ভূমিকা: স্বাধীন ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী পণ্ডিত জওহরলাল নেফ্লুর সক্রিয় উদ্যোগে দেশে বিভিন্ন সমাজতান্ত্রিক পদক্ষেপ গৃহীত হয়। ফলে ধনী ভূস্বামীদের ওপর বিভিন্ন বিধিনিষেধ আরােপিত হয়। দেশে জমিদারি প্রথার অবসান ঘটে, ভূস্বামীদের ব্যক্তিগত সম্পত্তির উর্ধ্বসীমা বেঁধে দেওয়া হয়, ধনীদের সম্পদ ও আয়ের ওপর কর আরােপিত হয়, বিভিন্ন ধনবান অর্থনৈতিক সংস্থা জাতীয়করণ হয় ইত্যাদি। অন্যদিকে দরিদ্র শ্রেণিকে বিভিন্ন অর্থনৈতিক সুযােগসুবিধা দেওয়া হয়।

[1] মার্কসবাদী সমাজতন্ত্র নয়: সংবিধানে ভারতবর্ষকে সমাজতন্ত্র বলে অভিহিত করা হয়েছে। তবে ভারতে কোনােভাবেই সােভিয়েত রাশিয়া বা চিনের মতাে মার্কসীয় সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়নি। ভারতের সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক কর্মসূচি খুবই অপ্রতুল, রাশিয়া বা চিনের মতাে অর্থনৈতিক সাম্য ভারতে প্রতিষ্ঠিত হয়নি।

[2] জমিদারি প্রথার দৌরাত্ম্য: ভারত সরকার জমিদারি প্রথার বিলােপ ঘােষণা করলেও ঘুরপথে জমিদারি প্রথার দৌরাত্ম্য অব্যাহত থাকে। সরকার জমিদারদের ব্যক্তিগত সম্পত্তির ওপর মৌলিক অধিকারের বিষয়টি প্রায় স্বীকার করে নেয়। ফলে জমিদাররা যে জমি হারায় তার বিনিময়ে সরকার তাদের আর্থিক ক্ষতিপূরণ দেওয়ার উদ্যোগ নেয়। তা ছাড়া জমিদাররা ব্যক্তিগত চাষের জমি হিসেবে যথেষ্ট পরিমাণ জমি নিজেদের দখলে রাখতে সক্ষম হয়।

[3] জমির ঊধর্বসীমা আইন লঙ্ঘিত: সংবিধান সংশােধনের মাধ্যমে স্বাধীন ভারত সরকার ১৯৫১ ও ১৯৫৫ খ্রিস্টাব্দে আইন প্রণয়ন করে জমিদারি প্রথা বিলুপ্তির পর ১৯৬১ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে বিভিন্ন রাজ্যে ব্যক্তিগত অধীনে সর্বোচ্চ কী পরিমাণ জমি রাখা যাবে, সে বিষয়ে আইন পাস করা হয়। কিন্তু বাস্তবে বহুক্ষেত্রেই সেই আইন কার্যকরী হয়নি। জমিদাররা আইনের ফাঁক দিয়ে নামে-বেনামে বা নিজের আত্মীয়স্বজনদের মধ্যে ভাগ করে দিয়ে বিপুল পরিমাণ জমি নিজেদের অধিকারে রাখতে সক্ষম হয়। তা ছাড়া পাঁচ জনের বেশি সদস্যবিশিষ্ট পরিবারগুলির জমির ঊর্ধ্বসীমা অনেকটা বাড়িয়ে দেওয়া হয়। ফলে বিপুল পরিমাণ জমি জমিদার পরিবারগুলির হাতে থেকে যায়, যা দরিদ্র মানুষের মধ্যে বিতরণ করা উচিত ছিল।

[4] দরিদ্র কৃষকদের ক্ষতি: জমিদারি প্রথার উচ্ছেদের ফলে ধনী ও মাঝারি কৃষকরা কিছুটা লাভবান হলেও এতে দরিদ্র প্রান্তিক কৃষকদের কোনাে লাভ হয়নি। তা ছাড়া ভূমিসংস্কারের অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল করভার লাঘব করা। কিন্তু বাস্তবে অধিকাংশ রাজ্যেই কৃষকরা অন্তত ২০ থেকে ২৫ শতাংশ এবং কোনাে কোনাে রাজ্যে আরও বেশি উৎপাদন কর দিতে বাধ্য হয়েছিল।

[5] উৎপাদন ব্যাহত: জমিদারি প্রথার বিলােপ ঘটানাে হলেও বহুক্ষেত্রেই দরিদ্র কৃষকদের মধ্যে সঠিক ভূমিবনণ্টন হয়নি। ফলে বিভিন্ন পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় কৃষি উৎপাদন তার লক্ষ্যমাত্রা পূরণে ব্যর্থ হয়। খাদ্য উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা স্পর্শ করতে ব্যর্থ হলে বাইরে থেকে খাদ্য আমদানি করতে হয়।

[6] সমবায় প্রথার বিরােধিতা: কৃষি সমস্যা সমাধানের জন্য সরকার সমবায় প্রথায় চাষের প্রস্তাব বিবেচনা করলে দেশের উচ্চবিত্ত ও মাঝারি কৃষকরা প্রতিবাদ করে। কেননা, সমবায় প্রথায় চাষ শুরু হলে জমিতে ব্যক্তিগত অধিকার বিলুপ্ত হওয়ার সম্ভাবনা ছিল। ফলে কৃষিক্ষেত্রে সমবায় প্রথা চালু করে কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি করা সম্ভব হয়নি।

[7] ব্যক্তিগত সম্পত্তির অধিকার: বৈজ্ঞানিক সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার মূল ভিত্তি হল, দেশের নাগরিকদের সমস্ত ব্যক্তিগত সম্পত্তির অবসান ঘটানাে। কিন্তু ভারতে ব্যক্তিগত সম্পত্তির অধিকারের বিলােপ না ঘটিয়ে এই অধিকারকে একটি গুরুত্বপূর্ণ মৌলিক অধিকার বলে সংবিধানে স্বীকার করা হয়েছে। ফলে ভারতে বিপুল পরিমাণ ব্যক্তিগত সম্পত্তির মালিক ধনীদের সঙ্গে ভূমিহীন কোটি কোটি দরিদ্রের তীব্র বৈষম্য অব্যাহত রয়েছে।

উপসংহার: ভারতে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য সর্বাগ্রে প্রয়ােজন ছিল, রাজনৈতিক ও সামাজিক সাম্য প্রতিষ্ঠা করা। কিন্তু এদেশে নাগরিকদের অর্থনৈতিক সাম্য প্রতিষ্ঠিত না হওয়ায় রাজনৈতিক ও সামাজিক সাম্য প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হয়নি।