সূচনা: ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে স্বাধীনতা লাভের পর শিল্পায়নের জন্য আধুনিক প্রযুক্তিবিদ্যার প্রসারের বিশেষ প্রয়ােজন অনুভূত হয়।। ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী এ বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেন।
[1] নেহরুর ভূমিকা: জওহরলাল নেহরু উপলদ্ধি করেছিলেন যে, আধুনিক বৈজ্ঞানিক প্রযুক্তিবিদ্যার অগ্রগতির ওপর স্বাধীন ভারতের শিল্পায়নের অগ্রগতি নির্ভর করছে। প্রযুক্তির উন্নতির জন্য তিনি সক্রিয় উদ্যোগ গ্রহণ করেন। নেহরুর উদ্যোগে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির বিষয়ে গবেষণার জন্য প্রায় ৫০টি জাতীয় গবেষণাগার প্রতিষ্ঠিত হয়।
[2] বিজ্ঞানীদের ভূমিকা: ভারতে প্রযুক্তির উন্নতির ক্ষেত্রে বিভিন্ন বিজ্ঞানী গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। এই বিজ্ঞানীদের মধ্যে অন্যতম হলেন প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশ, হােমি জাহাঙ্গির ভাবা, ড. বিক্রম সারাভাই এবং শান্তিস্বরূপ ভাটনগর। হােমি ভাবার উদ্যোগে ভারতে টাটা ইন্সটিটিউট অব ফান্ডামেন্টাল রিসার্চ’, ‘অ্যাটমিক এনার্জি কমিশন অব ইন্ডিয়া’ স্থাপিত হয়।
[3] কৃষি প্রযুক্তি: ভারতে কৃষি প্রযুক্তির উন্নতির ক্ষেত্রে বিভিন্ন উদ্যোগ নেওয়া হয়। এ বিষয়ে অসামান্য অবদান রাখেন বিজ্ঞানী সি. সুব্রন্থনিয়াম। তিনি গবেষণাগারে উন্নততর কৃষিবীজ তৈরি করে কৃষি উৎপাদন যথেষ্ট বৃদ্ধি করেন। জলসেচের ব্যাপক প্রসারের ফলে ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৯৬২ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে অতিরিক্ত ৪৫ মিলিয়ন কৃষিজমি জলসেচের আওতায় আসে। খাদ্য উৎপাদনও ৩৪ মিলিয়ন মেট্রিক টন বৃদ্ধি পায়।
[4] ইন্ডিয়ান ইন্সটিটিউট অব টেকনােলজি: ভারতে প্রযুক্তিশিক্ষার প্রসারের উদ্দেশ্যে এন.আর.সরকারের সভাপতিত্বে ২২ সদস্যবিশিষ্ট একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠিত হয়। এই কমিটি আমেরিকার ‘মাসাচুসেটস ইন্সটিটিউট অব টেকনােলজি’-র অনুকরণে ‘ইন্ডিয়ান ইন্সটিটিউট অব টেকনােলজি’ প্রতিষ্ঠার পক্ষে অভিমত দেয়। সেই অনুসারে তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী মৌলানা আবুল কালাম আজাদ ১৯৫১ খ্রিস্টাব্দে (১৮ আগস্ট) পশ্চিমবঙ্গের খড়গপুরে এই প্রতিষ্ঠান স্থাপন করেন। পরবর্তীকালে মাদ্রাজ, বােম্বাই, কানপুর ও দিল্লিতে আই. আই. টি. প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রযুক্তির উন্নতি বিষয়ে গবেষণার উদ্দেশ্যে মধ্যপ্রদেশের ইন্দোরে ১৯৮৪ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত হয় Centre for Advanced Technologies বা CAT.
