ যদি বেশি বার হজ পালন করে তাহলে তা নফল বলে গণ্য হবে
হজ্জের ফযীলত
মহান আল্লাহ তা’আলা প্রত্যেক সামর্থ্যবান মুমিন মুসলমানের উপর হজ্ব
ফরয করেছেন। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তাঁর মুমিন বান্দাদের জান্নাত দানের জন্য এই
হজ্ব ফরয করেছেন। হজের প্রতিটি কাজ সম্পাদনের মাধ্যমে আলাদা আলাদা ফজিলত পাওয়া
যায়। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিভিন্ন সময় হজের মর্যাদা বর্ণনা
করেছেন ।
হজ্জের একমাত্র প্রতিদান জান্নাত
আল্লাহর রাসূল (সাঃ) বিদায় হজ্জের ভাষণে বলেছিলেন, “হে লোকসকল! সত্বর তোমরা
তোমাদের প্রভুর সঙ্গে মিলিত হবে। অতঃপর তিনি তোমাদেরকে তোমাদের আমল সম্পর্কে
জিজ্ঞেস করবেন। অতএব সাবধান! তোমরা আজকের দিনের পর যেন পুনরায় পথভ্রষ্ট হয়ো না”।
“কবুল হজ্জ বা হজ্জে মাবরূর বলতে ঐ হজ্জকে বুঝায়, যে হজ্জে কোন গোনাহ করা হয়নি
এবং যে হজ্জের আরকান-আহকাম সবকিছু (ছহীহ সুন্নাহ মোতাবেক) পরিপূর্ণভাবে আদায় করা
হয়েছে। এতদ্ব্যতীত হজ্জ থেকে ফিরে আসার পরে পূর্বের চেয়ে উত্তম হওয়া এবং পূর্বের
গোনাহে পুনরায় লিপ্ত না হওয়া কবুল হজ্জের বাহ্যিক নিদর্শন হিসাবে গণ্য হয়”।
আবু হুরায়রাহ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূল (সাঃ) বলেছেন, “এক ওমরাহ অপর ওমরাহ
পর্যন্ত সময়ের (ছগীরা গুনাহের) কাফফারা স্বরূপ। আর জান্নাতই হল কবুল হজ্জের
একমাত্র প্রতিদান”।
হজ্জ পালনকারী নবজাতকের ন্যায় গুনাহমুক্ত
সঠিক ভাবে হজ্ব পালনকারীকে নবজাতকের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। আবু হুরায়রা (রাঃ)
হতে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূল (সাঃ) বলেছেন, “যে ব্যক্তি আল্লাহর উদ্দেশ্যে হজ্জ
করেছে। যার মধ্যে সে অশ্লীল কথা বলেনি বা অশ্লীল কার্য করেনি, সে হজ্জ হতে ফিরবে
সেদিনের ন্যায় (নিষ্পাপ অবস্থায়) যেদিন তার মা তাকে প্রসব করেছিলেন”। অর্থাৎ সে
কাবীরা-ছাগীরা, প্রকাশ্য-গোপনীয় সকল গুনাহ থেকে ঐরূপ মুক্ত হয়ে ফিরে আসে। যেরূপ
একজন শিশু গুনাহ মুক্ত হয়ে জন্মগ্রহণ করে।
হজ্জ পূর্ববর্তী গুনাহকে ধ্বংস করে দেয়
ইবনু শামাসা আল-মাহরী (রহঃ) হতে বর্ণিত তিনি বলেন, আমরা আমর ইবনুল আছ (রাঃ)-এর
মুমূর্ষু অবস্থায় তাকে দেখতে উপস্থিত হলাম। তখন তিনি দীর্ঘ সময় ধরে কাঁদলেন এবং
দেয়ালের দিকে মুখ ফিরিয়ে রাখলেন। এরপর তিনি বললেন, আল্লাহ যখন আমার অন্তরে
ইসলামের অনুরাগ সৃষ্টি করে দিলেন, তখন আমি রাসূল (সাঃ)-এর নিকটে উপস্থিত হয়ে
অনুরোধ জানালাম যে, আপনার ডান হাত বাড়িয়ে দিন, যাতে আমি বায়‘আত করতে পারি।
আরো পড়ুনঃ সালাত কাকে বলে – সালাতের উপকারিতা সম্পর্কে জানুন
রাসূল (সাঃ) তাঁর ডান হাত বাড়িয়ে দিলেন। কিন্তু আমি আমার হাত গুটিয়ে নিলাম। তখন
