১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে যখনশ স্বাধীন হল তখন ভারতে শিক্ষিতের হার ছিল মাত্র ১৫%। শুধুমাত্র বয়স্কদের কথা ধরলে এই সংখ্যা দাড়ায় ১০% । অর্থাৎ প্রাপ্তবয়স্ক নাগরিক, যারা দেশের দায়িত্ব গ্রহণ করবে তাদের ৯০% লােক নিরক্ষর। ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দে থেকে এই বিশাল সংখ্যক নিরক্ষর মানুষকে শিক্ষিত করার জন্য সর্বভারতীয় পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। বয়স্কশিক্ষা হল এই শিক্ষা পরিকল্পনার একটি উজ্জ্বল দিক।

শুধুমাত্র বয়স্কদের অক্ষরজ্ঞান করালেই চলবে না, এর সঙ্গে আরও কতগুলো বিষয় জানা দরকার। তাই ভারত সরকার বয়স্ক শিক্ষা অভিযানের অঙ্গ স্বরূপ আরও কতগুলো বিষয় সম্পর্কে বয়স্কদের অবহিত করার পরিকল্পনা করেছে। এরকম পাঁচটি বিষয় হল— (১) নিরক্ষরতা দূরীকরণ, (২) স্বাস্থ্যবিজ্ঞান, (৩) বয়স্কদের অর্থনৈতিক অবস্থার মান উন্নয়নের জন্য প্রয়োজনীয় শিক্ষাদান, (৪) নাগরিকতাবোধ এবং (৫) আমাদের-প্রসাদের ব্যবস্থা।

আবুল কালাম আজাদের বক্তব্য

১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দে তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী মৌলানা আবুল কালাম আজাদ এলাহাবাদের একটি জনসভায় ঘোষণা করেন যে, বয়স্কদের শিক্ষাদানের উদ্দেশ্য কেবলমাত্র অক্ষর পরিচয় এর মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলে চলবে না, তাদেরকে এমন শিক্ষা দিতে হবে যাতে তারা যোগ্য নাগরিক হিসেবে সমাজ ও জাতির প্রতি নিজেদের দায়িত্ব পালন করতে পারেন। তাই বয়স্ক শিক্ষার কর্মপ্রচেষ্টা নিরক্ষরতা দূরীকরণের অভিযান না বলে এর নাম দেওয়া হয়েছে সামাজিক শিক্ষা। পূর্বে বয়স্ক শিক্ষা ছিল শুধুমাত্র নিরক্ষরতা দূর করার চেষ্টা কিন্তু এখনকার পরিকল্পনা হলো প্রতিটি ব্যক্তিকে সামাজিক করে তোলা।

দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বিহার, অসম ও মধ্যপ্রদেশের কয়েকটি নির্দিষ্ট অঞ্চলে ব্যাপকভাবে নিরক্ষরতা দূরীকরণের অভিযান শুরু হয়। কিন্তু কিছুদিন পরেই কার্যসূচির পরিবর্তন করে বয়স্কদের শিক্ষার উপর জোর দেওয়া হয়। যেখানে প্রাপ্তবয়স্করা আগ্রহ দেখাবে সেখানেই বয়স্ক শিক্ষা কেন্দ্র বা ক্লাস খোলা হবে। এ ব্যবস্থায় বছরে গড়ে ৫০,০০০ হাজার ক্লাস হয়েছে এবং ছাত্রসংখ্যা হয়েছে ১২ লক্ষ। এজন্য বছরে প্রায় ৪০ লক্ষ টাকা খরচ হচ্ছে।

কেন্দ্রীয় সরকার কর্তৃক গৃহীত ব্যবস্থা

কেন্দ্রীয় সরকার বয়স্কদের শিক্ষার সুবিধার্থে যেসকল ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে তা হল –

(১) বয়স্কদের জন্য আকর্ষণীয় নতুন নতুন বই প্রকাশ করেছে।

(২) ভালো বইয়ের জন্য বাৎসরিক প্রতিযোগিতা ব্যবস্থা করেছে।

(৩) এনসাইক্লোপিডিয়া প্রকাশের ব্যবস্থা করেছে। 

(৪) পাঠাগার প্রতিষ্ঠার ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে।

১৯৭৮ খ্রিস্টাব্দে সরকার ১০ কোটি বয়স্ককে ৫ বছরের মধ্যে শিক্ষিত করার কথা ঘোষণা করে। কিন্তু পরে লক্ষ্যমাত্রা কমিয়ে ২ কোটি ৫০ লক্ষ করা হয়।

