প্রশ্নঃ “স্বেচ্ছা প্রণোদিতভাবে কেউ তার অধিকার পরিত্যাগ করলে পরে সে আর তা বলবৎ করতে পারে না”- এই উক্তিটি ব্যাখ্যা কর।

একজন সাপুড়ের আশ্বাসে এক ব্যক্তি স্বেচ্ছায় গোখরা সাপের ছোবল গ্রহণ করলো। কিন্তু এতে তার মৃত্যু হলো। এই স্বেচ্ছায় ছোবল গ্রহণের জন্য সাপুড়ে কি রেহাই পাবে? 

উত্তরঃ কারো সম্মতিক্রমে কোন কার্য সম্পাদিত হলে এবং এর ফলে কোন ক্ষতি হলে সম্মতিদানকারী কোন অভিযোগ করতে পারে না। এটা যে নীতির উপর প্রতিষ্ঠিত তাকে বলে ভলেন্টি নন্ ফিট্ ইনজুরিয়া। বাদী যে অধিকার স্বেচ্ছাপ্রণোদিতভাবে পরিত্যাগ করেছে সে অধিকার আর সে বলবৎ করতে পারে না। তাই মুষ্ঠিযুদ্ধে আহত হলে বা ডাক্তার অস্ত্রোপচার করলে টর্ট আইনে কাউকে দায়ী করা যায় না।

ভলেনটি নন ফিট ইনজুরিয়া মতবাদ প্রয়োগ কালে প্রাথমিক স্তরে যে প্রশ্নটি উঠে তা হলো সংশ্লিষ্ট কাজের ঝুঁকি সম্পর্কে বাদীর জানা ছিল কিনা এবং জ্ঞাতসারেই তার সম্মতি দিয়েছিল কিনা। কাজেই এ মতবাদ প্রতিষ্ঠিত করতে হলে বাদীর অবগতি ও সম্মতি প্রতিষ্ঠিত করতে হবে।

অবগতি (Knowledge): কোন কাজ কিরূপ ঝুঁকিপূর্ণ তা বাদীর সম্পূর্ণ জানা প্রয়োজন। কাজটি ঝুঁকিপূর্ণ না এর আনুষঙ্গিক বিষয়গুলি ঝুঁকিপূর্ণ তা বাদীকে জানতে হবে। এছাড়া ঝুঁকির মাত্রা ও এর পরিণতি সম্পর্কে জানার জন্য বাদীকে পরিণত বুদ্ধি-মত্তা সম্পন্ন হতে হবে। ঝুঁকিপূর্ণ কাজ বাদীর জানা থাকলেই চলবে না, বাদীর স্বাধীন সম্মতিও প্রয়োজন। স্মিথ বনাম বাকের মামলায় ঘটনায় জানা যায় যে, বাদী একটি ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত ছিল কিন্তু প্রয়োজনীয় মুহূর্তে বাদীকে সতর্ক করা হয় নাই। তাই এই নীতিটি সফল ভাবে প্রয়োগ করা যায় নাই, অর্থাৎ বাদী সেক্ষেত্রে জয়লাভ করে । রাস্তাপথে চলাফেরা করা কিছুটা ঝুঁকিপূর্ণ জেনেও সকলে চলাচল করে তাই বলে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি আইনগত প্রতিকার হতে বঞ্চিত হয় না।

প্রকৃত সম্মতি (Real Consent): বাদীর সম্মতি ব্যক্ত বা অব্যক্ত হতে পারে। ব্যক্ত সম্মতির ক্ষেত্রে সাধারণতঃ কোন সমস্যা হয় না। যে ব্যক্তি অন্যদের তার আঙ্গিনা দিয়ে চলাফেরা করতে অনুমতি দেয় সে ব্যক্তি পরে আর ট্রেসপাশের মামলা করতে পারে না । ব্যক্ত সম্মতির ক্ষেত্রেও বাদী জয়লাভ করতে পারে যদি বিবাদী অসতর্কভাবে বা ইচ্ছাকৃতভাবে বাদীর ক্ষতি সাধন করে। তাই মুষ্ঠিযুদ্ধে অংশ গ্রহণকারী সুস্পষ্ট সম্মতি দিলেও নিয়ম বিরুদ্ধ ও ইচ্ছাকৃত অন্যায় আঘাতের প্রতিকার পেতে পারে। নিয়ম অন্তুর্ভূক্ত মুষ্ঠির জন্য সম্মতি দেয়া থাকে, কিন্তু নিয়ম বহির্ভূত অন্যায় মুষ্ঠির জন্য কেউ সম্মতি দেয় না। অনুরূপভাবে অব্যক্ত (implied) সম্মতির ক্ষেত্রেও ইচ্ছাকৃত আঘাতের জন্য কারো সম্মতি থাকে না। তাই খেলার মাঠে দর্শক হিসেবে গেলেও বলের আঘাত লাগতে কোনো পারে এটা সকলের জানা। কাজেই একটা বল হঠাৎ করে কারো গায়ে এসে পড়লে তার জন্য কাউকে দায়ী করা যায় না। কিন্তু ইচ্ছাকৃতভাবে কেউ দর্শককে বলের আঘাত করলে সেক্ষেত্রে বাদীর সম্মতি ধরা যায় না। যাহোক প্রতিটি ক্ষেত্রে পরিস্থিতির আলোকে বিচার করতে হবে।