রাসূল (সাঃ) বললেন, কি ব্যাপার হে আমর? আমি বললাম, আমি শর্ত করতে চাই। তিনি
বললেন, কি শর্ত করতে চাও? আমি বললাম, আল্লাহ যেন আমার (পিছনের সব) গুনাহ মাফ করে
দেন। তিনি বললেন, হে আমর! তুমি কি জান না, ‘ইসলাম’ তার পূর্বেকার সকল পাপ বিদূরিত
করে দেয় এবং ‘হিজরত’ তার পূর্বেকার সকল কিছুকে বিনাশ করে দেয়। একইভাবে ‘হজ্জ’ তার
পূর্বের সবকিছুকে বিনষ্ট করে দেয়”।
হাজীর সম্মানে মাটি, পাথর, বৃক্ষরাজি, সবকিছুই তার সাথে তালবিয়া পাঠ করে –
তালবিয়ার উচ্চারণ হল –
- ‘লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক,
- লাব্বাইক, লা শারিকা লাকা লাব্বাইক,
- ইন্নাল হামদা ওয়ান্ নিমাতা লাকা ওয়াল মুলক্,
- লা শারিকা লাক।’
তালবিয়ার অর্থ –
- ‘আমি হাজির হে আল্লাহ! আমি উপস্থিত!
- আপনার ডাকে সাড়া দিতে আমি হাজির। আপনার কোনো অংশীদার নেই।
- নিঃসন্দেহে সমস্ত প্রশংসা ও সম্পদরাজি আপনার এবং একচ্ছত্র আধিপত্য আপনার।
- আপনার কোনো অংশীদার নেই।
সাহল ইবনু সাদ (রাঃ) হতে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূলু (সাঃ) বলেছেন, “যখন কোন মুসলিম
তালবিয়া পাঠ করে তখন তার ডান ও বামে মাটি, পাথর, বৃক্ষরাজি, সবকিছুই তার সাথে
তালবিয়া পাঠ করে। এমনকি পৃথিবীর এ প্রান্ত হতে ঐ প্রান্ত পর্যন্ত (তালবিয়া
পাঠকারীদের দ্বারা) পূর্ণ হয়ে যায়”।
হজ্জে মৃত্যুবরণকারীগণ ক্বিয়ামতের দিন তালবিয়া পাঠরত অবস্থায় উঠবে
ইবনু আববাস (রাঃ) হতে বর্ণিত তিনি বলেন, `এক ব্যক্তি আল্লাহর রাসূল সাঃ)-এর সঙ্গে
আরাফাতে অবস্থান কালে অকস্মাৎ সে তার সওয়ারী হতে পড়ে যান। এতে তাঁর ঘাড় মটকে গেল
অথবা রাবী বলেন, ঘাড় মটকে দিল। (যাতে তিনি মারা গেলেন)। তখন আল্লাহর রাসূল (সাঃ)
বললেন, –
তাঁকে বরই পাতাসহ পানি দিয়ে গোসল দাও এবং দু’কাপড়ে তাঁকে কাফন দাও; তাঁকে সুগন্ধি
লাগাবে না এবং তার মস্তক আবৃত করবে না। কেননা আল্লাহ তাআলা ক্বিয়ামতের দিন
তাঁকে তালবিয়া পাঠরত অবস্থায় উত্থিত করবেন`।
অন্যতম শ্রেষ্ঠ আমল হজ্জ
এক হাদীসে রয়েছে, রাসূল (সাঃ) বলেন, “শ্রেষ্ঠ আমল হল এক আল্লাহর প্রতি ঈমান
আনা। অতঃপর আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করা। অতঃপর কবুল হজ্জ। যা সকল আমলের উপর এমন
মর্যাদাবান যেমন পূর্ব দিগন্ত ও পশ্চিম দিগন্তের মধ্যে দূরত্ব রয়েছে”।আবু হুরায়রা
(রাঃ) হতে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূল (সাঃ)-কে জিজ্ঞেস করা হল, কোন আমলটি
সর্বোত্তম?
তিনি বললেন, “শ্রেষ্ঠ আমল হল আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের উপরে ঈমান আনা। বলা হল,
তারপর কি? তিনি বললেন, আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করা। জিজ্ঞেস করা হল, তারপর কি?