১৯৮০-৮১ খ্রিস্টাব্দে ২৪ লক্ষ ও ১৯৮১-৮২ খ্রিস্টাব্দে ৩২ লক্ষ বয়স্ক ব্যক্তিকে শিক্ষিত করা হয়।

প্ৰথম-চতুর্থ পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা

প্রথম-চতুর্থ পবার্ষিকী পরিকল্পনার সময় বয়স্ক শিক্ষাকে সামাজিক শিক্ষা বলা হত। এই সময় বয়স্ক শিক্ষাখাতে খুব অল্প অর্থ বরাদ্দ করা হয়।

পঞম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা

কি পরিকল্পনা চলাকালীন সারা ভারতে ২৪ তম বয়স্ক শিক্ষা সম্মেলনে বিধি মুক্ত বয়স্ক শিক্ষার উপর গুরুত্ব দেওয়া হয়। পঞ্চম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার শেষের দিকে ১৯৭৮ খ্রিস্টাব্দের ২ অক্টোবর একটি জাতীয় বয়স্ক শিক্ষা কর্মসূচি কাজ শুরু হয়। এইসময় থেকেই সামাজিক শিক্ষার’ বদলে বয়স্ক সাক্ষরতা শব্দটি ব্যবহৃত হয়। বয়স্ক শিক্ষার উদ্দেশ্য হল 3R (পঠন, লিখন, গণিত) শেখানো।

ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা

এই পরিকল্পনায় বয়স্ক শিক্ষার জন্য ৬৪ কোটি টাকা অর্থাৎ বছরে প্রায় ১৩ কোটি টাকা ধার্য করা হয়। কিন্তু রাজ্যগুলির আগ্রহের অভাব আশানুরূপ ফল পাওয়া যায়নি। প্রথম দু-বছরে মিলিয়ে খরচ হয়েছিল প্রায় ১২ কোটি টাকা। উপর থেকে চাপ আসায় সেই খরচ বেড়ে দাড়ায় ১৯৮২-৮৩ খ্রিস্টাব্দে ১৫ কোটি টাকা। একমাত্র কেরালা বরাদ্দ অর্থের ৯৪% খরচ করেছে। পশ্চিমবাংলা খরচ করেছে বরাদ্দ অর্থের মাত্র ৫০%। ষষ্ঠ পরিকল্পনা বয়স্ক শিক্ষার জন্য যেসকল প্রস্তাব গৃহীত হয়, তা হল –

(A) বর্তমানে পরিচালিত কর্মসূচি গুলো চালু থাকবে এবং গুলি আরও সমৃদ্ধ করতে হবে। যেমন— (১) কৃষকদের কার্যকরী সাক্ষরতা কর্মসূচি, (২) শ্রমিক বিদ্যাপীঠ এবং বয়স্ক শিক্ষাকেন্দ্র স্থাপন, (৩) নেহরু যুব কেন্দ্র স্থাপন, (৪) জাতীয় পরিষেবা কর্মসূচি, (৫) বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বয়স্ক শিক্ষা প্রচলন, (৬) সংস্থাগুলিকে সহযােগিতা।

(B) ১৫-৩৫ বছর বয়স্ক ব্যক্তিদের উপর বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া।

(C) অবহেলিত এবং দারিদ্র্যসীমার নিচে অবস্থিত জনগণের শিক্ষার প্রতি বিশেষ গুরুত্ব প্রদান।

(D) বয়স্ক শিক্ষা কর্মসূচিকে সফল করে তোলার জন্য বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা, প্রতিষ্ঠান, আগ্রহী ব্যক্তি, অবসরপ্রাপ্ত ব্যক্তি, শিক্ষক, শিক্ষার্থী সকলকে সঠিকভাবে ব্যবহার করতে হবে।

(E) কেন্দ্রীয় স্তরে বয়স্ক শিক্ষার জাতীয় বোর্ড অনুকরণে রাজ্য, জেলা, ব্লক এবং স্থানীয় কমিউনিটি স্তরেও উপযুক্ত সংস্থা গঠন করতে হবে।

প্রথম থেকে ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার মাধ্যমে সরকার বয়স্ক শিক্ষার্থীদের শিক্ষার প্রতি আগ্রহ কে উদ্দীপিত করে তাদের আত্মপ্রত্যয়ী অনেকখানি বাড়িয়ে দিয়েছে।