এছাড়া সম্মতি বাস্তব (real) ও স্বাধীন (free) হতে হবে। কোন নৈতিক ও আইনগত দায়িত্ব পালনে ঝুঁকি গ্রহণ, করলে সেক্ষেত্রে বাদীর প্রকৃত সম্মতি ধরা যায় না। তাই পথিমধ্যে এক ছোট মেয়েকে দুর্ঘটনা হতে রক্ষা করা নৈতিক কর্তব্য বিধায় কোন ব্যক্তি এরূপ কাজে প্রবৃত্ত হয়ে যদি ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তবে এতে তার প্রকৃত সম্মতি ছিল বলা যায় না। অনুরূপভাবে কোন পুলিশ কনষ্টেবল একটা দুরন্ত ঘোড়ার কবল থেকে কোন মহিলা ও তার সন্তানকে রক্ষা করার প্রচেষ্টায় আহত হলে তার কার্য স্বেচ্ছাপ্রণোদিত ও তার সম্মতি প্রকৃত তা বলা যায় না। স্বাধীন সম্মতি প্রদান সম্ভব যখন ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি স্বাধীনভাবে চিন্তা ভাবনার সুযোগ পায় এবং তার উপরে কোন বাধ্যবাধকতা থাকে না। তাই অবৈধ প্রভাব, ভীতি প্রদর্শন বা প্রতারণার মাধ্যমে সম্মতি আদায় করলে তা প্রকৃত সম্মতি হয় না।

সমস্যাটির সমাধানঃ স্বেচ্ছাপ্রণোদিতভাবে যদি কেউ কোন ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করে ক্ষতিগ্রস্ত হয় তবে ভলেন্টি নন্ ফিট্ ইনজুরিয়া নীতি অনুসারে তার এ ক্ষতির জন্য কাউকে দায়ী করতে পারে না। কিন্তু এ মতবাদ প্রয়োগ করতে হলে এটা প্রতিষ্ঠিত করতে হবে যে, বাদী ঝুঁকিপূর্ণ কাজ সম্পর্কে সম্পূর্ণ অবগত ছিল এবং জেনে শুনেই স্বেচ্ছায় স্বাধীনভাবে সে কাজে সম্মতি দিয়েছিল। বিষাক্ত এক সাপের ছোবল গ্রহণ করা নিঃসন্দেহে একটা বিপজ্জনক কাজ। বাদী সেই বিপজ্জনক কাজটি করেছে। সে ব্যক্তি যদি পরিণত বয়স্ক ও স্বাভাবিক জ্ঞানবুদ্ধিসম্পন্ন হয়ে থাকে তবে এর বিপদ সম্পর্কে অবগত থাকার কথা। কিন্তু সাপুড়ের আশ্বাসের ফলে যে সম্মতি দিয়েছে, সে সম্মতি স্বাধীন বা স্বেচ্ছামূলক বলা যায় না। কাজেই স্বাধীন সম্মতি এখানে অবর্তমান। এ ছাড়া যে ক্ষেত্রে বিবাদীর সাবধানতা অবলম্বন করা কর্তব্য সেক্ষেত্রে কর্তব্যে ব্যর্থতার দরুন বাদীর ক্ষতি হলে এ মতবাদটি প্রয়োগ করা যায় না। বিষাক্ত সাপের ছোবল কাউকে গ্রহণ করতে বললে সাপুড়ের জন্য এ বিষয়ে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা (যেমন বিষদাঁত উঠিয়ে ফেলা) কর্তব্য ছিল। এ কর্তব্য পালনে সাপুড়ে ব্যর্থ হয়েছে। কাজেই স্বেচ্ছায় ছোবল গ্রহণের অজুহাত উত্থাপন করে সাপুড়ে রেহাই পেতে পারে না।