তিনি বললেন, কবুল হজ্জ”।
শ্রেষ্ঠ জিহাদ হজ্জ
উম্মুল মুমিনীন আয়েশা (রাঃ) হতে বর্ণিত তিনি বলেন, “আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল!
আমরা কি আপনাদের সঙ্গে যুদ্ধ ও জিহাদে অংশগ্রহণ করব না? তিনি বললেন, তোমাদের জন্য
উত্তম ও উৎকৃষ্ট জিহাদ হল হজ্জ, কবূল হজ্জ। আয়েশা (রাঃ) বললেন, আল্লাহর রাসূল
(সাঃ) হতে এ কথা শোনার পর আমি আর কখনো হজ্জ ছাড়ব না”।
আরো পড়ুনঃ
রোজা কত প্রকার – রোজা সম্পর্কে হাদিস জেনে নিন
অপর এক হাদীসের বর্ণনায় এসেছে, রাসূল (সাঃ) বলেন, “বড়, ছোট, দুর্বল ও মহিলা
সকলের জন্য জিহাদ হল হজ্জ ও ওমরাহ”।অন্য বর্ণনায় রয়েছে, আয়েশা (রাঃ) একদা
রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-কে জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর রাসূল! মহিলাদের উপরে “জিহাদ”
আছে কি? তিনি বললেন, হ্যাঁ আছে। তবে সেখানে যুদ্ধ নেই। সেটি হল হজ্জ ও ওমরাহ”।
অন্য বর্ণনায় রয়েছে, এক ব্যক্তি রাসূল (সাঃ)-এর নিকট এসে বলল, হে আল্লাহর রাসূল!
‘আমি তো ভীতু এবং দুর্বল (আর আমার উপর জিহাদ ফরয)। তখন রাসূল (সাঃ) বললেন, ছুটে
এসো এমন এক জিহাদের দিকে যেখানে কোন কষ্ট নেই। আর তা হল হজ্জ”।
হজ্জ দরিদ্রতা ও গোনাহ সমূহ দূর করে
আব্দুল্লাহ ইবনু মাসঊদ (রাঃ) হতে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, “তোমরা
হজ্জ ও ওমরাহর মধ্যে ধারাবাহিকতা বজায় রাখো (অর্থাৎ সাথে সাথে কর)। কেননা এ দুটি
মুমিনের দরিদ্রতা ও গোনাহ সমূহ দূর করে দেয়, যেমন (কামারের আগুনের) হাপর লোহা,
স্বর্ণ ও রৌপ্যের ময়লা দূর করে দেয়। আর কবুল হজ্জের প্রতিদান জান্নাত ব্যতীত
কিছুই নয়”।
হাজীগণ আল্লাহর মেহমান
আবু হুরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূল (সাঃ) বলেছেন, “আল্লাহর মেহমান হল
তিনটি দল-
১) আল্লাহর রাস্তায় যুদ্ধকারী,
২) হজ্জকারী ও
৩) ওমরাহ্কারী
অপর বর্ণনায় রয়েছে, “তারা (হাজীগন) কোন কিছু চাইলে তিনি তা দেন”। অন্য বর্ণনায়
রয়েছে, রাসূল (সাঃ) বলেন, “হজ্জ ও ওমরাহ পালনকারীগণ আল্লাহর মেহমান। তারা দোয়া
করলে তিনি কবুল করেন। তারা ক্ষমা প্রার্থনা করলে তিনি তাদের ক্ষমা করে
দেন”।
ফেরেশতাদের সামনে আল্লাহর হাজীদের প্রশংসা
হাদীসে বর্ণিত হয়েছে, “ওরা আল্লাহর মেহমান। আল্লাহ ওদের ডেকেছেন তাই ওরা এসেছে।
এখন ওরা চাইবে আর আল্লাহ তা দিয়ে দিবেন”। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেন, “শ্রেষ্ঠ
দোয়া হল আরাফাহ দিবসের দোআ”। হযরত আয়েশা (রাঃ) হতে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূল
(ছাঃ) বলেছেন, –
“আরাফার দিন ব্যতীত অন্য কোন দিন আল্লাহ এত অধিক পরিমাণ লোককে জাহান্নাম থেকে
