প্রশ্নঃ নৈতিক অবধারণের স্বীকার্য সত্য কি? নৈতিক অবধারণের স্বীকার্য সত্য হিসেবে ইচ্ছার স্বাধীনতা আলােচনা কর।
অথবা, নৈতিকতার স্বীকার্য সত্য কি? নৈতিকতার স্বীকার্য সত্য হিসেবে ইচ্ছার স্বাধীনতা ব্যাখ্যা কর।
অথবা, স্বীকার্য সত্য কি? স্বীকার্য সত্য হিসেবে ইচ্ছার স্বাধীনতা আলােচনা কর।
ভূমিকাঃ নীতিবিদ্যা একটি মূল্যায়নধর্মী বিদ্যা হিসেবে নৈতিকতার বিচার বিশ্লেষণ করে থাকে। তার নৈতিক অবধারণ কাজের ভালাে-মন্দের বিচার করার জন্য কিছু স্বীকার্য সত্যের উপর নির্ভর করে। এ স্বীকার্য সত্যগুলাে কে মেনে না নিলে নৈতিক কাজের মূল্যায়ন করা সম্ভব নয়। নৈতিক অবধারণের অনেক স্বীকার্য সত্য রয়েছে তার মধ্যে ইচ্ছার স্বাধীনতা অনেক গুরুত্বপূর্ণ। নিম্নে ইচ্ছার স্বাধীনতা নিয়ে বিশদ আলােচনা করা হলাে-
নৈতিক অবধারণের স্বীকার্য সত্যঃ স্বীকার্য সত্য হলাে তাই যা বিনা বিচারে নিয়ম ব্যতিরেকে সরাসরি স্বীকার করে নেওয়া হয় এবং এ স্বীকার্য সত্য সম্পর্কে কেউ কোনাে প্রকার প্রশ্ন উত্থাপন করে না। একটি আদর্শনিষ্ঠ বিজ্ঞান হিসেবে নীতিবিদ্যা তার বিষয়বস্তুকে সুস্পষ্ট করতে কতকগুলাে নৈতিক নিয়ম বা সত্যকে বিনা বিচারে স্বকিার করে নেয়। নীতিশাস্ত্রে এ নিয়ম বা সূত্রগুলােকে নীতিবিদ্যার স্বীকার্য সত্য বরা হয়। নৈতিক অবধারণের স্বীকার্য সত্যগুলাে ব্যক্তির ব্যক্তিত্ব, ব্যক্তির বিচারবুদ্ধি, ব্যক্তির স্বাধীনতা, ইচ্ছার স্বাধীনতা, আত্মার অমরত্ব, ঈশ্বরের অস্তিত্ব, বিশ্বজগতের বৌদ্ধিক সংগঠন।
স্বীকার্য সত্য হিসেবে ইচ্ছার স্বাধীনতাঃ একজন মানুষের কাজের নৈতিক বিচার বিশ্লেষণ করা তখনই করা সম্ভব, যখন ঐ ব্যক্তি তার কর্ম সম্পাদনকালে নিজ ইচ্ছামতে কাজ সম্পাদন করতে পারবেন। পক্ষান্তরে, তার আচরণ যদি পূর্ববর্তী ঘটনার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়, তবে কাজের নৈতিক দায়িত্বও আর থাকে না। সুতরাং নৈতিক বিচারের ক্ষেত্রে ইচ্ছার স্বাধীনতা একটি স্বীকার্য সত্য।
দার্শনিক লিলি বলেন, “যাদের আচরণ পূর্ববর্তী ঘটনার দ্বারা অনিবার্যভাবে নিয়ন্ত্রিত ও নির্ধারিত হয়, তাদের আচরণের প্রশংসা বা নিন্দা করার মতাে অসংগতিপূর্ণ ব্যাপার কিছু হতে পারে যা।” কান্ট ইচ্ছার স্বাধীনতা সম্পর্কে বলেন, “ইচ্ছার স্বাধীনতাই হলাে নৈতিকতার ভিত্তি।” ইচ্ছার স্বাধীনতা সংক্রান্ত মতবাদ থেকে তিনটি মতবাদের সৃষ্টি যা নিম্নরূপঃ
(ক) নিয়ন্ত্রণবাদ;
(খ) অনিয়ন্ত্রণবাদ; ও
(গ) আত্মনিয়ন্ত্রণবাদ।
(ক) নিয়ন্ত্ৰণবাদঃ এ মতবাদের মূলকথা হলাে আমাদের ক্রিয়াকলাপ বাহ্যিক কিছু ক্রিয়াকলাপ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। অর্থাৎ, নিয়ন্ত্ৰণবাদ ইচ্ছার স্বাধীনতাকে অস্বীকার করে। এ মতবাদের সপক্ষে যে যুক্তিগুলাে আছে তা নিম্নরূপঃ
১. মনস্তাত্ত্বিক যুক্তিঃ আমাদের ইচ্ছা সর্বদা কামনা ও বাসনা দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। এ যুক্তি অনুসারে আমাদের মাঝে যখন কোনাে কামনার উদ্রেক হয় তখন সেই কামনায় আমাদের কার্যাবলিকে নিয়ন্ত্রণ করে। কাজেই দেখা যাচ্ছে মানুষের ইচ্ছার কোনাে স্বাধীনতা নেই।
