স্বার্থগোষ্ঠী বিভিন্ন ধরনের হতে পারে, যেমন— ছাত্র সংসদ, শিক্ষা সংস্থা, শ্রমিক সংঘ, বণিকসভা প্রভৃতি। গোষ্ঠীগত বিশেষ স্বার্থ সংরক্ষণই হল এই সকল স্বার্থগোষ্ঠীর মূল লক্ষ্য। এই গোষ্ঠীগুলি সরকার বা সরকারী দলের আনুকূল্য লাভ করে গোষ্ঠীস্বার্থ রক্ষার চেষ্টা করে। আবার গোষ্ঠী স্বার্থ সাধনের চেষ্টায় স্বার্থগোষ্ঠী রাজনীতিক দল বা গোষ্ঠী বা তার অঙ্গ রূপে কাজ করে থাকে। তাই সরকারের সঙ্গে এই সকল গোষ্ঠীর সম্পর্ক স্বাভাবিক বা তিক্ত হতে পারে। তবে স্বার্থগোষ্ঠী সরকারী কার্যকলাপকে প্রভাবিত করে।

স্বার্থগোষ্ঠীর শ্রেণীবিভাজন সম্পর্কে বলের অভিমত:

সমাজে বিভিন্ন ধরনের বহু স্বার্থগোষ্ঠীর অস্তিত্ব পরিলক্ষিত হয়। তাই স্বার্থগোষ্ঠীসমূহের শ্রেণীবিভাজন গুরুত্বপূর্ণ বিবেচিত হয়। সাধারণত উদ্দেশ্য, সাংগঠনিক কাঠামো, কার্যপদ্ধতি প্রভৃতির পরিপ্রেক্ষিতে এই শ্রেণীবিভাজন করা হয়ে থাকে। এ প্রসঙ্গে অ্যালান বলের অভিমত প্রণিধানযোগ্য। Modern Politics and Government শীর্ষক গ্রন্থে তিনি বলেছেন: “Interest groups are usually divided into sub-categories such as business, labour, farmers and professional associations like those of doctors and lawyers. It is as well to remember that classification by ’cause’ or ‘interest’ is only one method of classification of pressure groups, and that the methods used by the groups, or the organisational structure of the groups provide other bases for classification.”

সাংগঠনিক ও প্রকৃতিগত বিচারে স্বার্থগোষ্ঠীসমূহের মধ্যে পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। অ্যালমণ্ড ও পাওয়েল Comparative Politics শীর্ষক গ্রন্থে স্বার্থগোষ্ঠীর শ্রেণীবিভাজন সম্পর্কে বিস্তারিতভাবে আলোচনা করেছেন। এই দুই আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানী স্বার্থগোষ্ঠীকে চারটি শ্রেণীতে বিভক্ত করেছেন। স্বার্থগোষ্ঠীর এই চারটি শ্রেণী হল: 

  • (ক) স্বতঃস্ফূর্ত স্বার্থগোষ্ঠী, 

  • (খ) সংগঠনভিত্তিক স্বার্থগোষ্ঠী, 

  • (গ) সংগঠনহীন স্বার্থগোষ্ঠী এবং 

  • (ঘ) প্রাতিষ্ঠানিক স্বার্থগোষ্ঠী।

(ক) স্বতঃস্ফূর্ত স্বার্থগোষ্ঠী:

সাধারণত কোন বিশেষ ঘটনাকে কেন্দ্র করে বা কোন নেতার আবির্ভাবের ফলে স্বতঃস্ফূর্ত স্বার্থগোষ্ঠীর উদ্ভব হয়। এই ধরনের স্বার্থগোষ্ঠী স্বতঃস্ফূর্তভাবে তাদের ধূমায়িত অভিযোগ-অসন্তোষকে ব্যক্ত করে। এবং এই গোষ্ঠী বিক্ষোভ, দাঙ্গা-হাঙ্গামা, গুপ্তহত্যা প্রভৃতির মাধ্যমে দেশের রাজনীতিক ব্যবস্থার উপর চাপ সৃষ্টি করে থাকে। এই রকম স্বার্থগোষ্ঠীকে স্বতঃস্ফূর্ত স্বার্থগোষ্ঠী বলে। এই রকম স্বার্থগোষ্ঠী সাধারণত জনতা বা উচ্ছৃঙ্খল জনতার কার্যপদ্ধতি অনুসরণ করে থাকে। রাজনীতিক ব্যবস্থায় স্বতঃস্ফূর্তভাবে এই সব গোষ্ঠী প্রবেশ করে। এই সব স্বার্থগোষ্ঠী হল ব্যক্তিগত প্রতিনিধিত্বের ধরনের। বিশেষ কোন দাবি দীর্ঘকাল ধরে উপেক্ষিত হতে থাকলে কোন ঘটনাকে কেন্দ্র করে তার সহিংস বহিঃপ্রকাশ ঘটতে পারে এবং ঘটে। সুসংগঠিত স্বার্থগোষ্ঠী না থাকলে অথবা তার সংখ্যা কম হলে কোন বিশেষ ঘটনার সুযোগে প্রথাহীনভাবে হিংসাত্মক কাজকর্ম সংঘটিত হয়। তবে সুসংগঠিত স্বার্থগোষ্ঠী থাকলে এবং তাদের সংখ্যা অধিক হলে স্বতঃস্ফূর্ত স্বার্থগোষ্ঠীর আবির্ভাব ঘটবে না, তা জোর দিয়ে বলা যায় না।