মুক্ত করেন না। ঐদিন আল্লাহ নিকটবর্তী হন। অতঃপর আরাফাহ ময়দানের হাজীদের নিয়ে
ফেরেশতাদের নিকট গর্ব করেন ও বলেন, দেখ ঐ লোকেরা কি চায়”।
হজ্জের নিয়তকারীগণ কেন হজ্জ করতে সক্ষম না হলেও নেকী পাবেন
আবু হুরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এরশাদ করেছেন, “যে
ব্যক্তি হজ্জ, ওমরাহ কিংবা জিহাদের উদ্দেশ্যে বের হল এবং রাস্তায় মৃত্যুবরণ করল,
আল্লাহ তার জন্য পূর্ণ নেকী লিখে দিবেন”।
হাজীদের প্রতিটি পদচারণায় নেকী অর্জিত হয় ও গুনাহ দূর হয়
ইবনু ওমর (রাঃ) হতে বর্ণিত তিনি বলেন, আমি রাসূল (সা)-কে বলতে শুনেছি, “যে
ব্যক্তি বায়তুল্লাহর সাতটি ত্বাওয়াফ করবে, এই সময় প্রতি পদক্ষেপে আল্লাহ তার জন্য
একটি করে নেকী লিখেন এবং একটি গুনাহ বিদূরীত করেন এবং একগুণ মর্যাদা বৃদ্ধি করে
দেন”।
বায়তুল্লাহ তাওয়াফের ফযীলত
আব্দুল্লাহ ইবনু ওমর (রাঃ) হতে বর্ণিত তিনি বলেন, “যে ব্যক্তি বায়তুল্লাহর তাওয়াফ
করবে ও শেষে দুই রাকাত সালাত আদায় করবে, সে যেন একটি গোলাম আযাদ করলো। তিনি
বলেন, “তাওয়াফ হল সালাতের ন্যায়। তবে এই সময় প্রয়োজনে যৎসামান্য নেকীর কথা বলা
যাবে”।
হজ্জের প্রতিটি বিধান সম্পাদনের জন্য পৃথক মর্যাদা ও নেকী
ইবনু ওমর (রাঃ) হতে বর্ণিত তিনি বলেন, একদা আমরা রাসূল (সা)-এর সাথে মিনার মসজিদে
বসা ছিলাম। এমন সময় একজন আনছার ও ছাক্বীফ গোত্রের একজন লোক এসে সালাম দিল। অতঃপর
বিভিন্ন প্রশ্ন করল , তাদের জবাবে রাসূল (সা) বললেন, তুমি যখন বায়তুল হারাম
তাওয়াফের উদ্দেশ্যে বের হও, তোমার এবং তোমার উটের প্রতিটি পদক্ষেপে আল্লাহ তার
জন্য একটি করে নেকী লিখেন এবং তোমার থেকে একটি গুনাহ মিটিয়ে দেন।
তওয়াফের পর তোমার দু’রাক‘আত সলাত আদায় বানী ইসমাঈল গোত্রের একটি গোলাম আযাদ করার
সমতুল্য। এরপর ছাফা-মারওয়ায় সাঈ করা সত্তরটি গোলাম মুক্ত করার সমতুল্য। তোমার
সন্ধ্যায় আরাফায় অবস্থান করা, এই দিন আল্লাহ তা‘আলা প্রথম আকাশে নেমে আসেন এবং
ফেরেশতাদের সামনে গর্ব করে বলেন, আমার বান্দারা দূর-দূরান্ত হতে এলোমেলো হয়ে আমার
নিকট এসেছে। তারা আমার রহমতের প্রত্যাশা করে।
যদি তোমাদের গুনাহ বালির পরিমাণ বা বৃষ্টির ফোঁটা বা সমুদ্রের ফেনার পরিমাণও হয়
তবুও আমি তা ক্ষমা করে দিব। হে আমার বান্দারা! তোমরা কল্যাণের দিকে ধাবিত হও,
তোমাদের জন্য ক্ষমা রয়েছে। তাদের জন্যও ক্ষমা রয়েছে যাদের জন্য তোমরা সুপারিশ
করবে। আর তোমার প্রতিটি নিক্ষিপ্ত কংকর যা তুমি নিক্ষেপ কর তা ধ্বংসাত্মক আমলের
জন্য কাফফারা স্বরূপ। আর তোমার কুরবানীটি আল্লাহর নিকট তোমার জন্য ভান্ডার।
আরো পড়ুনঃ রোজা কাকে বলে – রোজা ভঙ্গের কারণ জেনে নিন