[5] মহাকাশ ও পরমাণু গবেষণা: মহাকাশ গবেষণায় অগ্রগতির উদ্দেশ্যে সােভিয়েত ইউনিয়নের সহযােগিতায় ১৯৬০-এর দশকের শুরুতে ‘ভারতীয় মহাকাশ গবেষণা সংস্থা’ (Indian Space Research Organization) গড়ে তােলা হয়। ভারতের মহাকাশ গবেষণা কর্মসূচিতে অসামান্য অবদান রাখেন পদার্থবিদ ড. বিক্রম সারাভাই। এজন্য তাকে ভারতের মহাকাশ কর্মসূচির জনক’ বলা হয়। সােভিয়েত রাশিয়ার সহযােগিতায় ভারতে পরমাণু শক্তি গবেষণার ক্ষেত্রেও যথেষ্ট অগ্রগতি ঘটে। ভারত ১৯৭৪ খ্রিস্টাব্দে (১৮ মে) রাজস্থানের পােখরানে প্রথম পারমাণবিক বােমার বিস্ফোরণ ঘটায়।
[6] প্রতিরক্ষা প্রযুক্তি: স্বাধীনতা লাভের পর ভারতের প্রতিরক্ষা প্রযুক্তির ক্ষেত্রেও যথেষ্ট উন্নতি ঘটে। ১৯৫৮ খ্রিস্টাব্দে ভারতের প্রতিরক্ষা গবেষণা ও উন্নয়ন সংস্থা (Defence Research and Development Organisation) প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৬২ খ্রিস্টাব্দে চিনের কাছে ভারতের পরাজয়ের ঘটনা জওহরলাল নেহরুকে প্রতিরক্ষা বিষয়ে আরও যত্নবান করে। এর ফলে রাশিয়ার সহায়তায় ভারতে প্রতিরক্ষা বিষয়ক বিভিন্ন উদ্যোগ নেওয়া হয়।
[7] সম্প্রচার প্রযুক্তি: ভারতে ১৯২৭ খ্রিস্টাব্দে বেতার সম্প্রচার শুরু হলেও তা স্বাধীনতা লাভের পরবর্তীকালে যথেষ্ট প্রসারিত হয়। অল ইন্ডিয়া রেডিও ১৯৫৬ খ্রিস্টাব্দে ‘আকাশবাণী’-তে পরিণত হয়। ১৯৫৯ খ্রিস্টাব্দে ভারতে দূরদর্শন সম্প্রচার শুরু হয়। ১৯৬৫ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে এর যথেষ্ট প্রসার ঘটে। ১৯৬০-এর দশকে ভারতে কম্পিউটার সফটওয়্যার গবেষণার ক্ষেত্রেও যথেষ্ট অগ্রগতি ঘটে।
ভারতে আধুনিক প্রযুক্তিবিদ্যার ব্যর্থতা
[1] জন-বিস্ফোরণ: স্বাধীনতা লাভের পরবর্তী ৬০ বছরে ভারতের জনসংখ্যা অন্তত ৩ গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। এর মধ্যে অন্তত ১/৩ অংশই দারিদ্র্যসীমার নীচে বসবাস করে। এই অত্যধিক হারে জনসংখ্যা বৃদ্ধি প্রযুক্তিবিদ্যার অগ্রগতির ক্ষেত্রে বাধা সৃষ্টি করে।
[2] অর্থসংকট: ভারতে প্রযুক্তির উন্নতিতে অর্থ বিনিয়ােগের পরিমাণ খুবই কম ছিল। ভারতের তুলনায় আমেরিকায় এ বিষয়ে অর্থ বিনিয়ােগ হয় অন্তত ৭৫ গুণ বেশি।
উপসংহার: কিছু প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও স্বাধীন ভারতে প্রযুক্তিবিদ্যার যথেষ্ট উন্নতি ঘটেছে। এর অন্যতম উদাহরণ হল কৃষিপ্রযুক্তিতে অগ্রগতির অন্যতম দৃষ্টান্ত কৃষিক্ষেত্রে সবুজ বিপ্লব। শক্তি এবং ইস্পাত উৎপাদনের হার বৃদ্ধি দেশের প্রযুক্তিবিদ্যার অগ্রগতিতে বিশেষ সহায়তা করেছে।
Leave a comment