সকল দেশের রাজনীতিক ব্যবস্থায় অল্পবিস্তর এ ধরনের স্বার্থগোষ্ঠীর সাক্ষাৎ পাওয়া যায়। ভারতের রাজনীতিক ব্যবস্থায়ও এ রকম হিংসাত্মক গোষ্ঠীর অস্তিত্বকে একেবারে অস্বীকার করা যায় না। তবে মধ্যপ্রাচ্যের দেশসমূহে এ রকম গোষ্ঠী বেশী দেখা যায়।

(খ) সংগঠনভিত্তিক স্বার্থগোষ্ঠী:

সংগঠনভিত্তিক স্বার্থগোষ্ঠী হল নিজেদের স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট দাবি-দাওয়া পেশ করার জন্য এক বিশেষজ্ঞ গোষ্ঠী। স্বার্থের গ্রন্থীকরণ (articulation) -এর জন্য বিশেষজ্ঞ ব্যক্তিদের নিয়ে এ ধরনের স্বার্থগোষ্ঠী গঠিত হয়। এই সব স্বার্থগোষ্ঠীর সর্বক্ষণের জন্য নিজস্ব পেশাদার কর্মী থাকে। তারা গোষ্ঠীস্বার্থের প্রতিনিধিত্ব করে এবং নির্দিষ্ট পদ্ধতির মাধ্যমে সুসংহতভাবে দাবি-দাওয়া পেশ করে। এদের কর্মসূচী ও কর্মপদ্ধতির পিছনে জনসাধারণের কোন কোন অংশের সমর্থন থাকে, এবং এই স্বার্থগোষ্ঠীগুলি দেশের রাজনীতিক ব্যবস্থার উপর উল্লেখযোগ্য প্রভাব বিস্তার করতে পারে।

এই ধরনের স্বার্থগোষ্ঠীর উদাহরণ হিসাবে শ্রমিক সংঘ, বণিক সংঘ, শিল্পপতিদের সংগঠন, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান প্রভৃতির কথা বলা যায়। আধুনিক রাজনীতিক ব্যবস্থায় এই সমস্ত স্বার্থগোষ্ঠীর ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সমাজের বিভিন্ন অংশের স্বার্থের সংহতি সাধনের ক্ষেত্রে এই সমস্ত গোষ্ঠীর ভূমিকার গুরুত্ব অনস্বীকার্য। বিভিন্ন স্বার্থের গ্রহন বা সংহতি সাধনের প্রক্রিয়া এই সমস্ত গোষ্ঠীর মাধ্যমেই সম্পাদিত হয়ে থাকে। যে-কোন রাজনীতিক ব্যবস্থায় সংগঠনভিত্তিক স্বার্থগোষ্ঠীসমূহ রাষ্ট্রীয় আইনের স্বীকৃতি পেয়ে থাকে।

(গ) সংগঠনহীন স্বার্থগোষ্ঠী:

জাতিগত, বংশগত, শ্রেণীগত, ভাষাগত প্রভৃতি যে সমস্ত স্বার্থগোষ্ঠী দেখা যায় সেগুলি হল সংগঠনহীন স্বার্থগোষ্ঠী। মর্যাদা এবং শ্রেণী ভিত্তিক গোষ্ঠীগুলিও সংগঠনহীন স্বার্থগোষ্ঠীর পর্যায়ভুক্ত। এই সমস্ত স্বার্থগোষ্ঠী যথাযথভাবে সংগঠিত নয়। স্বার্থের গ্রন্থীকরণের জন্য এদের কোন সংগঠিত পন্থা-পদ্ধতি থাকে না। এই সমস্ত গোষ্ঠীর আভ্যন্তরীণ কাঠামোর ক্ষেত্রেও তেমন কোন নিরবচ্ছিন্নতা পরিলক্ষিত হয় না। কিছু ব্যক্তি বা পরিবারের মাধ্যমে এরা নিজেদের স্বার্থযুক্ত কাজকর্ম পরিচালনার চেষ্টা করে। যাইহোক, দেশের রাজনীতিক ব্যবস্থার উপর এ ধরনের স্বার্থগোষ্ঠীর প্রভাব তেমন একটা কার্যকরী হয় না।

(ঘ) প্রাতিষ্ঠানিক স্বার্থগোষ্ঠী:

প্রাতিষ্ঠানিক স্বার্থগোষ্ঠী গঠিত হয় কোন পেশা বা বৃত্তিভুক্ত ব্যক্তিদের নিয়ে। এ ধরনের স্বার্থগোষ্ঠী তার নিজের সদস্যদের বা অন্য যে-কোন গোষ্ঠীর স্বার্থ সাধনে উদ্যোগী হতে পারে। সাংগঠনিক ক্ষমতাবলে এই সমস্ত স্বার্থগোষ্ঠী দেশের রাজনীতিক ব্যবস্থায় তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করে থাকে। আইনসভা, রাজনীতিক দল, সৈন্যবাহিনী, আমলাতন্ত্র প্রভৃতির মধ্যে এ রকম স্বার্থগোষ্ঠীর অস্তিত্ব পরিলক্ষিত হয়। সংগঠনভিত্তিক স্বার্থগোষ্ঠীর প্রভাব-প্রতিপত্তি কম হলে প্রাতিষ্ঠানিক স্বার্থগোষ্ঠীর প্রভাব বৃদ্ধি পেতে দেখা যায়। স্বার্থের গ্রন্থীকরণ ছাড়াও প্রাতিষ্ঠানিক স্বার্থগোষ্ঠীর সামাজিক ও রাজনীতিক দায়িত্ব বা ভূমিকা থাকে। অন্যান্য স্বার্থগোষ্ঠীর মত প্রাতিষ্ঠানিক স্বার্থগোষ্ঠীর উদ্দেশ্য সরকারের কাছে দাবি-দাওয়া পেশ করা নয়।