আর তোমার মাথা মুন্ডন যার প্রতিটি চুলের বিনিময়ে তোমার জন্য রয়েছে একটি নেকী এবং
এর মাধ্যমে তোমার একটি গুনাহ বিদূরীত হবে। আর তোমার বায়তুল্লাহর বিদায়ী তওয়াফ
যেটি তুমি করবে, এতে তোমার কোন গুনাহ থাকবে না। ফেরেশতা এসে তোমার কাঁধে হাত রেখে
বলবে, ভবিষ্যতের জন্য তুমি আমল করতে থাক, কারণ তোমার অতীতের সকল গুনাহ ক্ষমা করে
দেওয়া হয়েছে’।
অন্য এক বর্ণনায় রয়েছে, আল্লাহ আরাফার ময়দানে ফেরেশতাদের বলবেন, আমার বান্দারা কি
উদ্দেশ্যে এসেছে? তারা বলে, তারা আপনার সন্তুষ্টি ও জান্নাত লাভের প্রত্যাশা করে।
তখন আল্লাহ বলেন, আমার নিজের ও সৃষ্টি জগতের কসম করে বলছি, যুগের পর যুগ, বৃষ্টির
ফোটা এবং বালির পরিমাণ অসংখ্য বান্দাকে ক্ষমা করে দিলাম। আর তোমার কংকর নিক্ষেপের
ব্যাপারে আল্লাহ তা‘আলা বলেন, অতঃপর কোন ব্যক্তি জানে না তাদের জন্য চোখ জুড়ানো
কি জিনিস লুকিয়ে রাখা হয়েছে,
তারা যা করত, তার বিনিময় স্বরূপ’ (সূরা সাজদাহ)। আর তোমার মাথা মুন্ডন- তোমার যে
চুলটি মাটিতে নিক্ষিপ্ত হয় সেটি ক্বিয়ামতের দিন তোমার জন্য আলোকবর্তিকায় পরিণত
হবে। আর তোমার কাবার বিদায়ী তওয়াফে তুমি গুনাহ থেকে এমনভাবে মুক্ত হবে যেমন তোমার
মা তোমাকে গুনাহ মুক্ত অবস্থায় জন্ম দিয়েছে”।
হাজারে আসওয়াদ ও রুকনে ইয়ামানী স্পর্শ করার ফযীলত
রাসূল (সাঃ) হাজারে আসওয়াদের ব্যাপারে বলেন, “আল্লাহ ক্বিয়ামতের দিন হাজারে
আসওয়াদকে উঠাবেন এমন অবস্থায় যে, তার দুটি চোখ থাকবে, যা দিয়ে সে দেখবে ও একটি
জবান থাকবে, যা দিয়ে সে কথা বলবে এবং ঐ ব্যক্তির জন্য সাক্ষ্য
দিবে, যে ব্যক্তি খালেছ অন্তরে তাকে স্পর্শ করেছে’। ইবনু ওমর
(রাঃ) হতে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাঃ বলেছেন –
“যে ব্যক্তি রুকনে ইয়ামানী ও হাজারে আসওয়াদ (কালো পাথর) স্পর্শ করবে,
এ দুটি তার সমস্ত গোনাহ ঝরিয়ে দিবে”। রাসূল (সাঃ) আরো বলেন, ‘হাজারে আসওয়াদ’
প্রথমে দুধের চেয়েও সাদা অবস্থায় জান্নাত থেকে অবতীর্ণ হয়। অতঃপর বনু আদমের পাপ
সমূহ তাকে কালো করে দেয়”।
আরো পড়ুনঃ বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবস ও বিজয় দিবসের মধ্যে পার্থক্য জেনে নিন
রুকনে ইয়ামানী ও মাকামে ইবরাহীম সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেন, “রুকনে
ইয়ামানী ও মাকামে ইবরাহীম দুটি জান্নাতী ইয়াকূত পাথর। আল্লাহ এ দুটির আলোকে
নির্বাপিত করেছেন। যদি তিনি নির্বাপিত না করতেন তাহলে এ দুটির মাধ্যমে পূর্ব ও
পশ্চিমের মধ্যবর্তী স্থান (পৃথিবী) আলোকিত হয়ে যেত”।
অন্য এক বর্ণ্নায় রয়েছে, রাসূল (সাঃ) বলেন, “রুকনে ইয়ামানী ও মাকামে