২. জড়বাদী, ধর্ম বিষয়ক এবং সবেরবাদী যুক্তিঃ এ মতবাদেরও ইচ্ছার স্বাধীনতাকে অস্বীকার করা হয়। এ মতাবাদে বলা হয় জড়ই হচ্ছে জগতের আদিসত্তা ও মন মস্তিষ্কের উপবস্তু। কাজেই মনন স্বাধীনতা বলে কিছু নেই। আবার, ধর্মবিষয়ক যুক্তি অনুসারে, ঈশ্বর সর্বজ্ঞাতা এবং ঈশ্বরের পূর্বজ্ঞান ইচ্ছার স্বাধীনতার সঙ্গে অসঙ্গতিপূর্ণ। সর্বেশ্ববাদ অনুসারে, সর্বভূতে সর্বজায়গায় ঈশ্বর বিরাজ মন। মানুষের মধ্যেও ঈশ্বর বিরাজমান। মানুষ যা করে তা ঈশ্বরের ইচ্ছার বহিঃপ্রকাশ। তাই বলা যায় মানুষের ইচ্ছার কোনাে স্বাধীনতা নেই।
(খ) অনিয়ন্ত্রমণবাদঃ এ মতবাদ নিয়ন্ত্রণবাদের বিপরীতধর্মী মতবাদ। এ মতবাদ অনুসারে মানুষের ইচ্ছা ও মনন ক্ষমতা সম্পূর্ণ স্বাধীনতা যা কোনাে প্রকার বহিঃশক্তির দ্বারা নিয়ন্ত্রিত নয়। মানুষ নিজের ইচ্ছা অনুযায়ী যাবতীয় কার্যাবলি সম্পাদন করে। এ মতবাদের পক্ষে যুক্তিগুলাে নিম্নরূপ-
১. কার্যকারণ যুক্তিঃ এ যুক্তি অনুসারে পৃথিবীতে কোনাে ঘটনাই কারণ ছাড়া ঘটে না। এ অর্থে মানুষের ইচ্ছা যেহেতু একটি মানসিক ঘটনা তাই এর পিছনেও একটি কারণ আছে। যেহেতু মানসিক ঘটনাগুলাে কারণাধীন নেই।
২. মনস্তাত্ত্বিক যুক্তিঃ এ মতবাদ অনুসারে মানুষ নিজেই নিজের কর্তা; যে নিজের ইচ্ছা অনুসারে যাবতীয় কার্যাবলি সম্পাদন করে। এখানে কর্তা সম্পূর্ণ সচেতন থাকে, সে অন্যের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয় না। সুতরাং মানুষের ইচ্ছার স্বাধীনতা আছে।
৩. নৈতিক যুক্তিঃ এ যুক্তি অনুসারে মানুষ যখন অন্যের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়ে কাজ করে তখন সে কাজের জন্যে জবাবদিহিতা করতে হয় না। নৈতিক মূল্যায়ন তখনই করা সম্ভব যখন মানুষ স্বেচ্ছাপ্রণােদিত হয়ে কাজ করে। কাজেই এতেই বােঝা যায় ইচ্ছার স্বাধীনতা প্রয়ােজনীয়।
(গ) আত্মনিয়ন্ত্ৰণবাদঃ এ মতবাদ অনুসারে নিয়ন্ত্ৰণবাদ ও অনিয়ন্ত্ৰণবাদ কোনােটাই এককভাবে সমর্থযােগ্য নয়। আত্মনিয়ন্ত্ৰণবাদ অনুসারে আমরা যখন পুরােপুরি বাইরের শক্তি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হই না, তেমনি আবার সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবেও নিজেদের নিয়ন্ত্রণ করতে পারি না। এ মতবাদ অনুসারে মানুষ নিজেই নির্ধারণ করবে সে কোন কাজটি আগে করবে এবং কোন কাজটি পরে করবে। ফলে যখন অসংখ্য কামনার মধ্যে দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয় তখন মানুষের মনই দ্বন্দ্বের সমন্বয় সাধন করে স্বাধীনভাবে কাজটি করে।
সমালােচনাঃ নৈতিক স্বীকার্য সত্য হিসেবে ইচ্ছার স্বাধীনতা সংক্রান্ত মতবাদগুলাে বিভিন্নভাবে সমালােচিত হয়েছে তা নিম্নরূপ-
প্রথমত, নিয়ন্ত্রণবাদের পক্ষে প্রদত্ত মনস্তাত্ত্বিক যুক্তিটি গ্রহণযােগ্য নয়। কারণ মানুষের কর্মধারা সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করার অর্থ এই নয় যে, মানুষের ইচ্ছার স্বাধীনতা নেই।
দ্বিতীয়তঃ অনিয়ন্ত্রণবাদ নিয়ন্ত্রণবাদের মতাে ইচ্ছা বা সংকল্পের প্রকৃতি সম্পর্কে সঠিক কোনাে যুক্তি দেখাতে পারে নি। তাই এটিও ইচ্ছার স্বাধীনতা সম্পর্কে একটি চরম মতবাদ হিসেবে গ্রহণযােগ্য নয়।
উপসংহারঃ উপরিউক্ত আলােচনার প্রেক্ষিতে এটা বলা যায় যে, নৈতিক অবধারণ মানুষের ঐচ্ছিক ক্রিয়ার ভালাে মন্দ বিচার করে থাকে। তবে এ মূল্যায়ন তখনই সঠিক তবে যখনই ক্রিয়া সম্পাদনকারী স্বাধীনভাবে কার্যাবলি সম্পাদন করতে পারে। নৈতিক বিচারের স্বীকার্য সত্য হিসেবে ব্যক্তির ব্যক্তিত্ব, বিচারবুদ্ধি ও ইচ্ছার স্বাধীনতাকে মেনে না নিলে মানুষের ঐচ্ছিক ক্রিয়ার নৈতিক মূল্য নিরুপন করা সম্ভব নয়।
Leave a comment