সূচনা: স্বাধীন ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী পণ্ডিত জওহরলাল নেহরু সদ্য স্বাধীন ভারতের বিধ্বস্ত অর্থনীতিকে মজবুত করার উদ্দেশ্যে বিভিন্ন পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা (১৯৫১-৫৬ খ্রি.) মােটামুটিভাবে সফল হওয়ার পর দ্বিতীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনাও ভারতের অর্থনৈতিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিল।
[1] রূপরেখা: ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিসটিক্যাল ইনস্টিটিউট-এর প্রখ্যাত পরিসংখ্যানবিদ প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশ (১৮৯৩-১৯৭২খ্রি.) রাশিয়ার পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার অনুকরণে ১৯৫৫ খ্রিষ্টাব্দে দ্বিতীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার একটি রূপরেখা বা মডেল তৈরি করেন। প্রধানমন্ত্রী নেহরু কিছু সংশােধনের পর এই রূপরেখা প্রয়ােগ করেন। এই মডেল ‘নেহরু মহলানবিশ মডেল’ নামে পরিচিত।
[2] লক্ষ্য: দ্বিতীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার লক্ষ্য গুলি হল―
-
[i] ভারতবাসীর জীবনযাত্রার মানােন্নয়নের উদ্দেশ্যে জাতীয় আয় ২৫ শতাংশ বৃদ্ধি করা।
-
[ii] সরকারি উদ্যোগে ভারী ও যন্ত্রপাতি নির্মাণশিল্পের ওপর গুরুত্ব দিয়ে শিল্পায়ন ত্বরান্বিত করা।
-
[iii] ভারী শিল্প প্রতিষ্ঠার জন্য বিদেশ থেকে কারিগরি ও আর্থিক সহায়তা গ্রহণ করা।
-
[iv] অন্তত ১ কোটি কর্মসংস্থানের সুযােগ সৃষ্টি করা।
-
[v] ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্পের বিকাশ ঘটানাে।
-
[vi] আয় ও সম্পদের বণ্টনে সমতা এনে অর্থনৈতিক বৈষম্য হ্রাস করা।
-
[vii] অর্থনৈতিক ক্ষমতা বণ্টনে ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা করা।
[3] পদক্ষেপ: দ্বিতীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার উদ্যোগগুলি বাস্তবায়িত করার জন্য ব্যয় ধরা হয় ৪,৮০০ কোটি টাকা। এর মধ্যে ৮০০ কোটি টাকা বিদেশি সাহায্য হিসেবে নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়।
[4] সাফল্য: দ্বিতীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার সাফল্যগুলি হল―
-
[i] জাতীয় আয় প্রায় ২০ শতাংশ বৃদ্ধি পায়।
-
[ii] বিদ্যুৎ উৎপাদনও যথেষ্ট বাড়ে।
-
[iii] দুর্গাপুর, ভিলাই ও রাউরকেল্লায় ইস্পাত কারখানা স্থাপিত হয়।
-
[iv] ভারী ইঞ্জিনিয়ারিং ও যন্ত্রপাতি নির্মাণশিল্পের সূচনা হয়। তবে মােটের ওপর এই পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার সাফল্য আশানুরূপ হয়নি।
[5] ত্রূটি: দ্বিতীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার ত্রূটি গুলি হল―
-
[i] আর্থিক সংকটের কারণে এই পরিকল্পনার মাঝপথে ব্যয়ের পরিমাণ কমিয়ে ৪,৬০০ কোটি টাকা করা হয়।
-
[ii] কৃষি উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রায় পৌছােতে ব্যর্থ হয়। খাদ্য উৎপাদনও লক্ষ্যমাত্রা স্পর্শ করতে পারেনি।
-
[iii] কয়লা, ইস্পাত ও সিমেন্ট উৎপাদনও তার লক্ষ্যমাত্রায় পৌছােতে পারেনি। পাট, তুলা ও তৈলবীজ উৎপাদন যথেষ্ট ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল।
-
[iv] ভারতের জাতীয় আয়ের বৃদ্ধি ছিল লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৫ শতাংশ কম।
-
[v] এই পরিকল্পনার সময়কালে দ্রব্যমূল্য যথেষ্ট বৃদ্ধি পাওয়ায় মুদ্রাস্ফীতি দেখা দেয়।
-
[vi] ১ কোটি বেকারের কর্মসংস্থানের যে লক্ষ্যমাত্রা ছিল তা-ও পূরণ হয়নি।
-
[vi] এই পরিকল্পনার শেষে মহলানবিশ কমিটির (১৯৬১ খ্রি.) রিপাের্টে বলা হয়েছিল যে, সমাজের মুষ্টিমেয় উচ্চশ্রেণির মানুষ এই পরিকল্পনার দ্বারা উপকৃত হয়েছিল। এতে সাধারণ দরিদ্র মানুষের কোনাে উপকার হয়নি।
[6] গুরুত্ব: কিছু ব্যর্থতা সত্ত্বেও দ্বিতীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ ছিল। উদাহরণ স্বরূপ―
-
[i] দ্বিতীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার মাধ্যমে দুর্গাপুর, ভিলাই ও রাউরকেল্লায় ইস্পাত কারখানা নির্মিত হয়।
-
[ii] এই পরিকল্পনায় শক্তি উৎপাদন যথেষ্ট বৃদ্ধি পায়।
-
[iii] ভারী শিল্প ও শিল্পপ্রযুক্তির অগ্রগতিও সন্তোষজনক হয়।
-
[iv] অন্তত ৯০ লক্ষ মানুষের কর্মসংস্থান হয়।
-
[v] বিদ্যুৎ উৎপাদন, রেল ও সড়ক পরিবহণ, জাহাজ ও বিমান চলাচল প্রভৃতি ক্ষেত্রে যথেষ্ট অগ্রগতি ঘটে।
-
[vi] দেশে স্কুল কলেজের সংখ্যা অনেক বৃদ্ধি পায়।
-
[vii] বহু স্থানে নতুন নতুন চিকিৎসাকেন্দ্র গড়ে ওঠে। এক কথায়, দেশের দীর্ঘকালীন অর্থনৈতিক বিকাশের ভিত্তি সুদৃঢ় হয়।
Leave a comment