ইবরাহীম দুটি জান্নাতের ইয়াকূত পাথর। যদি আদম সন্তানের গুনাহ এ দুটিকে স্পর্শ না
করত, তাহলে এ দুটির মাধ্যমে পূর্ব ও পশ্চিমের মধ্যবর্তী স্থান (পৃথিবী) আলোকিত
হয়ে যেত। আর যদি কোন দৈহিক বা মানসিক রোগী এ দুটিকে স্পর্শ করে তাহলে তাকে
সুস্থতা দান করা হবে”।
পাথরের নিজস্ব কোন ক্ষমতা নেই। আমাদের শুধুমাত্র রাসূল (সাঃ)-এর সুন্নাতের
উপর আমল করতে হবে। হযরত ওমর ফারূক (রাঃ) উক্ত পাথরে চুমু দেওয়ার সময়
বলেছিলেন,”আমি জানি যে, তুমি একটি পাথর মাত্র। তুমি কোন উপকার বা ক্ষতি করতে পারো
না। তবে আমি যদি আল্লাহর রাসূলকে না দেখতাম তোমাকে চুমু দিতে, তাহলে আমি তোমাকে
চুমু দিতাম না”। ওমর ফারূক (রাঃ) উক্ত পাথরে চুমু খেয়েছেন ও কেঁদেছেন”।
যমযমের পানি পান করার ফযীলত
তাওয়াফ শেষে দুই রাকাত সালাত শেষে মাত্বাফ থেকে বেরিয়ে পাশেই যমযম কুয়া। সেখানে
গিয়ে যমযমের পানি বিসমিল্লাহ বলে দাঁড়িয়ে পান করবে ও কিছুটা মাথায় দিবে। যমযমের
পানি সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেন, “ভূপৃষ্ঠে সেরা পানি হল যমযমের পানি। এর
মধ্যে রয়েছে পুষ্টিকর খাদ্য এবং রোগ মুক্তি”। অন্য বর্ণনায় এসেছে, “এটি বরকত
মন্ডিত”।
আরো পড়ুনঃ হিট স্ট্রোক কাকে বলে – হিট স্ট্রোক কেন হয় জেনে নিন
রাসূল (সাঃ) আরো বলেন, “এই পানি কোন রোগ থেকে আরোগ্যের উদ্দেশ্যে পান করলে তোমাকে
আল্লাহ আরোগ্য দান করবেন। এটি পানের মাধ্যমে আশ্রয় প্রার্থনা করলে আল্লাহ তোমাকে
আশ্রয় দিবেন। আর তুমি এটা পরিতৃপ্তি বা পিপাসা মিটানোর জন্য পান করলে আল্লাহ
সেটিই করবেন”। রাসূল (সাঃ) যমযমের পানি বহন করে নিয়ে যেতেন। অতঃপর রোগীদের মাথায়
ঢালতেন এবং তাদের পান করাতেন।
যমযম হল আল্লাহর বিশেষ অনুগ্রহে সৃষ্ট এক অলৌকিক কুয়া। যা শিশু ইসমাঈল ও তাঁর মা
হাজেরার জীবন রক্ষার্থে এবং পরবর্তীতে মক্কার আবাদ ও শেষনবী (সাঃ)-এর আগমন স্থল
হিসাবে গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে সৃষ্ট হয়েছিল।
বায়তুল্লায় নামাজ বা সালাত আদায়ের ফযীলত
জাবের (রাঃ) হতে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এরশাদ করেন, “অন্যত্র সালাত
আদায়ের চেয়ে আমার মসজিদে (মসজিদে নববীতে)সালাত আদায় করা এক হাযার গুণ উত্তম এবং
মসজিদুল হারামে সালাত আদায় করা অন্য মসজিদে সালাত অপেক্ষা এক লক্ষ গুণ উত্তম”।
শেষ কথা
আব্দুল্লাহ ইবনু ওমর (রাঃ) হতে বর্ণিত তিনি বলেন, “যে ব্যক্তি বায়তুল্লাহর তাওয়াফ
করবে ও শেষে দু রাকত ছালাত আদায় করবে, সে যেন একটি গোলাম আযাদ করল”। তিনি বলেন,
“তাওয়াফ হল ছালাতের ন্যায়। তবে এই সময় প্রয়োজনে যৎসামান্য নেকীর কথা বলা যাবে”।
Leave a comment