লর্ড কার্জনের আমলে কলিকাতা বিশবিবিদ্যালয় (1904) আইন পাশ হওয়ার পর দশ বছর পার না হতেই ভারতীয় বিশ্ববিদ্যালয়গুলির তথা প্রচলিত শিক্ষা কাঠামাের পর্যালােচনা ও পুনর্বিন্যাস করার প্রয়ােজন। দেখা দেয়। এই সময় পরস্পরবিরােধী দুটি শক্তি শিক্ষাক্ষেত্রে দারুণভাবে প্রভাব বিস্তার করছিল— লর্ড কার্জনের শিক্ষানীতি এবং জাতীয়তাবােধে উদ্বুদ্ধ শিক্ষা-উদ্যোগ। এদের দ্বন্দ্ব এবং সমন্বয়ের মধ্য দিয়েই শিক্ষাব্যবস্থা এগিয়ে চলেছিল। এই রকম এক পরিস্থিতিতে 1913 খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত হয় শিক্ষা বিষয়ক সরকারি প্রস্তাব।

এই প্রস্তাবে বলা হয়েছিল, সমগ্র ভারতে পাঁচটি বিশ্ববিদ্যালয় এবং 185টি মহাবিদ্যালয় উচ্চশিক্ষা প্রসারের পক্ষে যথেষ্ট নয়। পরিবর্তিত অবস্থার সঙ্গে সংগতিবিধান করে নতুন বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে পরীক্ষা গ্রহণ ও শিক্ষপদু-ধরনের কাজেরই ব্যবস্থা করা প্রয়ােজন। এই শিক্ষাপ্রস্তাবে এগুলি ছাড়াও উচ্চশিক্ষা বিষয়ে আরও কতকগুলি সুপারিশ করা হয়। কিন্তু সরকার বিশেষজ্ঞদের মতামত না নিয়ে এই প্রস্তাবগুলিকে কার্যকর করতে চায়নি। বিশেষত কমিটি তৈরির আগেই 1914 খ্রিস্টাব্দে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়। ফলে 1913 খ্রিস্টাব্দের শিক্ষাপ্রস্তাবগুলি আর বাস্তবায়িত করা সম্ভব হয়নি।

অন্যদিকে, 1910 খ্রিস্টাব্দে লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কাঠামাের পুনর্বিন্যাস করা হয়। স্বভাবতই এদেশেও বিশ্ববিদ্যালয় কাঠামােও পুনর্বিন্যাসের দাবি ওঠে। কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের তদানীন্তন উপাচার্য স্যার আশুতােষ মুখােপাধ্যায় বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার সকল স্তরের উন্নয়ন বিষয়ে সচেষ্ট হন। তিনি স্নাতকোত্তর শিক্ষার্থীদের পড়ানাের জন্য প্রফেসর, রিডার এবং লেকচারার নিয়ােগ করেন। বিভিন্ন বিষয় পড়ানাের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রধান অধ্যাপকের পদ (chair) সৃষ্টি করেন এবং স্নাতকোত্তর গবেষণার বন্দোবস্ত করেন। ইতিমধ্যে শিক্ষার দ্রুত প্রসারের ফলেই বিশ্ববিদ্যালয় কর্মসূচি, শিক্ষার মান, দায়িত্ব ও কর্তব্য এবং নানান স্তরের শিক্ষার মধ্যে সম্পর্ক ইত্যাদি বিষয়ে বিভিন্ন ধরনের সমস্যার সৃষ্টি হয়। সেই সময় মহাযুদ্ধের পরিস্তিতি (1917) ব্রিটিশদের অনুকূল হয়। তাই সরকার কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমস্যা সমাধানের উদ্দেশ্যে নতুন একটি কমিশন গঠনের সিদ্ধান্ত নেয়।

স্যাডলার কমিশনের রিপাের্ট তৎকালীন শিক্ষাব্যবস্থার ওপর বিশেষ প্রভাব বিস্তার করতে না পারলেও ভারতীয় শিক্ষার ইতিহাসে এই কমিশনের সুপারিশগুলির সুদূরপ্রসারী প্রভাব লক্ষ করা যায়। এই রিপাের্টকে ভারতীয় শিক্ষা সংস্কারের প্রথম পদক্ষেপরূপেও চিহ্নিত করা যায়। মি. মেহিউ (Mr. Mayhew) এই কমিশনের সুপারিশগুলিকে তথ্য ও পরামর্শের এক অফুরন্ত ভান্ডার বলে বর্ণনা করেছেন। স্যাডলার কমিশনের সুপারিশের বেশ কিছু উল্লেখযােগ্য প্রয়ােগ বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থাতেও দেখা যায়। এখানে কয়েকটি উল্লেখ করা হল一

(১) মাধ্যমিক শিক্ষার প্রসারণ: আমাদের দেশের মাধ্যমিক শিক্ষা দ্বাদশ শ্রেণি (10+2) পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছে।

(২) ত্রৈবার্ষিক স্নাতক স্তর প্রবর্তন: ত্রৈবার্ষিক স্নাতক স্তরের প্রবর্তন করা হয়েছে। স্নাতক স্তরে পাস এবং অনার্স দুটি পৃথক শিক্ষাক্রম চালু হয়েছে।

(৩) মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষার পৃথক সংস্থা গঠন: মাধ্যমিক এবং উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা পরিচালনার জন্য দুই পৃথক সংস্থা গঠন করা হয়েছে।

(৪) বহুমুখী পাঠক্রম প্রবর্তন: উচ্চমাধ্যমিক স্তরে বহুমুখী পাঠক্রম চালু করা হয়েছে।

(৫) স্বয়ংসিত শিক্ষা পরিচালনা ব্যবস্থার প্রচলন: মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক এবং বিশ্ববিদ্যালয় প্রত্যেকটিই স্বয়ংশাসিত সংস্থা হিসেবে পরিচালিত হয়।

(৬) পেশাভিত্তিক শিক্ষার প্রচলন: কারিগরিবিদ্যা, চিকিৎসাবিজ্ঞান, আইন ও বৃত্তি শিক্ষার ব্যাপক প্রচলন ঘটেছে।

তবে কমিশনের সব সুপারিশই এদেশে প্রয়ােগের উপযােগী নয়। যেমন—

  • আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয় নিঃসন্দেহে ভালাে। কিন্তু এইরকম একটি বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে তুলতে গেলে প্রচুর অর্থের প্রয়ােজন। ভারতবর্ষের মতো দরিদ্র দেশের অভিভাবকদের পক্ষে আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয়ের খরচ চালানাে সত্যিই অসম্ভব।

  • মাধ্যমিক ও ইন্টারমিডিয়েট পর্ষদ গঠনের ক্ষেত্রে সদস্য নির্বাচন যে সাম্প্রদায়িক নীতির প্রস্তাব কমিশনের রিপাের্টে ছিল, তা সমর্থনযােগ্য নয়।